ধর্ষণ রুখতেই হবে


প্রকাশিত: ০৪:০৮ এএম, ১৫ মে ২০১৭

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় মনে হচ্ছে দেশে ধর্ষণের উৎসব চলছে। বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। শ্রীপুরে ধর্ষণের শিকার আট বছরের মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের চাকায় আত্মহত্যা করেছেন বাবা। মসজিদের ভিতরে ইমাম ধর্ষণ করেছে এক শিক্ষার্থীকে। পুলিশের সদস্য ধর্ষণের শিকার হয়েছে তারই সহকর্মী দ্বারা। সবগুলো ঘটনাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।

বনানীর ঘটনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে জন্মদিনের পার্টির নাম দিয়ে হোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু নাইম আশরাফ। এ কাজে তাদের সহায়তা করে আরেক বন্ধু সিফাত এবং গাড়ি চালক বিল্লাল ও বডিগার্ড। আসামিরা এতই প্রভাবশালী যে ঘটনার (২৮ মার্চ) পর মাসখানেক ভিকটিমরা ভয়ে থানায় যেতে পারেনি। ধর্ষণের ভিডিও প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি ও প্রাণ নাশের ভয় দেখিয়ে তাদের মুখবন্ধ রাখা হয়। অবশেষে যখন তারা থানায় যায় তখনও মামলা নেয়া হয়নি। ৪৮ ঘন্টা যুদ্ধ চালিয়ে তবে তারা মামলা দায়ের করতে পারে। মামলা নিতেই যখন পুলিশের এত দ্বিধা ও গড়িমসি তখন আসামি গ্রেপ্তারে তাদের ভূমিকা যে কী হবে তা সহজেই অনুমান করতে পারে সচেতনরা। এরপর শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ করে সচেতন জনগণ।

সামাজিক চাপের ফলে শেষ পর্যন্ত দুজন আসামিকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শোনা যায় ধর্ষকদের পরিবার প্রভাবশালী হওয়ায় তারা চেষ্টা করছে টাকা দিয়ে পুলিশের এবং ভয় দেখিয়ে ভিকটিমদের মুখ বন্ধ করার। এমনকি কখনও যদি শুনি ভিকটিম দুজনকে গুম করে ফেলা হয়েছে বা কোন দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে তাহলেও অবাক হবো না। এমনও হতে পারে যে, মেয়েদুটিকে চরিত্রহীন বা যৌনকর্মী বলে প্রমাণ করা হবে। একটি বিষয় আমাদের সমাজের মানুষদের কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না যে, ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ। ডাকাতি, হত্যাচেষ্টা ধরনের অপরাধ। এখানে ভিকটিমের চরিত্র বিশ্লেষণের কিছু নেই। একজন যৌনকর্মীকেও ধর্ষণ করা আইনত অপরাধ। নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ করাও অপরাধ। মোটকথা কোন ব্যক্তির সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাই হচ্ছে ধর্ষণ যা গুরুতর অপরাধ।

সমাজের একেবারে উপরতলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত চলছে ধর্ষণ। শাজনীনের মতো ধনীকন্যা থেকে শুরু করে আয়শার মতো দরিদ্রকন্যাও শিকার হচ্ছে ধর্ষণের। দুই মাসের শিশুকেও ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। রেহাই পায়নি অন্তঃস্বত্ত্বা, গৃহবধূ, সন্তানের জননী পর্যন্ত। অনেক ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয়ের হাতেও ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে নারীকে। গৃহকর্মী শিশু, পথশিশু যেমন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তেমনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্রীও এর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ হয় যখন ধর্ষক হয় প্রভাবশালী। তখন টাকা ও ক্ষমতার দাপটে সে ভিকটিমকে ধর্ষণ তো করেই সেইসঙ্গে তার প্রাণনাশ এবং তার পরিবারের সদস্যদেরও হয়রানি করে। টাকা ও ক্ষমতার সামনে ভিকটিমের বিচার চাওয়ার অধিকারটুকু চাপা পড়ে যায়। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম চার মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৭ নারী ও শিশু। বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয় ৮১ শিশু। আর ধর্ষিত হন ৫৮ নারী। গণধর্ষণের শিকার হন ২৪ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫ নারীকে।

একটি ঘটনার বিচারহীনতা আরও দশটি ঘটনার জন্ম দেয়। যখন একজন সম্ভাব্য অপরাধী দেখে অন্য কেউ একটি অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, টাকার জোরে রেহাই পাচ্ছে, তখন সেও অপরাধ করতে উৎসাহী হয়। যখন একজন ব্যক্তি দেখে প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে অথচ শাস্তি হচ্ছে না, আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে অপরাধী বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তারও মনে হয় কই কিছুই তো হলো না। সেও তখন অপরাধের পথে পা বাড়ায়। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি যেন আমাদের দেশে জেঁকে বসেছে। ইউরোপ আমেরিকাতেও নারী ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু সেখানে আইনের হাতও যথেষ্ট শক্ত। অপরাধ ঘটিয়ে কেউ পার পায় না।

যতদিন রাষ্ট্র ও সমাজ নারীর উপর নির্যাতন ধর্ষণ যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে না ভাববে ততোদিন প্রশাসনও এটাকে তুচ্ছ ভাববে। আর সহজ হিসেবে ততোদিন এটা লঘু ঘটনা হয়েই থাকবে।ধর্ষণ বিষয়ে জিরো টলারেন্স মনোভাবের কথা কতবার, কতভাবে বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে। তবু কারোরই যেন কিছুই আসে যাচ্ছে না। চলছে চলবে এমনি একটি মনোভাবের ভিতর দিয়ে দিন পার হচ্ছে। নারীর উপর নির্যাতন সেকেন্ডারি বা তারচেয়েও কম, একেবারেই গৌণমাত্রার কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিবেচিত হয়েছে। তবে এখন সময় হয়েছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আমরা ৯ মাসে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি।

পাকিস্তানি ধর্ষকদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে পেরেছি। অথচ এখন দেশীয় ধর্ষকদের প্রতিরোধ করতে পারছি না। কলেরা বসন্তের মতো প্রাণঘাতী রোগ দূর করতে পেরেছি কিন্তু ধর্ষণের ভাইরাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারছি না। আসুন ধর্ষণের বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরে প্রতিরোধ গড়ি। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে সবজায়গায় যেখানেই ধর্ষক পাবেন প্রতিরোধ করবেন।তাদের বিরুদ্ধে গণশাস্তির ব্যবস্থা হোক। যে বাড়িতে ধর্ষক আছে তাদেরকে একঘরে করুন। নিজের আত্মীয় ধর্ষক হলে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিন। যে অফিসে মালিক ধর্ষক সেখানে কেউ চাকরি করবেন না। ধর্ষকের সঙ্গে কেউ বন্ধুত্ব করবেন না। যে যার অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করুন।

ধর্ষণের পক্ষে কেউ যুক্তি দেখাবেন না। ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যার পক্ষে কোন যুক্তি দেয়া যায় না। নারীর পোশাককে যদি কেউ দায়ী করতে আসে তাহলে তাকেও বয়কট করুন। কারণ যারা ধর্ষণের পক্ষে যুক্তি দিতে চায় তারাও মানসিকভাবে ধর্ষক। তাদের মনের ভিতর অপরাধী সুপ্ত রয়েছে। তারা নারীকে যৌনবস্তু বলে মনে করে। নারীর ব্যক্তিত্বকে স্বীকার করে না। এরা পোটেনশিয়াল ধর্ষক। অফিসে আদালতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরকম কথা যেই বলুক সাথে সাথে সবাই মিলে তার প্রতিবাদ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ধর্ষণ শুধু নারীর ইস্যু নয়, শুধু নারী সংগঠনের দায় নয়, এটি নারী-পুরুষ সকলের ইস্যু। আসুন সকলে মিলে ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।