আত্মহত্যা : এক বৈশ্বিক সমস্যা


প্রকাশিত: ০৩:৫৪ এএম, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

‘এই জল ভালো লাগে-বৃষ্টির রুপালি জল কতদিন এসে ধুয়েছে আমার দেহ-বুলায়ে দিয়েছে চুল-চোখের উপর...’ অথবা এ বাংলার রূপে বিমুগ্ধ হয়ে যে কবি নির্দ্বিধায় অন্য সকলকে বলতে পারেন  ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব’-এমন স্বদেশপ্রেমী রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু কিন্তু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। আর তাই হয়তো ট্রাম দুর্ঘটনাজনিত যে মৃত্যুকে আমরা সত্য বলে জেনে এসেছি সেটাই জীবনানন্দ গবেষক ভূপেন্দ্র গূহ বাস্তব নিঙড়ে দেখাতে চেয়েছেন আত্মহননস্পৃহার পরিণতি হিসেবে;উপলক্ষে যার বিদ্যমান ছিলো পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ। তারই উপজীব্য হিসেবে দেখতে পাই,দুর্ঘটনা পরবর্তী যে ৯দিন তিনি কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪ সালে মারা যান; সে কয়টি দিনও স্ত্রী লাবণ্য দাশ হাসপাতালে তাকে দেখতে এসেছেন কদাচিৎ।

অন্যদিকে, জমিদারি  হারিয়ে কবি ফাল্গুনী রায়ের পূর্বপুরুষ যখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন, জীবন ও জীবিকা যখন কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে, হতাশার নিকষকালো অন্ধকারে নিমজ্জিত তখন তিনি স্বেচ্ছামৃত্যু কামনা করেছিলেন। যদিও মাত্র ৩৫ বছরের নাটকীয় জীবনের শেষদিনগুলোতে তিনি বাঁচার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন প্রতিনিয়তই। কিন্তু ধীরে ধীরে ভয়ংকর মাদকাসক্ত হয়ে তিনি নিজেকে ঠেলে দিয়েছিলেন আত্মহননের পথে জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাই হয়ত তীব্র বাঁচার আকাঙ্খাও তার জীবনকে আর দীর্ঘায়িত করতে পারেনি। কিন্তু তাঁর বেঁচে থাকার আকুতি অন্তত এটা আমাদের জানান দিয়ে যায় যে মৃত্যুর চেয়ে জীবন সুন্দর।

স্বাভাবিক মৃত্যুর মাঝে যে জীবনের লয় সে জীবন আমাদের সকলেরই কাম্য। কিন্তু পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক যে কোন  প্রেক্ষাপটের কারণে জীবন যদি হয়ে ওঠে গ্লানিময়, তখন স্বাভাবিক চেতনা লুপ্ত হয়ে অস্বাভাবিক পন্থার আশ্রয় নিতে মানুষ একবিন্দু দেরি করে না; যদি সেটা আত্মহননের মতো কঠিন পথও হয়। এ কারণেই  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে বিশ্বব্যাপী প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করছে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ানক তথ্য হচ্ছে এর চেয়েও অধিক মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে; যাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ-তরুণী। সংস্থাটি আরো বলছে, সারা বিশ্বে যত মানুষ আত্মহত্যা করে তার ৭৫ভাগ-ই বাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়। ২০১৫  সালে সংস্থাটি  তাদের প্রতিবেদনে বলেছে সারা বিশ্বে আত্মহত্যার হারে বাংলাদেশ দশম। প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে আট লক্ষেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে।

আমাদের দেশে ২০১৩ সালে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু ছিলো মোট ১০১১৫ জনের; যা গড়ে প্রতি মাসে  প্রায় ৮৪২ জন। ২০১৫ সালে তা নাকি ১৭হাজার ছাড়িয়ে গেছে।  কিন্তু এর চেয়েও উদ্বেগের খবর হচ্ছে যে  আমাদের দেশে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকির মাঝে আছে যাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ-তরুণী। বাংলাদেশ জার্নাল অব মেডিসিন এর ২০১৩, জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত  একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা ২০ থেকে ৩৯ বছরের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি; যার ৬১ ভাগ নারী এবং ৩৯ ভাগ পুরুষ। অন্যদিকে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর তথ্যমতে, সেখানে প্রতি ঘন্টায় আত্মহত্যা করে ১৫ জন। সে হিসেবে বছরে প্রায় ১,৩১,৪০০ জন মানুষ উপায়ন্তর না পেয়ে আত্মহননের মতো পথ বেছে নেয়। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, এর চেয়েও ২০ গুণ বেশি মানুষ সেখানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে।

আমাদের এ অঞ্চলগুলোতে  বিষপানে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি হলেও উন্নত দেশগুলোতে  আগ্নেয়াস্ত্র ও গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যুর হার বেশি। আর উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে যে, এ দেশগুলোতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও (৭০ বছর বা তারচেয়ে বেশি) আত্মহত্যা করে । কিন্তু আমাদের দেশসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশসমূহে তরুণ-তরুণীদের ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। সারা বিশ্বে এত মানুষ যে আত্মহত্যা করছে সেটা সত্যিই গভীর উদ্বেগের বিষয়। তাই এ আত্মহত্যা রোধে বিশ্বব্যাপী এবং  আঞ্চলিক পর্যায়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা খুব জরুরি ভিত্তিতে নেয়া দরকার যেন  অদূর ভবিষ্যতে তা ব্যাপকভাবে কমে আসে।

আত্মহত্যা রোধ করতে হলে এর কারণগুলো নির্ণয় করা খুবই জরুরি। সাধারণত বলা হয়ে  থাকে যে সারা বিশ্বে যত মানুষ মারা যায় তার ৫০% আত্মহত্যা করে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে। ২৫% মানুষ আত্মহত্যা করে  সিজোফ্রেনিয়া, মাদকাসক্তি ও ব্যক্তিত্বের সমস্যাজনিত কারণে। প্রায় ১৫-১৬% ক্ষেত্রে জেনেটিক বা বংশগতি দায়ি। আর কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের গঠন এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে রাসায়নিক পদার্থের তারতম্যের  ফলেও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায় কোন কোন ক্ষেত্রে।

আমাদের এ অঞ্চলগুলোতে আত্মহত্যার পেছনে যে সকল কারণ বিদ্যমান তার মধ্যে রয়েছে পারিবারিক অশান্তি, প্রেম, বেকারত্ব, পরীক্ষায় ফেল, দারিদ্র্য, জটিল ও কঠিন অসুখে ভোগা, যৌতুক প্রথা ইত্যাদি। কিন্তু এ কারণগুলোর পেছনের কারণ যদি আমরা খুঁজতে যাই তাহলে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দায়ভার প্রকট হয়ে  দেখা দেয়। যেখানে তরুণ-তরুণীদের জন্য সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের ভেতরের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ তরে দেওয়া জরুরি সেখানে হয়ত তার উল্টো কাজটিই আমাদের সমাজপতিরা করে চলেছেন। ফলে তারুণ্য হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। এর ফলে একরাশ দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা আর হতাশা তাদেরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছে। জীবন তাদের কাছে নিতান্তই অর্থহীন হয়ে পড়ছে।

যে জীবন ছিলো সম্ভাবনার, স্বপ্ন দেখার ও দেখানোর  সে জীবন হয়ে গেলো নষ্টের, নর্দমার কীটের চেয়েও ঘৃণ্য। বেঁচে থাকার মাঝে তারা আর সুখ খুঁজে পায় না। জীবন সংহারের মাঝে তারা তৃপ্তি খুঁজে নেয়। যে জীবন ছিলো বীর, যোদ্ধা আর সংগ্রামীর সে জীবন হয়ে  গেলো ভীরু ও কাপুরুষতার ছোঁয়ায় আচ্ছন্ন। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা আত্মহত্যার চেষ্টাকারী এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী উভয়ের শাস্তির বিধান করেছে। দণ্ডবিধি অনুযায়ী আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীর শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড। আর আত্মহত্যা  চেষ্টাকারীর শাস্তি ১বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু তাতে কি আত্মহত্যা চেষ্টার সংখ্যা কমেছে? অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, যে মানুষটি নিতান্ত হতাশায় বা অন্য জটিল কারণে আত্মহননের মতো পথ বেছে নিলো সে কারণ খতিয়ে না দেখে এবং দূর করার ব্যবস্থা না করে তার জন্য শাস্তির বিধান করে কি  কোন লাভ হয়েছে?   যদিও স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদেরকে কখনই শাস্তি দেওয়ার নজির নেই তাহলে দণ্ডবিধির এ ধারাটা বহাল রাখার অর্থ কি?

আত্মহত্যার সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য আমাদের তাই সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই জীবনের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির দুটি দিক তুলে ধরতে হবে। আশা-হতাশা, সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নামক জীবনের এ দ্বান্দ্বিক কিন্তু বিদ্যমান  বাস্তবতাসমূহ তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। কোন কিছু অর্জিত না হলেই যে জীবন বৃথা এমন ভাবনা থেকে তাদেরকে বের করে আনতে হবে। জিপিএ ৫ পাওয়া বা ক্লাসে প্রথম হওয়া না হওয়া অথবা প্রেম সংক্রান্ত নানা টানাপোড়েন বা এমনতর কিছুই যে জীবনের সবকিছু নয়- এ সত্যটা বড়দের যেমন বুঝতে হবে তেমনিভাবে ছোটদেরকেও বুঝিয়ে বলতে হবে। আসল কথা হচ্ছে, মানুষ হওয়ার শিক্ষা নিতে হবে নিজেকে প্রথমে  এবং সেটাই বিলিয়ে দিতে হবে পরিবার ও সমাজে। তাহলে তরুণ বয়সেই হয়ত তারা জীবনের সত্যিকারের মানে খুঁজে পেতে সচেষ্ট হবে। আত্মঘাতী হওয়াও যে একটা নিন্দনীয় কাজ সেটাও বুঝতে পারবে। এজন্য প্রয়োজনে স্কুল, কলেজ ও উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে  ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার জন্য অত্যাবশ্যকীয়ভাবে  সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে যেন মানসিক উদ্বেগজনিত সময়ে বা কোন কারণে হতাশাগ্রস্থ হলে তাদের সাহায্য নিতে পারে।

আর রাষ্ট্র যেন মানুষের মৌলিক চাহিদা সমূহ পূরণে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় সে ব্যাপারেও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। যুক্ত পরিবার ভেঙে পৃথক পরিবার গঠনকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কারণ যুক্ত পরিবারে অনেকের সাথে মানসিক মিথস্ক্রিয়া হওয়ার সুযোগ থাকে। তাছাড়া দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষ পেলে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা তাড়িয়ে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন সৃষ্টি হয় । দুঃসময়ে সমর্থন না পেলে হতাশা আরো তীব্রভাবে বাসা বাঁধে এবং পরিণতিতে আত্মহত্যার মতো মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। উন্নত বিশ্বে এ নিঃসঙ্গতার কারণেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধরা বেশি সংখ্যায় আত্মহত্যা করে থাকে।

জীবন তো একটাই। বেঁচে থাকার মাঝেই তাই জীবনের সার্থকতা এবং জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার মাঝেই আছে জীবনের সুবাসিত রূপ। আত্মহনন যে কোনো সমাধান নয়-তরুণ হৃদয়ে সে বোধ সৃষ্টি করার জন্য পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। তাহলেই আত্মহনন বা আত্মঘাতী হওয়ার পথ বেছে নিতে কেউ উৎসাহিত হবে না।
লেখক : চিকিৎসক।

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।