বাবা মেয়েকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছি আমরাই


প্রকাশিত: ০৩:৫৪ এএম, ১৮ মে ২০১৭

কারো জন্য আমাদের কোনও যায় আসে না। কেউ পুড়লেও না, মরলেও না। কেউ দুঃখের জলে, রক্ত নদীতে ভাসলেও না। কেউ খুন হলো কী গুম হলো, কী ধর্ষণ- আমাদের কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আবার যায় আসে, যদি কোনও না কোনও ভাবে সেখানে স্বার্থ, অর্থের যোগ থাকে।

গাজীপুরের হযরত আলী তার মেয়েসহ আত্মহত্যা করেছে। মেয়েটির নাম আয়েশা, মাত্র ১০ বছর বয়স। হযরত আলী তার মেয়েকে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে মাথা দিয়েছে। সবাই দর্শক আমরা। চুপচাপ তাকিয়ে দেখেছি। নির্বিকার সবাই। বাবা মেয়ের এই মৃত্যুতে, আত্মাহুতিতে, আত্মহত্যায় আমাদের সবার সমর্থন রয়েছে। সবাই চেয়েছি আত্মাহুতি দিক, হযরত আলী বেঁচে থাকুক কেউ চাইনি আমরা। যদি চাইতামই, তাহলে তাকে বাঁচাতাম, তার শিশুকন্যাটিকেও বাঁচাতাম। তারা তো বাঁচতেই চেয়েছিল।  মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তেও, মৃত্যুর মুহূর্তেও মানুষ বাঁচতেই চায়। এটাই মানুষের প্রাণ, মানুষের জীবন। আমরা চেয়েছি সেই জীবনটি না থাক। হযরত আলীর মৃত্যুর জন্য সমবেতভাবে সকলে দায়ী। সকলেই হযরত আলী ও তার কন্যার আয়েশার হত্যাকারী।

খুব কী বেশিদিন হয়েছে, হযরত আলী ও তার কন্যার আত্মহত্যার? ঘটনা ২৯ এপ্রিল, সকালের। আমরা এখন ও পর্যন্ত এ মর্মান্তিক মৃত্যুতে এক অদ্ভুত নীরবতা পালন করছি। মৃত্যুর সময়, আগে ও পরে এ নিয়ে খুব একটা বলিনি কেউ। কেউ হয়তো মিনমিন করে বলেছি, আহা উহু করেছি, ফেসবুকে দু’চার দশটি স্ট্যাটাস দিয়েছি। কিন্তু জোরালোভাবে, উচ্চকণ্ঠ হয়ে কেউ বলিনি। চিৎকার করিনি। না মিডিয়া, না প্রশাসন, না প্রগতিশীল বলে নিজেদের যারা দাবি করি তাদের কেউ। হযরত আলীর পরিবারকেও কেউ  টেলিভিশন লাইভে নিয়ে আসার প্রয়োজন বোধ করিনি। আমরা গণ ‘গণমাধ্যম’বলে নিজেদের দাবি করি, কিন্তু ‘গণমানুষের’ কথা কোথায় সেখানে? ক্ষেতমজুর, দিনমজুর, প্রান্তিক মানুষের কী খবর, কতটুকু খবর আসে সেখানে?

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ ইস্যুটি নিয়ে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত দু’শ্রেণীই সবর ছিল। অর্থনৈতিক ভাঙাগড়ায় এখন আর মধ্যবিত্ত বলে কিছু নেই। এ ঘটনা উচ্চবিত্তদের সম্মানে, ইজ্জতে, খানদানে আঘাত করেছে। উচ্চবিত্তরা ভেবেছে, সাধারণ নিন্মবর্ণের মানুষেরা অভিজাত এলাকার এসব কদর্যতার কথা জানতো না। সাফাত ও তার বাবা দিলদার আহমেদের কারণে ধনাঢ্যদের ভেতরের অনেক গোপন খবর লোকে জানছে, সে সম্মান নষ্ট করেছে অভিজাতদের। আর অধনাঢ্যরা যারা তারা ভেবেছে, টাকাওয়ালা লোকগুলো ওপরতলায় বসে আছে, তাদের অন্দরমহলের যা অবস্থা, তা নিচতলার চেয়েও খারাপ। ওপরতলার এ ‘আবর্জনা’নিচতলার লোকেরাও আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চায় সবাইকে। তখন তারাও প্রতিবাদ করে। শাস্তি দাবি করে দু’তলাই। যার যার অবস্থান থেকে। পুঁজিপতিদের যে কোন ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে পুঁজিই । ফলে পুঁজি ‘ধর্ষণের’ এই ঘটনাকে বাড়তি গুরুত্বও দিয়েছে।

হযরত আলী দিনমজুর। শ্রমজীবী। প্রান্তিক। যার কিছুই নেই। ফলে পুঁজিবাদী সমাজে মৃত্যুর আগে ও পরে কখনোই তার গুরুত্ব নেই। তার মৃত্যুটি যেন মৃত্যু নয়, তার মেয়ের ধর্ষিত হওয়াটি, যেন ধর্ষিত হওয়া নয়। কারো কোন যায় আসে না তাতে। সামান্য একটুকরো জমি ছিল তার, যার ওপর নজর পড়েছিল ইউপি সদস্যসহ আরো অনেকেরই।  পরিবারটির ওপর অনেকদিন ধরেই চলছিল নির্যাতন, উৎপীড়ন। ১০ বছরের ছোট্ট মেয়ে আয়েশাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে এলাকার বখাটে ফারুক। থানায় অভিযোগ করে মেয়েটির বাবা। থানা আমলে নেয়নি।

ইউপি সদস্য আবুল হোসেন বিচারের দায়িত্ব নেন। ধর্ষণের আপোস মীমাংসা করতে বলেন, সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে। হযরত তা মানতে নারাজ। কোন মীমাংসা, আইনি সহায়তা ছাড়াই বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে। স্থানীয় প্রশাসন আর পুলিশ মিলেমিশে একাকার হয়ে হযরতকে দূর দূর করে তাড়ায়। বলে, মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে তো কী হয়েছে? তবু হযরত ফিরে ফিরে আসে। যায় এখানে সেখানে। ভাবে, দেশে তো আইন আছে, বিচার আছে। পাবে না কেন সে। মানুষের পায়ে, পায়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় নিজের পা ক্লান্ত হয় হযরতের।

একসময় বুঝতে পারে জীবনের বাস্তবতা। কোথায় আছে, কোন সমাজে তার বসবাস। এখানে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন কেউ শুনতে চায় না তাকে। কেন শুনবে? সে তো দিনমজুর। তার কথা শুনে ‘লাভ’ নেই, ‘লস’ আছে।  হযরত বুঝে যায়, সে কারো নয়, কেউ তার নয়। তার মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে। আগামীতে আবারো ধর্ষিত হবে। এবার একজন ধর্ষণ করেছে। এরপর একাধিকজন ধর্ষণ করবে, পালাক্রমে করবে।

হযরত আলীর মৃত্যু দৃশ্যটি এতো মর্মান্তিক যা দেখলে যে কোন সুস্থ মানুষ নিজের দু’চোখ উপড়ে ফেলতে চাইবে। মেয়েকে নিয়ে হযরত রেললাইনের পাশে এসে বসে। মেয়ে জানে না বাবা এখানে কেন এসেছে, কোথায় যাবে। কিছু সময়ের জন্য আকাশের দিকে তাকায়, শুন্যে। তারপর ট্রেন আসবার ঠিক আগ মুহূর্তে রেললাইনের ওপর মাথা দেয় বাবা-মেয়ে। সে এক ভয়াবহ, বীভৎস দৃশ্য।

বাবা মেয়ের এই করুন, মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের মোটেও বিচলিত করেনি। আমরা প্রত্যেকে অপরাধী যারা ধর্ষণের বিচার না পাওয়া এই বাবা-মেয়েকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছি। বিবেক নেই, আমরা বিকৃত। ন্যায়-অন্যায়, ধর্ষণ-অধর্ষণ আলাদা কোন শব্দ নয়, সব একই আমাদের কাছে। আমরা প্রত্যেকে খুনি, প্রত্যেকে ধর্ষক যারা এই ঘটনার বিচার হতে দেইনি। আমাদের কারণেই আত্মহত্যা করতে হয়েছে তাদের। আমরা ভুলে যাই, সব ভুলে যাই নতুন ঘটনায়, স্বার্থ অর্থের খেলায়।  কিন্তু  ভুলে গেলে চলবে না, রক্ত আর অশ্রু কোনদিন ক্ষমা করে না কাউকেই।
এই হত্যার দায় আমাদের নিতে হবে।
আমাদেরও ক্ষমা নেই। 

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।