একজন অকুতোভয় বীর ও তাঁর সেলাই দিদিমনির করুণ দুর্ভাগ্য
চোখের সামনে বিশাল এক অট্টালিকা তাসের ঘরের মতো ধসে গিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গেলো। হাজার হাজার খেটে খাওয়া মানুষ সেই ভবনের ভেতরে আটকা পড়ে গেলো। নয় তলা ভবনের তিন তলায় চারজন কর্মী ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছেন। কিন্ত বহির্গমনের কোনো পথ খোলা নেই। উদ্ধারকর্মীরা তাঁদের জীবন বাজি রেখে ধ্বংসস্তূপের তলদেশ থেকে তাঁদের রক্ষা করার জন্যে দিকবিদিক ছোটাছুটি করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উদ্ধারকার্য শুরু করার আগেই এদের চারজনের তিন জনের জীবন প্রদীপ সেখানেই নিভে গেলো। তবে ধ্বংসের তলদেশ থেকে শোনা গেলো আটকা পড়ে থাকা এক নারী কণ্ঠের করুণ আর্তনাদ। তিনি শাহিনা। আমাদের সংগীত শিল্পীর কণ্ঠে যারা ` লাল টুক টুক সেলাই দিদিমনি `।
এতো ভালোবাসার সম্বোধনে তাঁদের সম্বোধন করলেও বাস্তবতা হচ্ছে এদের সমগ্র জীবনটাই `নুন আনতে আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায় অবস্থা`। কাকডাকা ভোরে দলবেঁধে মাইলের পর মাইল হেঁটে যায় ওরা দুপুর- রাতের খাবার হাতে। দেশ ও পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যারা হাড়ভাঙ্গা শ্রম দিয়ে উন্নয়নের ফসল `রেমিটেন্স` ঘরে নিয়ে আসে। আর তা দিয়ে বাড়ে আমাদের জীবনযাত্রার মান। সেই সেলাই দিদিমনিদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই আমরা একটি মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নিয়েছি। শাহিনা সেই দিদিমনিদেরই একজন। প্রাপ্য পারিশ্রমিক তো দূরের কথা।
দিদিমনিরা মালিকের হুমকি শোষণ আর অবহেলায় ভবনের নিচে চাপা পড়ে থেকে বাঁচার আর্তনাদ করে। জীবন রক্ষার জন্য উপায় না পেয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে থেতলে যাওয়া আটকা পড়ে থাকা নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলেন। কখনো তালাবদ্ধ গার্মেন্টস এর আগুনে নিজেই নিজের পুড়ে ভস্ম হতে থাকা শরীর চেয়ে চেয়ে দেখেন। যা আমরা দেখেছি তাজরীন গার্মেন্টস ভস্মীভূত হওয়ার সময়। কয়লার মতো পুড়ে যাওয়া দেহে যাদের চিহ্নিত করার কোন উপায়ও ছিলোনা। যারা কোলের দুগ্ধ শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সুযোগ পান না। তিনি তেমনই একজন নিপীড়িত, অবহেলিত, দলিত সেলাই দিদিমনি। দু`বেলা খেয়ে জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে এমনভাবেই তাদের জীবনে নেমে আসে করুণ নির্মম মৃত্যু।
বাংলাদেশে ইতিহাসের মানুষের কারণে ঘটিত সবচেয়ে করুণ দুর্যোগ সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসে যাওয়া। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়েছিলো। অসৎ অর্থলোভী শোষক গার্মেন্টস মালিকদের অবহেলার কারণে এই দুর্যোগে হাজার হাজার গার্মেন্টস কর্মীর জীবনাবসান হয়। কারো কারো আর খোঁজই মেলেনি। আবার এদের কেউ কেউ চিরতরে বরণ করেছে পঙ্গুত্ব। উপার্জনক্ষম এই শ্রমিকদের পরিবারের বর্তমানে কি হাল আমরা তা জানিনা। তবে বাস্তবতা বুঝতে খুব কষ্ট হবার কথা নয়।
আমরা জানতে পেরেছি রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে কোনো হত্যা মামলা দায়ের করা হয়নি৷ দুর্ঘটনা জনিত কারণ দেখিয়ে যে মামলা হয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র ৫ বছর যা গুরু পাপে লঘু দণ্ডের মত৷ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া শাহিনা ক্রমাগত চারদিন তাঁর অসীম শক্তি ও সাহস নিয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছেন। তবে বেঁচে থাকার লড়াই করতে গিয়ে তিনি হতাশ হননি। কারণ অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী নিবেদিত প্রাণ মানুষ বাইরে থেকে তাঁকে সাহস যুগিয়েছেন, দিয়েছেন অনুপ্রেরণা। তাদের নির্দেশনায় ভেতর থেকে রডও কেটেছিলেন তিনি।
উদ্ধারকর্মীদের সন্ধানের সীমানায় থেকে রাত হয়েছে ভোর। ক্রমাগত প্রহর গুণছিলেন কখন তিনি রক্ষা পাবেন। ``শাহিনা ম্যাডাম আপনি ঠিক আছেন``? `` আমিতো ঠিক আছি কিন্তু বের হতে পারছি না। আপনার লাইট আমার চেহারা দেখতে পারতেসে। আমি অধৈর্য হইনাই। আমাকে সাদা পানি দেন ``। ``আপনি চিন্তা করবেন না, আমাদের জীবন থাকতে আমরা আপনাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবো ``। টুকরো টুকরো এই কথোপকথন হচ্ছিলো ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে শাহিনা আর উদ্ধার কর্মীদের মধ্যে। মোট চারটি রড কাটতে হতো শাহানাকে বাঁচাতে হলে। এর মধ্যে আর তিনটি কাটতে পারলেই বাঁচানো যেতো শাহিনাকে।
আড়াআড়িভাবে চাঁপা পড়ে থাকা শাহিনার দেহের বেশিরভাগ অংশই বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিলো। উদ্ধার কর্মীদের নাগালের খুব কাছ থেকে এমন করুণ দৃশ্য টেলিভিশনের লাইভ ব্রডকাস্টিং এর মাধ্যমে আমরা সকলেই রুদ্ধশ্বাসে দেখেছি। আমরা দেখেছি উদ্ধার কর্মীরা কিভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন একজন শাহিনার জীবন রক্ষা করার জন্য। সন্তানের কাছে ফিরিয়ে দিতে না পারার কারণে অঝোর ধারায় চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন উদ্ধার কর্মীদের বয়োজ্যেষ্ঠ একজন।
সেনাবাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীদের সাথে হঠাৎ যোগ দেন কায়কোবাদ নামের একজন স্বেচ্ছাসেবী। পেশায় তিনি ইঞ্জিনিয়ার। উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া উদ্ধারকর্মীদের কাছে জানা গিয়েছিল, তিনি একাই ৩০ জন শ্রমিককে উদ্ধার করেছিলেন। উদ্ধারকাজে তার পারদর্শিতা দেখে সেনাবাহিনীর লোকেরা তাকে সাদরে তাঁদের সাথে গ্রহণ করেন। কায়কোবাদ তাদের বলেছিলেন, ভেতরে আটকা পড়ে থাকা সকলকে সাথে নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরতে চান। শাহিনাকে তিনি বলেছিলেন ``শাহিনা আপনি সাহস হারাবেন না, আমরা জীবন দিয়ে হলেও আপনাকে জীবিত উদ্ধার করব।" নারীর প্রতি অসম্মান, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং বিদ্বেষের এই দুর্ভিক্ষের সময় একজন নারী শাহিনার জন্য কায়কোবাদের এই আত্মত্যাগ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।
শাহিনা ধ্বংসস্তূপের নিচে ১০০ ঘণ্টা ধরে লড়ছেন বাঁচার জন্য। তাঁকে জীবিত উদ্ধার করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন সকল উদ্ধার কর্মীরা। কায়কোবাদ শাহিনাকে উদ্ধার জন্য নিজের প্রাণটি নিয়ে নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে নেমে গিয়েছিলেন ভয়ংকর গহ্বরে। তিনি রানা প্লাজার আটতলা থেকে সুড়ঙ্গ করে তৃতীয় তলা পর্যন্ত নেমেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে এবং উদ্ধারকাজে কিছুটা ভুল পদক্ষেপ নেয়াতে শেষ মুহূর্তে এসে ড্রিল মেশিনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিকাণ্ডে ঘটে যায় সুরঙ্গের ভেতর। পুড়ে যায় কায়কোবাদ এবং শাহিনার শরীরের অনেকটা অংশ। যার ফলে স্ফুলিঙ্গের আগুনে গহ্বরেই জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিলো শাহিনার। আর দগ্ধ অবস্থায় কায়কোবাদকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর পাঠানো হলেও মৃত্যু তাকে ঠিকই শেষ মুহূর্তে গ্রাস করে কেড়ে নেয়।
বেলা শেষে হাজার হাজার জীবনাবসানের এ ক্ষয় আমরা হয়তো ভুলে যাবো, কিন্তু তাঁরা ভুলে যাবে না, এই দুর্ঘটনায় যাদের স্বজন হারিয়ে গেছে। ভুলতে পারবে না শাহিনার দেড় বছরের সন্তান রবিন। ভুলতে পারবেন না শাহিনাকে উদ্ধার করতে না পারার যন্ত্রণায় কান্নায় ভেঙে পড়া কয়েকজন উদ্ধারকর্মী। ভুলতে পারবেন না কায়কোবাদ নামের একজন অসাধারণ বীরের স্ত্রী-সন্তান। যে কায়কোবাদ এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শুধু একজন পুরুষই ছিলেন না, ছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবক, মানব দরদী, অকুতোভয় সৎ-সাহসী মানুষ। তিনি নিঃশঙ্ক চিত্তে মানুষের কল্যাণে নিজের জীবন ত্যাগে ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জন্য জীবন দিয়েছেন। মানুষের জন্য মানুষের এই আত্মত্যাগ আমাদের মানুষ হতে অনুপ্রেরণা দেয়। তবে প্রকৃতই যারা বীর তাঁরা কখনো স্বীকৃতির ধার ধারে না। কেউ দিক আর না দিক সাধারণ মানুষের পক্ষ হতে, মানবিক মানুষের পক্ষ থেকে, বাংলাদেশের সকল নারী শ্রমিকের পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করতে চাই,কায়কোবাদ আমাদের জাতীয় বীর।
লেখক : কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/পিআর