আলোর জন্য লড়াই
জঙ্গি গুরু মুফতি হান্নান ও তার তিন সহযোগীর ফাঁসি হয়েছে বুধবার রাতে। সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বড় জঙ্গির ফাঁসি ছিল এটি। এমন একজন গণঘাতকের ফাঁসির পরও উদার, অসাম্প্রদায়িক এবং আলোকিত মানুষের মন বিমর্ষ। কারণ এসব মানুষ খুব ভাল করে অনুভব করছে যে, সময় ভাল নয়, খুব দ্রুতই সব বদলে যাচ্ছে, অন্ধকার আলোকে মুছে দিচ্ছে ক্রমেই। যাদের উপর ভরসা করে মানুষ, তারাই ছুটছে অন্ধকারের পানে।
বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে মেরুকরণ স্পষ্ট হয়েছিল অনেক আগেই। বেগম জিয়া-বেগম জিয়ার বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদীদের সাথে হাত মিলিয়েছে সেই ১৯৭৫-এ। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে যে, কেউ বুঝতে পারছেনা রাজনীতির মাঠে কোনটি আসলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতায় নেমে মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক পরিবারগুলির নিরস্ত্র মানুষদের গণহত্যা ও গণধর্ষণে লিপ্ত হয়েছিল যে চক্র তাদের দোসরদের সাথেই এখন সখ্য সবার।
রাজনীতির মাঠে খেলছেন যারা তারা খেলেন, তবে মনে রাখা দরকার প্রায় অর্ধ শতাব্দি পার হলেও বাংলাদেশের জনমানসে মুক্তিযুদ্ধের স্থান অনেক বড়, সম্মানের। যতই দুধ কলা দেয়া হোক, এদেশের মৌলবাদি, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতা বিরোধীদের আসল ঘর কিন্তু বিএনপি-জামায়াত। তাই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির ভোট পেতে গিয়ে নিজেরটা হারিয়ে যায় কিনা, ভাবা দরকার।
আজ যারা আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক ভাস্কর্য সরাবার দাবি জানিয়ে সফল হয়েছে তারা কাল বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে ফেলতে বলবে। আজ যারা পাঠ্যবই মৌলবাদি করে তালি বাজাচ্ছে, যারা আজ কওমী মাদ্রাসা সনদ প্রায় আদায় করে ফেলেছে, তারাই আগামীতে নারী নেতৃত্ব হারাম করে দেয়ার দাবি তুলবে, জাতীয় সঙ্গীত বদলে ফেলার কথা বলবে।
যারা বিদ্বেষের বিষ ছড়ায়, তারাই আদরে আমন্ত্রিত হয়। আগুনতো কেবল আলোর শিখা নয়, আগুনতো পুড়িয়ে ছারখারও করে। আজ বাংলাদেশে বিদ্বেষের আগুনে পুড়ছে সহিষ্ণুতা, বহুত্ববাদ আর সংস্কৃতি। যখন ব্লগার, লেখকদের হত্যা করা হচ্ছিল, যখন এক গ্রুপ যখন তখন ফতোয়া দিচ্ছিল, নাস্তিক আস্তিক বলে। তখন যারা রাজনৈতিক উস্কানি দিয়েছে, আর এখন যারা আপস করছে, তাদের রাজনীতির আর প্রভেদ থাকছে না। এখন পার্থক্য কেবল ক্ষমতায় থাকা না থাকা। আপসের রাতেই পোড়া মবিলেই ঢেকে যায় প্রাণের বৈশাখে দেয়ালে আঁকা ছবি।
বাংলাদেশ এখন যতটা না মানুষের রাষ্ট্র, তার চেয়ে অনেক বেশি মুসলিম রাষ্ট্র। তাই কথায় কথায় সংখ্যা গরিষ্ঠতার ফতোয়া উচ্চারিত হয়। আমার ধর্মের প্রয়োজনে অন্যের প্রয়োজনীয় যেকোন কিছু ধ্বংস করা যায়, এমন এক সংস্কৃতি মগজে প্রবেশ করছে খুব দ্রুততার সাথে। চরম মৌলবাদি, কুৎসিততম নারী অবমাননাকারী ব্যক্তিটি এখন পূজনীয়।
মাত্র কয়দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি। এক জায়গায় আছে, তিনি বলছেন, ‘যে দলের সাথে আর্দশগত মিল নাই, কোনো ইস্যুতে তেমন দলের সাথে ঐক্য করলে, আপাতত দল লাভবান হতেও পারে, কিন্তু দেশের মানুষের কোনো উপকারে আসবে না’। দলের লাভ আছে কি নেই তা সময় বলবে, কিন্তু আসল বিপদটা এখন বাংলাদেশের। অতি সুবিধাবাদের রাজনীতি ফিরিয়ে আনছে ধর্মীয় রাজনীতিকে যা কেবল ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়ায়, সম্প্রীতির বন্ধন বাড়ায় না। একটি গোষ্ঠির অসংযত, আদিম প্রবৃত্তি সভ্যতার দাবিকে অগ্রাহ্য করে প্রবল বেগে এগিয়ে আসছে। তাই বাংলাদেশ আজ বিপন্ন। মুক্তমনা লেখক যখন খুন হয়, নির্বিরোধী যাজক বা পুরোহিত যখন চাপাতির আঘাতে লুটিয়ে পড়ে, যখন আলোকিত মাওলানা তার প্রিয় ঈদগাহে নামাজ পড়াতে পারেন না, তখন সমাজ ঘৃণার বিষে নীল হয়ে যায় না। তখনও রাজনীতি কৈফিয়ত খোঁজে।
কিন্তু সব মানুষ কি পথ ছেড়ে দেয়? লন্ডনে মাসুদ খালেদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্রিজের পাশে এসে দাঁড়ায় হিজাব পরা নারীরাও। বাংলাদেশেও এমন অগণিত মানুষ আছে যারা সময় হলে এমন হাতে হাত রেখে পথে নামবে। হাতে হাত ধরা এই অগণন মানুষের শক্তিটাকে শাসকদল কখনো আন্দাজ করতে পারেনা। এদের হাত ধরেই বারবার মানবতার রাস্তা জেগে উঠেছে।
বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়। এখানে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের হামলার ভয়ে নাগরিক সমাজ ঘরে খিল দিয়ে বসে থাকেনি, পথে বের হয়ে এসেছে, চ্যালেঞ্জ করেছে। জেহাদি মৌলবাদে সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্র যখন আপস ও আত্মসমর্পণের রাস্তায় হেঁটেছে, এই সরকারই জামায়াতি ও তার সহযোগী বিশৃঙ্খলার শক্তিকে কড়া প্রশাসনিক দাওয়াই দিয়েছে। প্রশ্ন হলো তাহলে এখন কেন এমন দিকভ্রান্ত পথে যাওয়ার চেষ্টা?
উন্মত্ত মানবতাবিরোধী, অসহিষ্ণু, ধর্মবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী, ফ্যাসিবাদমুখি শক্তির সাথে গিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হবেনা। মনে রাখতে হবে মানুষই পেরেছে বারবার এই শক্তিকে পরাজিত করতে। অন্ধকার আলোকে মুছে দিতে চায়, কিন্তু আলোর কাছেই পরাজিত হয় অন্ধকার। তাই খুব সামনেই এক লড়াই, আলোর জন্য লড়াই এবং সে লড়াইটা আলোর সন্ধানে থাকা এদেশের প্রতিটি সাধারণ ও অসাধারণ মানুষের। ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করছে কিংবা রাজনীতিতে যারা ধর্মকে জোরালো করছে, তারা জানুক, সেই লড়াই আরো ব্যাপ্ত হবে।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস