ধর্ষক সাফাতের বাবা আরো অশ্লীল!


প্রকাশিত: ১১:৪০ এএম, ১৩ মে ২০১৭

খুব সকালে এক বন্ধুর ফোন, দূর দেশ থেকে। টোনেই বোঝা যায়, বিরক্ত আমার উপর। বলে, পুরুষ হয়ে একতরফা কেবল পুরুষের দোষই দেখ। পুরুষ খারাপ, পুরুষ খারাপ, পুরুষ খারাপ- তোমার কেবল এক কথা। তুমি আসলে পুরুষ কি না আমার সন্দেহ। বন্ধু আমার কোন কথাই শুনতে চায় না। বলতে থাকে, মেয়েগুলো যে রাত-বিরাতে হোটেলে গেল, কেমন মেয়ে। সে সব নিয়ে তো কিছু লিখলে না। মেয়েরা যে কত কিছু করছে কত জনের সঙ্গে, সেসব নিয়ে কোন দিন একফোটাও লিখলে না। বলে নিজেই রেখে দেয় ফোন। কি করে বোঝাই তাকে আমি নারীবাদী-পুরুষবাদী কোনটাই নই, স্রেফ মানবতাবাদী। জেন্ডার নিউট্র্যাল। লিঙ্গ নিরপেক্ষ। নারী পুরুষ আমার কাছে বিষয় না, মানুষ বিষয়।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে চোখ যায় যুগান্তর অনলাইলে। ‘আরে মিয়া, আমার পোলা আকাম (ধর্ষণ) করছে তো কি হয়েছে। জোয়ান পোলা একটু-আধটু তো এসব করবেই। আমিও তো করি।’ ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি নিয়েই পড়ি পুরোটা। দিলদার আহমেদ সেলিম, ধর্ষক সাফাতের বাবার সাক্ষাৎকার। যুগান্তরের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। কথা বলেছেন না বলে অশ্লীল বাক্য আউড়েছেন বলাই সমীচীন। যেমন ছেলে তার তেমন বাবা। যোগ্য বাবার সন্তান তো যোগ্যই হবে। ধর্ষণের সংজ্ঞাও তিনি বেশ শেখাচ্ছেন। মনে হয়, তারও এ বিদ্যা ভালো জানা আছে।

আরো বলেছেন, ‘ধর্ষণ কাকে বলে আসলে আপনারা তা জানেন না। জোর করে কিছু করলে তাকে ধর্ষণ বলে। কিন্তু যে মেয়ে নিজের ইচ্ছায় হোটেলে গিয়েছে তাকে ধর্ষণ করতে হবে কেন? আসলে ওরা (ধর্ষিত দুই তরুণী) মনে করছে বড় লোকের ছেলেরে পাইছি। এগুলোরে ধর্ষণ মামলায় ফাঁসাইতে পারলে কিছু টাকা-পয়সা পাওয়া যাবে।’ এখানেই শেষ নয়। ‘আমিও তো অনেক জায়গায় আকাম করি। করুম না কেন। আমি কি বুড়া হইয়া গেছি নাকি? আমার যৌবন নাই? আমিও তো হোটেলে যাই। আমার ছেলে যদি হোটেলে ওগো লগে কিছু কইরা থাকে তো মিলমিশ কইরা করছে। ধর্ষণ করতে যাইব ক্যান?’ অশ্লীলতা, বিকারগ্রস্ততার ছড়াছড়ি কথায়। সুস্থ মনে হচ্ছে না তাকেও।

কোন বাবাই চান না তার সন্তান অমানুষ হোক, ধর্ষক হোক, সন্ত্রাসী হোক। এমনকি খুনি যে, হত্যাকারী যে, সন্ত্রাসী যে সেও চায় তার সন্তান যেন মানুষ হয়। তার মতো যে না হয়। কিন্তু অভিযুক্ত ধর্ষক সাফাতের বাবা ব্যতিক্রম। তার ছেলেকে এখন আর অভিযুক্ত ধর্ষক বলবার সুযোগ নেই, তিনি নিজেই সে সুযোগ উডিয়ে দিয়ে ছেলের ধর্ষণের পক্ষে যুক্তি উপস্থিত করছেন। ছেলে যে ধর্ষক তার পক্ষে দিলদার আহমেদ নিজেই গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তিনি গত কিছুদিন ধরেই ধর্ষণের পক্ষে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।

আপন জুয়েলার্স নিয়ে বির্তক উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বির্তকটি নিয়ে তোলপাড়। অনেকে ‘আপন সোনা’, ‘পর সোনা’- এসব বলে অহেতুক অশ্লীলতার অবতারণা করছেন। এক তরুণী লিখেছে, ‘আজ থেকে আপন সোনা বর্জন করলাম।’ স্ট্যাটাসের নিচে অন্য একটি আইডি থেকে কমেন্টস, ‘তাহলে কি এখন থেকে পর সোনা নেবেন।’

একটি সিরিয়াস সোস্যাল ইস্যু নিয়ে অশ্লীলতা, সামাজিক অসুস্থতাকে ইঙ্গিত দেয়। বোঝা যায়, কিছু লোকের রুচি বিকৃতি কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে। এই ধর্ষণের সঙ্গে, সাফাতের সঙ্গে মনে হতে পারে আপন জুয়েলার্সের কী সম্পর্ক? মনে হতে পারে ব্যক্তি সাফাত আর প্রতিষ্ঠান আপন জুয়েলার্স তো আলাদা। তাহলে কেন আপন জুয়েলার্সকে বর্জনের কথা বলা হচ্ছে? বিষয়টি আসলে অন্য খানে, ধর্ষণ সমর্থনে। সাফাতের বাবা দিলদার সেলিম আপন জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী। শুরু থেকেই তিনি এ ঘটনাকে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। শুরুতে যে বনানী থানা মামলা নিতে চায়নি, সেটা এই প্রভাবের কারণেই তা এখন অনেকেই বলছেন। তিনি তার অর্থের জোরে আইনকে প্রবাহিত করতে চান, ভিন্ন খাতে। তার যে অশ্লীলতা, খিস্তি খেউর, বিকারগ্রস্ত আচরণ, মন্তব্য বক্তব্য- এর মূল কারণ পুঁজির বিকার।

অপরাধী ছেলেকে তিনি অর্থের জোরেই বাঁচাতে চান, সে অর্থের উৎস আপন জুয়েলার্স। যে নিরীহ মেয়ে দুটো সম্পর্কে তিনি অশ্লীল মন্তব্য করছেন, অসম্মান করছেন, অবজ্ঞা করছেন- তার মূলেও রয়েছে টাকাই।

টাকা উপার্জন করা, অর্থবান হওয়া কোন অন্যায় নয়। অপরাধ নয়। বরং যে কোন উদ্দ্যোক্তা সম্মানিত হন, তার অর্থ সফলতার কারণে। বড় বড় কোম্পানি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান মানুষের কল্যাণে, ভালো কাজে অর্থ ব্যয় করে। তা না করে যদি অপরাধীকে বাঁচাকে অর্থ ব্যয় হয়, তা বড় দুঃখ ও লজ্জার। একজন দিলদার আহমেদ ভুলে গেছেন তিনি বাবা। তিনি জানেন না বাবা শব্দটির অর্থ কী? ছেলের ধর্ষণ সমর্থনই কেবল করছেন না, নিজের যৌন অযাচারের কথাও বলে বেড়াচ্ছেন বুক ফুলিয়ে, সাহসের সঙ্গে।

পুঁজির বিকার আসলেই বড় ভয়ঙ্কর। মানুষকে মানুষ রাখে না, মনুষ্যত্ব নষ্ট করে। ভোগবাদী করে। করে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন। বিকৃত, বিকারগ্রস্ত। ফলে ধর্ষণ-অধর্ষণে পার্থক্য বুঝতে পারে না। যারা এই মেয়েদের জবানবন্দি ভিডিও করে ইউটিউবে দিয়েছে তারাও অপরাধী। কাজটি তারা করেছে উপার্জনের জন্যে। সহানুভূতি, সহমর্মিতা জাগাবে এ আশায় নয়, কিছু লোক কৌতূহলী হয়ে উঠবে, যৌনপুলক বোধ করবে ধর্ষণের বর্ণনায়, এ আশায়।
পুনশ্চ : শুরুতে যে বন্ধুর কথা বলেছিলাম, লেখাটি লিখতে লিখতে মনে পড়ছে তার কথা। বন্ধু বলেছিল, কেন মেয়েদের কথা লিখছি না, তারা রাত করে হোটেলে যাচ্ছে। এই বন্ধুর মতো এমন আরো অনেক বন্ধু আছেন, সবার জন্য বলছি- মেয়েরা যেতেই পারে, তাই বলে কী তাকে ধর্ষণ করতে হবে? মেয়েরা যাবে। অবশ্যই যাবে। বরং গিয়েও যেদিন যে কোন মেয়ে নিরাপদে ফিরবে তখনই, সেদিনই সোসাইটি সুস্থ, স্বাভাবিক হয়েছে বুঝতে হবে। আর মনে রাখতে হবে সবাইকে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে- না মানেই ‘না’, ‘কোনভাবেই না’।

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।