একজন বন্ধুকে স্মরণ
২০১৬ সালে ধানমন্ডিতে বাসায় দুর্বৃত্তদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের সাবেক কর্মী জুলহাস মান্নান। আজ ২৫ এপ্রিল তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট (মার্শা বার্নিকাট)।
নিঃস্বার্থ; সবাইকে ভালোবাসেন, সবাইকে যিনি অনুপ্রেরণা জুগিয়ে থাকেন- জুলহাস মান্নানকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে তার বন্ধুরা এ শব্দগুলোই ব্যবহার করেন। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত সহকর্মী, অনুগত বন্ধু এবং মানবাধিকার রক্ষায় অগ্রপথিক।
২০১৬ সালের এপ্রিলে নিষ্ঠুরভাবে খুন হন তিনি। জুলহাস মান্নান শুধু আমার সহকর্মীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমার বন্ধু এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস পরিবারের অংশ। তাকে জানতে কিংবা পরিচিত হতে পেরে আমরা ভাগ্যবান। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।
নিঃস্বার্থ জুলহাস; নিঃস্বার্থভাবে জীবনযাপন এবং সমাজকে আরো বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করতেন তিনি। নিজের চেয়ে তিনি সব সময় অন্যকে এগিয়ে রাখতেন, সেটা কর্মক্ষেত্রেই হোক আর বন্ধুদের সঙ্গেই হোক অথবা কোনো অচেনা কেউ, এমনকি নিজের বাড়ির একান্তে থাকা অবস্থাতেও।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএইড) সহকর্মীরা তাকে বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতেই দেখতেন। কীভাবে জুলহাস কোনোরকম আর্থিক লাভ, স্বীকৃতি কিংবা পুরস্কারের প্রত্যাশা না করে দুই বছর ধরে একটি কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন- এ কথা ভেবে আজও আনন্দিত হন জুলহাসের সহকর্মীরা।
মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলাকে তিনি যে মূল্য দিয়েছিলেন তার মূল্য অর্থের চেয়েও অনেক অনেক বেশি ছিল তার কাছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি খুব সাচ্ছন্দ্যে অর্থ বিলিয়ে দিতেন। মন-মানসিকতায় উদার জুলহাস সত্যিকারের বাংলাদেশি আতিথেয়তা ও স্বার্থহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
জুলহাস যখন মারা যান, সারা বিশ্ব থেকে তার জন্য এসেছিল ভালোবাসার শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাকে নিয়ে সে সময় যে আলোচনা হয় তাতে একটি বিষয় ফুটে ওঠে, আর তা হলো- সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে নতুন যারা বাংলাদেশে আসত তাদের তিনি স্বাগত জানাতেন এবং সময় নিয়ে তাদের এ দেশের চমৎকার দিকগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন।
যাদের জীবনকে তিনি তার ভালোবাসা দিয়ে স্পর্শ করেছেন আমরা তাদের কাছ থেকে এসব গল্প শুনতেই থাকি।
প্রীতিপূর্ণ
জুলহাসের হৃদয় ছিল ভালোবাসায় পূর্ণ। সবার প্রতি তার ব্যবহারে ছিল সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালোবাসাভরা। যেকোনো কাজই তিনি করতেন অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে। তিনি যে কেবল বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদেরই ভালোবাসতেন তা-ই নয়, তিনি শিল্পকর্ম, ফুল ও গাছপালা এতোটা ভালোবাসতেন যে তিনি তার বাড়ির বেজমেন্টে একটি কলাগাছ লাগিয়েছিলেন!
তার চারপাশে যারা থাকত, তাদের সঙ্গে কোনো কথা না বলেই জুলহাস ভালোলাগার অনুভূতি এনে দিতেন। তার কাজ, বন্ধুতা ও অনিঃশেষ হাসি একধরনের ভালোলাগা ও ইতিবাচক অনুভূতি এনে দিত তার চারপাশে। যা কেবল ভাষা দিয়ে প্রকাশ সম্ভব নয়।
জুলহাস জীবনকে ভালোবাসতেন, যেমনটি ভালোবাসতেন তার চারপাশের মানুষদের এবং তার দেশকে।
অনুপ্রেরণীয়
যারা তাকে চিনতেন না, তাদের হুমকি ও কটূক্তি সত্ত্বেও জুলহাস নিজের প্রিয় দেশকে কিংবা যে সমাজের উন্নয়নের জন্য লড়াই করেছেন তাকে ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ছিল তার স্বদেশভূমি।
জুলহাসের বন্ধুরা বলেছেন, যে পরিবর্তনের তিনি স্বপ্ন দেখতেন গত বছরের বসন্তে তা করার জন্য অনুপ্রেরিত ও বদ্ধপরিকর থাকতেন। তার সেই সাহস বেঁচে থাকবে।
তিনি আজ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করতে, সেখানে যত বাধাই আসুক না কেন বা তার পরিণাম যাই হোক না কেন?
শেষ করার আগে জুলহাস সম্পর্কে শেষ একটি কথা- জুলহাস একটি পরিবার। তিনি তার মায়ের প্রতি নিবেদিত ছিলেন, তার ভাই-বোনদের ভালো ও বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন এবং তাদের সন্তানদের ভালোবাসতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাসে আমরা তার অন্য একটি পরিবার হিসেবে তার প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি। সেই প্রচেষ্টা হলো- মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ও বিশ্বাস নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ যেন তার প্রতিভা বিকাশে সমান সুযোগ পায়।
এটি আমার লক্ষ্য এবং আমি যাদের ভালোবাসি- সেসব বন্ধু, সহকর্মী, দেশবাসী ও আমার পরিবার- তাদের জন্য আমি প্রতিদিন লড়াই করি, লড়াই করে বেঁচে থাকি।
*জুলহাস মান্নান যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দূতাবাসে প্রায় একদশক ধরে কর্মরত ছিলেন। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন।
এইচআর/জেআইএম