বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি টিউলিপ


প্রকাশিত: ০৮:১৫ এএম, ০৯ মে ২০১৫

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

ক’দিন থেকেই বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হচ্ছিল। ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে একঝাঁক তথা বাংলাদেশের ১২ জন বাঙালি বংশোদ্ভূতের জয়ের ব্যাপারে তৈরি হয়েছিল ব্যাপক আশাবাদ। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী এবং রূপা হক; সবাই সেদিকে নজর রাখা শুরু করে। এ ছাড়া ব্রিটেনের রয়েছে তীব্র আগ্রহ। বাংলাদেশেও অসংখ্য মানুষ ব্রিটেনের ক্ষমতায় কে আসছেন তা নিয়ে রয়েছে বিপুল আগ্রহ। অবশ্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তেমন বিশেষ লেখালেখি না হলেও ব্রিটেনে তীব্র লড়াইয়ের খবরাখবর পরিবেশিত হয়েছে।

জনমত জরিপে লেবার  আর কনজারভেটিভের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এবং একটি ঝুলন্ত সংসদ হওয়ার কথাই ব্যক্ত করা হচ্ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচন শেষে ঘোষিত ফলাফলে জরিপের কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ৬৫০টি আসনে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি ৩৩১টি আসন পেয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টি পেয়েছে ২৩২। সরকার গঠনে প্রয়োজন ৩২৬টি আসনের। সেক্ষেত্রে কনজারভেটিভকে ঝুলতে হয়নি কোনো দলের কাঁধে।

অন্যদিকে লেবার পার্টি যেমনটি আশা করেছিল ফলাফল তার থেকে বেশ দূরে থাকায় লেবার নেতৃত্ব বেশ হতাশ হয়েছে। পদ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন এড মিলিব্যান্ড। অন্যদিকে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে বসতে যাচ্ছেন ডেভিড ক্যামেরুন।

বাংলাদেশে আমাদের আগ্রহটি এবার বিশেষভাবে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক, অবশ্য রুশনারা এবং রূপার ব্যাপারেও আগ্রহে ঘাটতি ছিল না। অবশেষে  শুক্রবার যখন জানাজানি হলো যে, টিউলিপ রুশনারা এবং রূপা জয়লাভ করেছেন, তখন রাজনীতি সচেতন মহল বেশ স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। বিশেষত এই নির্বাচনে জনমতের প্রবাহ ছিল কনজারভেটিভ দলের অনুকূলে, লেবার পার্টির বিপরীতে, অথচ তিনজনই জয় লাভ করেছেন লেভারপার্টির প্রার্থী হিসেবে। স্রোতের বিপরীতে তিনজনের জয়কে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

বরং বলা যায় যে, স্রোত অনুকূলে হলে আরো কয়েকজন প্রার্থী হয়তো জয় ছিনিয়ে নিতে পারতেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা টিউলিপ, রুশনারা এবং রূপাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাংলাদেশে বসে আমরা তাদের বিজয়ে ভীষণভাবে আনন্দিত। কামনা করছি ব্রিটেনের সংসদে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। ব্রিটেনের সমাজ ও রাজনীতিতে তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও যোগ্যতার সর্বোচ্চ স্বাক্ষর রাখবেন। তিনজনকেই অন্তর থেকে উষ্ণ শুভেচ্ছা।

টিউলিপ সিদ্দিকের বিষয়টি লেখার এ পর্যাযে টেনে আনছি কিছু কথা বলবো বলে। আশা করি রুশনারা এবং রূপা কিছু মনে করবেন না।

টিউলিপকে বঙ্গবন্ধুর নাতনি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা শেখ রেহানার কন্যা। তার পিতা অধ্যাপক ড. শফিক সিদ্দিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শেখ রেহানা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে ছিলেন না। বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানিতে বেড়াতে গেলেন। সেই সময়েই নির্মম হত্যাকাণ্ডটি দেশে ঘটে গেছে- যা দেশে থাকা বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে সদস্যশূন্য করে দিল। বেঁচে থাকলেন প্রবাসে থাকা দু’বোন। সেই যে বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে থাকা শুরু হলো, তা বোধ হয় আজ অবধি অব্যাহত আছে। শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানাকে এতোটাই আগলে রেখেছেন যে, দুই বোনের জীবন অনেকটাই একাকার হয়ে আছে। তাদের সন্তানরাও একে অপরকে সব সময় এক পরিবারের বলেই মনে হচ্ছে। টিউলিপ জন্মের পর থেকেই মা এবং বড় খালা শেখ হাসিনার আদরে এমনভাবে বড় হয়েছেন।  ছোটকাল থেকেই শুনে এসেছেন টিউলিপের নানা বঙ্গবন্ধুর কথা। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনক। টিউলিপের  জন্মের বেশ আগেই তার নানা, নানি, মামা, মামীসহ পরিবারের সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে তার নানা বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে একজন ক্ষণজন্মা অনন্য অসাধারণ মেধা ও গুণাগুণের অধিকারী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন- যার তুলনা কেবল তিনিই একজন, অন্য কেউ নন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছেন, গত সাড়ে তিন দশক ধরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তার একজন যথার্থ উত্তরাধিকারি হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছেন। আমরা ভাবতে পারছিনা, শেখ হাসিনা যদি বেঁচে না থাকতেন, তাহলে রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনার এই শূন্যতা কে পূরণ করতেন, সে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের পরিণতি কী হতো? বিষয়গুলো ভাববার বিষয়।

একই সঙ্গে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যদি বিদেশে না থাকতেন, তা হলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল না। শেখ রেহানা না থাকলে টিউলিপের কথা কল্পনারই বাইরে। সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ।  মাঝেমধ্যে ভাবি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে শেখ হাসিনা হয়তো সরাসরি রাজনীতিতে খুব বেশি জড়াতেন না। তবে ঘাতকরা ১৯৭৫ সালে ভেবেছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করলে তার শূন্যতা পূরণের কেউ থাকবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের পরিকল্পনাই চূড়ান্ত হবে। কিন্তু বিধিবাম! শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে গেলেন। রাখে আল্লাহ, মারে কে? তারপরের ইতিহাস নতুনভাবে সৃষ্টি হওয়া। শেখ হাসিনা দেশের হাল ধরলেন তিনি বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও মানসকে পুরোপুরি ধারণ ও বহন করছেন।

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নিজের কন্যার রাষ্ট্র ও রাজনীতির নেতৃত্ব প্রদানের যাবতীয় দেখে যেতে পারতেন, পিতা হিসেবে স্বস্তি ও শান্তি পেতেন। মৃত্যু তাকে তা দেখার সুযোগ না দিলেও ইতিহাস সবই মূল্যায়ন করবে। শুধু নিজের কন্যাই নয়, ছোট মেয়ের সন্তান, নিজের নাতনি-টিউলিপ- যাকে তার দেখার সুযোগ হয়নি, আদর-সোহাগ করার সুযোগ হয়নি- সেই টিউলিপ এখন ইংল্যান্ডের মতো দেশের রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছেন। বেঁচে থাকলে এমন অভাবনীয় দৃশ্য দেখে যেতে পারতেন। তবে তিনি এটি দেখে না যেতে পারলেও আমরা যারা বেঁচে আছি তারা দেখছি, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর রক্তবহনকারী নতুন প্রজন্ম দেশের বাইরে, পৃথিবীর অন্যতম আলোচিত দেশ ইংল্যান্ডের সংসদে এখন আসন করে নিয়েছেন।

এ হচ্ছে রাজনীতির রক্তবহনকারী প্রজন্ম- যার জন্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও রাজনীতি দেখে। বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের মুক্তির জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দিয়ে গেছেন একটি স্বাধীন দেশ। বঙ্গবন্ধু এক সময় উচ্চারণ করেছিলেন শোষিতের বিশ্ব গড়ার। তিনি তা হয়তো গড়ে যেতে পারেন নি। তবে তার নাতনি টিউলিপ এখন ব্রিটেনেও মানুষের অধিকার এবং সেবাদানের জন্য আত্ম-নিয়োগ করেছেন। তার এই যাত্রাটি খুবই চমকপ্রদ, আশাবাদী। এখন টিউলিপ ব্রিটেনের সংসদে, ব্রিটেনের রাজনীতিতে। আমরা জানিনা, টিউলিপের পথচলা কতোদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তবে তা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরে, সুদূর যুক্তরাজ্যেও স্থান করে নিয়েছে- এটি শুধু টিউলিপের একা, বা শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা তথা বঙ্গবন্ধু পরিবারের জন্যেই নয়, গোটা বাংলাদেশের জন্যেও অত্যন্ত গৌরবের।

বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, ছোট কন্যা শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্য- এঁরা বঙ্গবন্ধুর সার্থক উত্তরসূরী। বঙ্গবন্ধুর অন্য সন্তানগণ বেঁচে থাকলে দেশ, জাতি ও বিশ্ব রাজনীতি হয়তো এভাবেই উপকৃত হতো, লাভবান হতো। এর চাইতেও কাঙ্ক্ষিত ছিল বঙ্গবন্ধুর বেঁচে থাকা। তা হলে দেশ, জাতি এবং বিশ্বমানবতা হয়তো প্রত্যক্ষভাবেই আরও বেশি লাভবান হতো, পৃথিবী এ মহান নেতাকে পুরোপুরি সমহিমায় দেখতে পেতো। তবে যতোটা পেয়েছে তা-ই-বা কম কীসের? এখন উত্তরাধিকারগণ তার অভাব পূরণ করছেন, টিউলিপের দীর্ঘ জীবন এবং আরও সাফল্য কামনা করি।

লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

বিএ/আরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।