বৈশাখী কথা


প্রকাশিত: ০২:১০ এএম, ১৪ এপ্রিল ২০১৭

এ লেখার আঁচল আড়ালে কোনো উদ্দেশ্যের উপস্থিতি নেই একেবারেই। প্রসাধনের রঙে-রেখায় একে সাজিয়ে তন্বীর লাস্য-হাস্যে উচ্ছ্বল, উজ্জ্বল করবার তাগিদও নেই। অজপাড়া গাঁ; সেই পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর পার করে আসা সময়-নদীর ওপারে শূন্য ভিটায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আজও। মায়ের শত কুঞ্চনে কুঞ্চিত মুখের ভূগোল সে সময়ের সাক্ষী। শতবর্ষী পিতার নির্বাক স্পন্দনহীন দৃষ্টিহীন শূন্য চোখের বিনষ্ট মণির অভ্যন্তরে সে কাল অতি উজ্জ্বল আভায় জ্বলে। ঐ দুটি চোখের আলো দিয়েই আমার বিশ্ব দেখার সূচনা। মহাজনের হালখাতায় যাবেন তিনি সেজেছেন পরিপাটি, গ্রাম বাংলায় পরিপাটি বলতে যা বুঝাতো সেকালে তা’ই।

সেকালের গ্রাম এমন-যে পাকা রাস্তা দেখতে হলে ত্রিশ মাইল যেতে হয় পায়ে হেঁটে; চাঁদবিহীন রাত অন্ধকারে ঠাসা, নিরন্ধ্র অন্ধকার; চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদ মহাশোষক, শুষে নিয়েছে কুয়ার জল, অগভীর পুকুরগুলো ফাটা বুকে আকাশমুখো উদোম পড়ে আর্তনাদ করছে জলের জন্য; দু’একটি পুকুর গভীর, তার জলে পুরো একটি গ্রাম, কোথাও ততোধিক গ্রামের মানুষের রান্না-খাওয়া চলে। কোথাও জল নিতে গৃহস্থের নিষেধ ও তা নিয়ে ঝগড়ার খবর আনতো জনে জনে বয়ে। গ্রামের ধনীগৃহস্থ ব্যতীত খুব কম ঘরেই তিনবেলা খাবারের যোগাড় থাকতো এ সময়।

আজকের মতো ভূ-তলের জল তুলে কৃষিউৎপাদনের কোনো ব্যবস্থা নেই কারণ এ অঞ্চলে নেই কোনো নদীর প্রবাহ। ধূ ধূ মাঠ শস্যশূন্য পড়ে আছে অসহায়; গ্রামের নিরন্ন হতদরিদ্র পরিবারের শূন্যতার সাথে মাঠের শূন্যতা অভিন্ন। ধূ ধূ মাঠ শব্দটি হয়তো সেই বাস্তবদৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতেই সৃষ্ট। হ্যাঁ! এইরূপ আর্থ-সামাজিক অবস্থায় চৈত্রের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তি উপস্থিত হতো নতুন অতিথির আগমনের আনন্দ ঝিলিক নিয়ে। ক্ষণস্থায়ী সে ঝিলিক। ঐরূপ নিরন্ন জীবনে আনন্দের অবয়ব কতো বিষণ্ন, নির্মেদ একহারা হতো আজকের তরুণ বাঙালির পক্ষে তা কল্পনার চোখে মূর্ত করাও অসম্ভব।

আমি সেই গাঁয়ে জন্মে ছিলাম যা ছিল এক গভীর অরণ্যের গর্ভের এক অংশ সে অরণ্যের এমন অনেকগুলো অংশ, জনবসতি দ্বারা আলাদা আলাদা। অরণ্য গর্ভের মাঝে মাঝে উৎপাদন-প্রজনন, জন্ম-মৃত্যুর লীলায় বাহিত হচ্ছে মানুষের জীবনধারা। ইতিহাস নেই কোনো, কবে, কখন, কোন মহাজাতির মানুষের পায়ের চিহ্ন প্রথম পড়েছিলো এখানে কেউ জানে না। স্বাভাবিক বুদ্ধি দ্বারা সিদ্ধান্তের ভূমিতে যতোদূর পৌঁছানো যায় তাতে বুঝি এলাকার আদি নিবাসী ছিল কোচ সম্প্রদায়ের মানুষ। মুসলমান বাঙালিরা পরবর্তীকালে বুদ্ধি কৌশলের দ্বারা ক্ষমতার কেন্দ্রে ওঠে আসে, সমস্ত এলাকায় করে আধিপত্য বিস্তার। যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের ধাক্কাখাওয়া মানুষ যে, পরবর্তী সময়ে এই নিবিড় বনভূমি দখল করে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ স্থানের মানুষের পূর্বপুরুষের নিবাস ঠিকানা থেকে। টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এরা।  শৈশবে এই কোচ সম্প্রদায়ের লোকজনকে দেখেছি তারা কৃষিকাজের অবসরে বনে বনে বন্যবরাহ, খরগোশ ইত্যাদি নিজেদের মতো অসহায় প্রাণিদের শিকার করতো। জাল দিয়ে সমগ্র বন ঘেরাও দিয়ে ঐ সকল প্রাণি শিকার করে আমিষের অভাব পূরণ করতো। তাদের মধ্যে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিও ছিল স্থানীয় মুসলমান, হিন্দুরা কোচদের বলতো মান্দাই। বিস্তার্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী এই সকল কোচ সম্প্রদায়ের লোক ১৫ই চৈত্র ঢাকে বাড়ি দিতো।

তারপর থেকে রাত দিন চলতো ঢাক বাজানো। চলতো শিব গাজনের প্রস্তুতি ধেনু মদ চোলানো ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজকর্ম। ঢাকের বাদ্য কোনো কৃত্যের নিয়ম অনুযায়ীই বাজানো হতো। নির্গ্রন্থী এই কোচ সম্প্রদায় শৈব। চৈত্র সংক্রান্তি বা শিবগাজন ছিল তাদের প্রধান উৎসব। চৈত্রের শেষ সাত দিন কোচগণ নৃত্য-সঙ্গীত-বাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিবমূর্তি প্রদর্শন করে অর্থ সংগ্রহ করতো। শিবগাজন বা চৈত্রসংক্রান্তী এতদাঞ্চলের কোচদের বারোয়ারি পূজা। তাই সকলের অংশগ্রহণে এর যাবতীয় কর্মসম্পাদন করাই দস্তুর। প্রাচীন কাল হতে এই ধারা এখনও অনুসৃত হয়ে আসছে। বাড়ি বাড়ি চাল ও অর্থ সংগ্রহের ভিন্ন তাৎপর্যও রয়েছে।

শিব অনার্য দেবতা বলে ভারতবর্ষীয় পুরাণের ইতিহাসে স্বীকৃত। শিব সম্পর্কিত প্রচল পুরাণে আছে শিব আত্মভোলা সংসারে মন নেই বৃষবাহন, বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে, গৃহস্থ নারীগণ প্রদত্ত খুদ (চালের কণা) নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পার্বতীর গাল-মন্দ খায়। অতএব, শিব গাজনের জন্য বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করা দস্তুর। সে পুরাণে কোচরমণীর সাথে শিবের প্রণয় সম্পর্কিত আখ্যানও রয়েছে। একই রকমভাবে পথশ্রান্ত শিব ভিক্ষা করতে করতে দূরবর্তী কোনো জনপদের কোথাও হয়তো রাত্রি যাপন করত। কোচসম্প্রদায় ভিক্ষা বা অর্থ সংগ্রহকালে তারই অনুকরণ করে আজও। তারাও ভিক্ষা মাগতে গিয়ে এক এক দিন এক এক বাড়িতে রাত্রি যাপন করে।

বাবা যে-হালখাতায় যেতেন তা পাশের গ্রামের বাজারের দোকান মালিকের বাৎসরিক হালখাতা। হযরত গোলদাইরা  ( গোলার মালিক; দোকান অর্থে গোলা ), কুদ্দুস দোকানদার, গনেশ সাহা মহাজনের হালখাতা। বছরে যতো বিক্রয় হয়েছে ( বাকি বা নগদ) তার হিসাবের খাতাটি নতুন বছরে বহন করবেন না মহাজন। হাল সনের অর্থাৎ নতুন বছরের জন্য নতুন খাতা চাই। খাতা ফেলে দেবেন, তাই বলে ক্রেতাদের ফেলে দেবেন না নিশ্চয়ই। এ খাতায় আবার বিক্রেতাদের নাম উঠবে। যিনি বাকি সম্পূর্ণ পরিশোধ করবেন তাঁর নাম, যিনি অর্ধেক বা তার কম পরিশোধ করবেন তাঁর জমা বাদে বাকি টাকাসহ নাম, যাঁর কোনো বাকি নেই কিন্তু তিনি মহাজনের বাঁধা খদ্দের তাঁকে মহাজন হারাতে চান না, তিনিও নিমন্ত্রণ পেতেন তাঁর নামও নতুন খাতায় উঠতো। তিনি পঞ্চাশ এক ’শ টাকা দিয়ে হালখাতার দাওয়াত খেয়েছেন, জমা নামের পাশে লেখা আছে।

ভারী সুন্দর ক্রেতা-বিক্রেতার সে সম্পর্ক। লগ্নিপুঁজির মালিক, কুসীদ ব্যবসায়ী বা তেজারতি ব্যবসায়ীরাও হালখাতা করতো। অভিন্ন নিয়ম। আজ দেশে শ’খানেক ব্যাংকের হাজার কয়েক শাখা রয়েছে দেশে প্রত্যেক শাখা হাজার হাজার কোটি টাকার লেন-দেন করে; প্রত্যেক ব্যাংকই করে কুসীদ ব্যবসা; বছরে দু’বার ইয়ার ক্লোজিং আছে অথচ হালখাতা নেই তাদের। খুবই পরিষ্কার আমাদের সংস্কৃতি ব্যাংকের জন্মদাতার সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণেই তা নেই। সংস্কৃতির ভিন্নতার গভীর অর্থ উপলব্ধির মানুষ  নেই এদেশে আজ।

সেকালের হালখাতায় চিড়া, দই, মিষ্টি মণে মণে খাওয়াতেন এক এক জন মহাজন দোকারদার। যতো বড় পুঁজি, তত বড় মহাজন, তত সংখ্যক গ্রাহক। তত বড় হালখাতা ক্রেতার সংখ্যা অনুপাতে তা ঠিক হতো। ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের নৈকট্যের গন্ধ পাওয়া যেতো সে সব অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি হতো পয়লা বৈশাখে। চৈত্র সংক্রান্তির পর দিন। বৈশাখী মেলাও হতো ঐ দিন থেকে। এই অঞ্চলে কোথাও একে বলতো ছিটের বাজার। কোথাও রঙের বাজার, কোথাও মেলা, কোথাও বলতো আড়ং। সব মিলে একই কথা হাজার মনের হাজার মানুষ মেলায় মেলা মানুষ। মেলা মানুষের একত্রে মিলিত হওয়াই মেলা। মেলা মনের মেলা রঙ। বিচিত্র রঙের পোশাক;  নানা বয়সী মানুষ; কতো কতো পণ্যের বাহারিরূপ, বেলোয়ারি চুড়ির রিনিকি ঝিনিকির মতো টুং টাং কথার মালা গেঁথে এঁকে বেঁকে গাঁয়ের পথে খই-হাসি মুখে মেলা মানুষের ঘরে ফেরা। মেলায় পুরনো বন্ধুর সাথে বহু দিন পর মেলা। যে আসে নি তার মনেও রঙ ছড়ানোর আয়োজন থাকে মেলা।

প্রথম মেলায় যাবার অভিজ্ঞতা বালক বয়সের গণ্ডি পার ক’রে। বালক বয়স অরণ্যের হিংস্রতা অতিক্রম ক’রে বাইরে যাবার বয়স নয়; বড়দের শাসনে, চোখে চোখে থাকবার বয়স। মেলার সামগ্রী নানা ধরনের মুড়কি-মোয়া, গুড়ের বাতাসা, ঢ্যাপের খই, বিন্নির খই, কদমা, ছাঁচে তৈরি চিনির হাতি, ঘোড়া, পাখি, ষাঁড় ইত্যাদি বাড়িতে বসে কুড়মুড় করে চিবিয়ে খাবার বয়স। সেই সাথে মেলার ভেঁপু, বাঁশের বাঁশি, চড়কি হাজার রকম খেলনার দু’চারটে পাবার বয়স। মাটির তৈরি একই উচ্চতার কালো শিং সাদা জোড়া বলদের একটির শিং ভেঙে ফেলে কষ্ট পাবার বয়স। গুলতি, মার্বেল নিয়ে সারা দিন অহেতুক ব্যস্ত থাকবার বয়স।

ঘুড়ির সেই আশ্চর্য উড়বার ক্ষমতা দেখে নিজেকে উড়াবার আকাঙ্খা জাগবার বয়স। সে বয়সে মেলার সকল সুখ ভোগ করা যায়, মেলা দেখবার বেলায় কেবল বিপত্তি। বিপত্তির কারণ গৃহস্ত-সংসারে নাগর-সংস্কৃতির সদস্য বাবা-মার মতো স্বাধীন নয় সন্তানের বাবা-মা। গৃহস্থালির বারো রকমের কাজের শতেক ঝামেলা; যৌথ পরিবারের ঝঞ্ঝাট; ঋতুভিত্তিক ফসলের চাষ, ফসল তোলা কতো সব ব্যস্ততা; আত্মীয়পরিজন সামলে বাবা-মার পক্ষে সন্তানের ঠোঁটে ঠোঁটে আদর ঢালার অবকাশ থাকতো না। বরং বালক, বালিকাদেরকেই ছোটখাটো কাজে বাবা-মাকে সাহায্য করতে হতো। সে ছিলো বড় হয়ে সংসারের শত কাজের প্রশিক্ষণও বটে।

সেকালে বালক-বালিকাদের বিস্তীর্ণ শৈশব পরবর্তী কালে তাদের জীবনের এক বিশাল পুঁজির সঞ্চয় বললে আপত্তি করবার সুযোগ নেই। বিস্তীর্ণ মাঠে দিনমান ছোটাছুটি, নানা নামের লতার সাথে লতার বিয়ে ঘটানো; পাতায় পাতায় নিজের স্পর্শ রেখে যাওয়া; ঘুঘুর বাসায় তার সন্তানদের রসি বেঁধে বন্দি করে রেখে তার বড় হবার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণতে থাকা; টিয়ের ছানাটা উড়ে চলে গেলো কি না রোজ তিনবার খোঁজ নেয়া; বটগাছের ডালে ডালে পাকা টসটসে বটফল খেতে আসা হরিয়ালের ঝাঁক, তাদের ঘাড়ের স্বর্ণাভ-সবুজ পালকের উপর বিকেলের সোনালি রোদের ঝিলিক প্রাণভরে দেখা; হঠাৎ কোন্ খেয়ালে ঢিল ছুঁড়ে তাদের উড়িয়ে দেয়া কতো কি সৃষ্টি ছাড়া কাণ্ডে ভরপুর সেই বালকবেলা। বনে বনে ঘুরে আনই, বঁইচি ফল, ভেওলা, বুনোজাম কুড়িয়ে, পেড়ে খাওয়ার আনন্দ পরিপূর্ণ সে কাল, আহা! তেঁতুলের খোলে ভাই-বোনে মিলে শাকবর্তা, ডিমবর্তা ভাত রান্না করে খাওয়ার জন্য আস্ত দুপুরটা রোদে-ধোঁয়ায় একশেষ হওয়ার বালকবেলা কোল ঘেঁষে দাঁড়ায় আজও। আগুনের ওপারে দাঁড়ানো মানুষের ছায়া যেমন এপার থেকে দেখায় তেমন তারা।

এমন বালক বেলায় মেলায় যাওয়া হয় নি।  মুসলমান পরিবারে গাজনের উৎসবে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধা ছিল তা নয়, ছিল একটি সংস্কার। শিব শ্মশানচারী, ভূত-প্রেত তার সহচর। নানী বলতেন, সংক্রান্তির দিন তারা মুক্ত হয়ে যত্রতত্র বিচরণ করে অতএব, ছোট ছেলেমেয়েদের ঐ দিন বাইরে যেতে মানা যদি ভূত বা প্রেতের আছর হয়! গ্রামীণ বাংলায় সেদিন এ জাতীয় সংস্কার ছিল বদ্ধমূল তাই তিনসন্ধ্যা বেছে চলতো সকলে। নতুন বউ, নবজাতক তারাও পড়তো এই অনড় নিষেধের আওতায়। সেদিন সংস্কারের ও  ধর্মের গণ্ডি দ্বারা লোকাচার বিধিবদ্ধ হয়নি হিন্দু-মুসলিম সকলের লোকাচার ও সংস্কার প্রায় অভিন্ন ছিল।

সেদিনও মুসলিম মা কন্যাকে বলতেন সন্ধ্যায় ঘর ঝাঁট দিসনে লক্ষ্মী চলে যাবে। কেউই দোষ দেখে নি সে কথায়। প্রতিবেশি কোনো নারী  আদর করে বলতেন ও কথা বলবেন না বুবু, আপনার মেয়েটা বড় লক্ষ্মী! একই রকমভাবে উৎসব পার্বণ ছিল সবার, কেবল কৃত্যটুকু সম্প্রদায়গত, আলাদা আলাদা। তাই উৎসব-পার্বণে সর্বজনীনভাবে নানা ধর্মের সকল মানুষই দ্বিধাহীন অংশগ্রহণ করতো। নিরক্ষর, বিপুল অর্ধশিক্ষিত মানুষের সমাজে সেদিন সাম্প্রদায়িক বিভেদ দেখা দেয় নি। ধর্ম নয়, মানুষে মানুষে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভেদ  সৃষ্টির মূলে রাজনীতি।

প্রথম মেলায় যাবার দিনটি বেশ মনে পড়ে। একা গিয়েছলাম। বাড়ি থেকে আট কিলোমিটার দূরের খালার বাড়ি থেকে। গাজনের মেলা। রাতের কৃত্যগুলো পুরোহিতের ধূপধুনোর পাত্রসহ বিশেষ ছন্দে পরিবেশিত নৃত্যের তালে চলছিল স্রোতেপ্রবাহের মতো। বাঙালির শস্যের নৃত্যের সুরার দেবতা শিব। কৃত্যের শেষ শুরু হলো শিবের কৃষক জীবন। বৈশাখের প্রথম বৃষ্টির পর বীজ বপণ একান্ত জরুরি হালের বদল কিনতে বেরিয়েছেন শিব, অন্যান্য গৃহস্তগণও বাজারে ভালো কৃষিকাজের উপযোগী গরু কিনতে গেছে বাজারে। গুরু কেনা নিয়ে নানা হাস্য রসাত্মক নাট্য-আখ্যান। এ নাট্যের পরিবেশনা শেষ হতেই আরম্ভ হলো সঙ-যাত্রার অভিনয়।

বারোয়ারি পূজার উৎসবে নারীপুরুষ, বালক-বালিকা বিভিন্ন বয়সের ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্ট হাস্যরসাত্মক নাটক সঙ-যাত্রা। ছোট ছোট ঘটনার ভিত্তিতে রচিত সূক্ষ্ণ ব্যঙ্গরসের নাটক সঙ। সঙের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দুঃখী মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক কষ্টের ভাববিমোক্ষণ ঘটে। পরিচিত জীবনের নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ে সঙের অভিনয়ে।  সে রাতে স্নায়ু বিকল করা দৃশ্য দেখে ভয়ে গা শিউড়ে উঠেছিল পুরোহিতের মন্ত্রপূত দায়ের উপড় সমস্ত শরীরের ওজন নিয়ে তিন তরুণের দাঁড়ানোর দৃশ্য দেখে। অনেক পরে বুঝেছি সে ছিল নিতান্ত কসরৎমূলক ক্রিয়া। হাজরার রাতে আদিম হেড হান্টিং এর সাদৃশ্য মূলক কৃত্যের অংশ শ্মশানে মানুষের মাথার খুলি বা করোটি সংগ্রহে যাওয়া। চার দিকে চারজন যুবক রাম-দা নিয়ে বেরিয়ে গেলে আসর থেকে চলে আসি সে রাতে। অবোধ চেতনায় নানা প্রশ্নের উঁকি ঝুঁকি; বাকি রাত ঘুমাই নি।

বৈশাখী মেলার দিন কোচ সম্প্রদায়ের কোনো কৃত্য নেই। বিচিত্র রকম শাক দিয়ে ভাত খেয়ে তারা মেলায় যায় বিকালে। চড়কগাছ ঘোরানোর খেলা আরম্ভ হবার আগে চলে জমজমাট কসরৎমূলক নাট্য লাঠিখেলার পরিবেশনা। এ খেলা বেশ মজাদার নাটকের মতো এতে রয়েছে সংলাপ, তা অবশ্যই সংকেতধর্মী  ভাষার  সংলাপ। দর্শক তা বুঝতে পারে না, কিন্তু প্রতিপক্ষ সংকেত বুঝে তার জবাব দেয় লাঠির আঘাতে। লাঠিখেলার ছন্দকে এক ধরনের নৃত্য বলার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এর জন্য প্রয়োজন অসামান্য দক্ষতা, অসম সাহস ও অমিত শক্তি এবং সূক্ষ্ণ কৌশল। লাঠির পর যখন রাম-দা নিয়ে একে অপরকে আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ করে তখন তাদের ক্রোধ প্রকাশের অভ্যিব্যক্তিই প্রমাণ করে তারা কতো বড় অভিনেতা।

এতক্ষণকার কথার সূত্র ধরে বলা যায় আত্মনিয়ন্ত্রণ লাঠিখেলার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্রুদ্ধ প্রতিপক্ষের আকস্মিক আক্রমণ প্রতিহত ক’রে যখন একজন লাঠিয়াল প্রতিআক্রমণে যায়, তখন তার আত্মনিয়ন্ত্রণ বা আত্মসংযমের অভাব হলে প্রাণহানির কারণ হতে পারে। এতো কিছু বুঝবার বয়স তখন নয়। এ সব হিসেব শিখি অনেক পরে বালক নই যখন অনেক মেলা ঘুরে এ কালের ঐশ্বর্যবিহীন পণ্যের হাটকে মেলা বলতে শুরু করেছি তখন। সেদিন সন্ধ্যার আগখান দিয়ে সূর্য যখন কমলা রঙের আলো ছড়িয়ে খররোদের ধার কমিয়ে এনেছে, তখন গভীর পুকুর থেকে একটি লম্বা গজারি গাছ অনেক খুঁজে তোলা হলো।

অনেক দিনের পুরনো, চিনবার উপায় নেই গজারি গাছ, জলে থাকতে থাকতে সে গোক্ষুর সাপের বরণ পেয়েছে। আগে কখনও দেখি নি; গাছঘোরানো বলতে কি বুঝায় তখনও জানি না। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের মেলায় আমার মতো আগন্তুক অনেক, তাদেরকে অভিজ্ঞ লোকেরা রসিয়ে রসিয়ে বলছিলো- :এই গাছটা অন্য পুকুর থিকা উইড়া আইছে এই পুকুরে। মন্ত্রপড়া গাছ। আইজ ঘোরানোর পরে জলে নামাই রাখবো, আবার যেখানের গাছ সেইখানে চইলা যাবো। আবার আগামী চৈত্রের শ্যাষ দিন এই পুকুরে চইলা আসবো। সব কিছু অয় শিবের নামে। এইটা কিন্তুক শ্মশান; শোনো নাই, শিব শ্মশানে থাকে ভূতপ্রেত সঙ্গে থাকে তার?

সেদিন কথাগুলো শুনে বিশ্বাসের নৌকায় লাফ দিয়ে চড়ে বসি আমি। শরীরে বালক বয়সের পালক তখনও সব খসে পড়ে নি। বিজ্ঞান দিয়ে যোগ্যতা হয় নি জগতকে দেখার। মহন্ত মান্দাইয়ের বাড়ির পেছনের শূন্য ভিটার তালগাছ তলায় এলে ভূতের ভয়ে গায়ে কাঁটা দেয়, বুকে ধুক ধুক বানর নাচে। মরাপুকুর পাড়ের গোরস্থানের পাশ দিয়ে উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে মুন্সী বাড়ির বাহির উঠানে দাঁড়িয়ে অন্য কোনো পথিকের আগমনের অপেক্ষায় থাকি। সে বয়সটা যেমন ব্যাকরণের আওতায় পড়ে না তেমনি পড়ে না উপন্যাস কিংবা গল্পের কাঠামোয়। রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পের ফটিক কিংবা অতিথি গল্পের তারাপদ যেমন।

অনেকদিন একা একা ভাবি সত্যিই কী অতো বড় গাছটা বায়ুপথে উড়ে এসে ছয় মাইল দূর থেকে এই পুকুরে,  যার পাড়ে তাকে ঘোরানো হবে সেখানে এসে পড়ে ফি-বছর? গাছঘোরানোর শেষ পর্ব দেখার যোগ্যতা না থাকায় ফিরে আসি সন্ধ্যার আগেই। পিঠে বর্শি গেঁথে জীবন্ত মানুষের চরকির মতো ঘোরা দেখতে দেখতে ঘেমে নেয়ে ওঠার যোগাড় আমার। এর পর জিহ্বায় বর্শি গেঁথে যারা ঘুরতে চায় তাদের প্রস্তুতি নেওয়ার ভঙ্গি ও উৎসাহ আমাকে ভীতবিহ্বল করে। কি এক ঘোরের মধ্যে লাটিম আর মাটির গাড়ি কিনে ফিরে আসি। সেদিনের বৈশাখী মেলার কোনো অর্থ, তাৎপর্য কিছুই ছিল না অবোধ চৈতন্যে। স্মৃতির পিঞ্জরে তারা বন্দি আছে আজও।

বয়সের এই প্রান্তিকে পৌঁছে আজ মনে হচ্ছে সেই গ্রামের ঘন থকথকে অন্ধকার সরিয়ে উড়িয়ে তার কুমারিত্ব হরণ করেছে বৈদ্যুতিক আলো। রাজধানীর চটকা জীবনের সকল ভালোর সঙ্গে অনেক ক্ষতিকারক  মন্দও গ্রামীণ জীবনে পৌঁছে গেছে প্রিয়তম বন্ধুর মতো। জমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় গাঁয়ের খেলার মাঠটিও আজ আর মাঠ নেই। পাড়ায় পাড়ায় আগের মতোই খেলা হয় বটে, তবে সেটা বাঙালির জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু নয়, কিংবা এক কালের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল নয় জুয়াখেলা। শুনেছি রাজধানী শহর থেকে পাকা সড়ক ধরে গাড়ি ভর্তি মাদকদ্রব্যও পৌঁছে গেছে বিশ্বজয়ী বাণিজ্যের কল্যাণে। গ্রামীণ জীবন থেকে খেলা তো গেছেই নাটক, যাত্রা বাউল গান, কবি গান, পালাগান, পুঁথিপাঠ, সঙযাত্রা, লাঠিখেলা এসবও আত্মরক্ষা করতে পারে নি।

তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগ ব্যবসা-বাণিজ্যের জীবনাপেক্ষা মুনাফার গুরুত্ব অধিক। নীতি-নৈতিকতা পুরনো আদর্শ, পরিত্যাজ্য, আবর্জনার তুল্য। চিরায়ত ক্ষমতা আর শক্তিকে অভিন্ন সত্তায় লীন করবার পাঁয়তারা চলছে সর্বত্র। আর ক্ষমতার দাপটে মূল্যবোধকেও পুরনো বলে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হচ্ছে। রসুনের খোসার মতো একদিন ওঠে যাবে তাবৎ পৃথিবী থেকে সমাজকাঠামো, সমাজের নিয়ম-নীতি। আরণ্যক জন্তু জানোয়ারের মতো স্বাধীন মানুষ ক্ষমতার নখে নখে ছিঁড়ে খাবে দুর্বলের হৃদপিণ্ড।

মাৎস্যন্যায় মাঠের সবুজ ঘাসের মতো গজাচ্ছে পৃথিবীর দেশে দেশে। বৈশাখের সুশোভিত মঙ্গলযাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে গোটা দেশ, সে’ দিন তিনিও আসবেন, খাবেন মঙ্গলযাত্রা শেষে বহুমূল্য পান্তা ইলিশ, নাগরিক উল্লাসে বলবেন: ডেলিশাস। মেলায় যাবেন মেলার অলঙ্কার হিসেবে, জনতার জীবনের সাথে যোগ নেই যে-জীবনের, চর্চা করবেন সেই জীবন। যে-সংস্কৃতি তার শ্রদ্ধেয় এবং যার চর্চায় জীবনপাত করছেন তা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি নয়। তবু খাবো পান্তা ইলিশ, স্বাদ তো মন্দ নয়! ঐ একদিন অন্তত বেসুরো গলায় গাবো ..বৎসরের আবর্জনা ..। লোকদেখানো আমাদের সকল আর্তনাদই যখন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে আমরা কুণ্ঠিত হই বইকিÑ কিন্তু সংশোধিত হই না নিজেরা।

তারপরও বৈশাখ চিরায়ত। আদিম কৃষিজীবী এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে যেমনটা ছিল আজও আছে তেমনি। তা আকবর শাহের বাংলা সন গণনা আরম্ভ করবার জন্যেই কেবল নয়; নয়, বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির জন্য। বৈশাখ চিরন্তন এ জন্যে যে, নেগ্রিটো, আদি-অস্ট্রেলীয়( ভেড্ডিড), মঙ্গোলীয় ইত্যাদি মহাজাতির নানা শাখার মানুষের মিশ্রণে গড়ে ওঠা সমাজের হাজার হাজার বছরের উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির ধারক সে। এই একটি দিন অন্তত সম্মিলিত স্বরে বলা যায় এ বাংলা শুধু মুসলমানের নয়, হিন্দুর নয়, বৌদ্ধের নয়, খ্রিস্টানের নয় সাঁওতাল, মার্মা, চাকমা, গারো, হাজং, খাসি, মণিপুরি, ম্রো, রাখাইন, টিপরা, পাংখোয়া সকলের। ধর্মের, সম্প্রদায়ের, জাতিতাত্তিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে অন্য এক পরিচয়ে আমরা এক, অভিন্ন  সে হলো বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলার সংস্কৃতি। এই জায়গাটি বাঙালির অস্তিত্বের স্মারক, শক্তির কেন্দ্র, ঐক্যের ভিত্তি। যে-পারে দাঁড়াক এসে।

লেখক : অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।