নববর্ষ : শুধু উদযাপনে, নাকি যাপনেও?


প্রকাশিত: ০২:০৪ এএম, ১৪ এপ্রিল ২০১৭

বাংলা নববর্ষের সূচনা নিয়ে বিস্তার আলোচনা, বিতর্ক হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মুঘল বাদশাহ আকবরের হাতেই বঙ্গাব্দের প্রবর্তন হয়েছে বলে ধারণাটিই সবাই মেনে নিয়েছেন। বাদশাহ আকবর ধর্মের যেমন সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলেন দীন-ই-ইলাহি প্রবর্তন করে তেমনি ইলাহি সন প্রবর্তন করে সব ধর্মের মানুষের জন্যে একটিই ক্যালেন্ডার চালু করার চেষ্টাও করেছিলেন। তাঁর দুটি প্রয়াসই মানুষকে তেমন টানতে পারে নি। তবে বাংলার কৃষিপ্রধান জীবনধারার সাথে সঙ্গতি রেখে নতুন দিনপঞ্জির প্রয়োজনীয়তাও তাঁরই প্রশাসনিক ও রাজস্ব ব্যবস্থা থেকে আসে। আকবরের ঘনিষ্ঠ জ্যোতির্বিদ ফতেহ উল্লাহ সিরাজী এটি তৈরি করেন। তখন নাম ছিল সন-ই-বাঙ্গালা। পরে ধীরে ধীরে এটি বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ নামেই পরিচিতি পায়।

বাংলার জীবনব্যবস্থায় কৃষিকাজে প্রয়োজন ছিল সৌর বর্ষপঞ্জির, লৌকিক জীবনে, বিশেষত হিন্দু ধর্মীয় আচারে-পূজায় ব্যবহৃত হত তিথি-নক্ষত্রের ভিত্তিতে রচিত পঞ্জিকা। দুটির মিশ্রণে তৈরি বাংলা ক্যালেন্ডারে নববর্ষের যেমন স্থিরতা ছিল না তেমনি তিথি, নক্ষত্রের হিসাবও ছিল পরিবর্তনসাপেক্ষ। এদেশে বাংলা ক্যালেন্ডারের সংস্কার সাধন করে নববর্ষসহ মাসের হিসেব গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মত নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলেও ততদিনে প্রশাসনিক ব্যবস্থাসহ জনজীবনে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ব্যবহার পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। জানা দরকার, সংস্কারের কাজটি বাংলা একাডেমির উদ্যোগে সেই ষাটের দশকে শুরু হলেও সরকারিভাবে নির্দেশনা আসে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে।

প্রাচীন রীতির ধারাবাহিকতায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন সীমাবদ্ধ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে যেমন দোকানদারি, তেজারতি, সওদাগরি ইত্যাদিতে হালখাতায়, জমিদারদের পুণ্যাহতে এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে চৈত্র-বৈশাখের গ্রামীণ মেলা ও তাকে ঘিরে কিছু অনুষ্ঠানে। এগুলো কৃষিসমাজের কিছু নিদর্শন হিসেবে দিনে দিনে উপেক্ষিত হয়ে অবক্ষয়ের মুখে পড়েছে। ইদানীং বাজার অর্থনীতির কল্যাণে এগুলোর প্রতি শহুরে ও গ্রামীণ উভয় সমাজেরই আগ্রহ বেড়েছে। ফলে মেলা ও লোকসংস্কৃতির কলেবর এখন যেন বাড়ছে।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছয়দফাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির এক যুগান্তকারী ঐক্য ও জাগরণের সূচনা হয়েছিল। এর অন্তর্নিহিত তাগিদ ছিল অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী চেতনায় সমাজ ও দেশগড়ার দিকে। সেদিন নাগরিক সমাজ হিন্দু-মুসলমানে ভেদাভেদ করেনি। এ যেন ছিল সাতচল্লিশের ধর্মসাম্প্রদায়িক বিভেদ-চেতনার বিরুদ্ধে বাঙালির চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার উপযুক্ত প্রত্যুত্তর।

এ সময় আমাদের সামাজিক জীবনে ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন উৎসবের আকাঙ্খাও জোরদার হয়ে ওঠে। পহেলা বৈশাখ ছায়ানটের প্রভাতী সঙ্গীতানুষ্ঠান নববর্ষ উদযাপনকে ধারাবাহিকতা ও সুনির্দিষ্ট রূপ দিয়েছে। উৎসবের তাগিদ ও এতে অংশীদার হওয়ার আকাঙ্খা ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করেছে। উৎসবের ধর্মই হল মিলন, মানুষে মানুষে মিলন। ক্রমে প্রভাতী অনুষ্ঠানের আয়োজন সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে, আজ অধিকাংশ শহরে একাধিক আয়োজন হচ্ছে, অনেক জায়গায় বর্ষবিদায় ও বরণের দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠান ও উৎসব হচ্ছে, ইদানীং অনেক জেলায় মঙ্গলশোভাযাত্রাও হচ্ছে, কোথাও কোথাও এইসঙ্গে থাকছে প্রভাতফেরী, কেউ যোগ করছেন মেলা ও স্থানীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, যেমন বলিখেলা বা নৌকা বাইচ। বাংলা নববর্ষ এভাবে আজ বাংলাদেশের এবং বাঙালির সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব।

বাংলা নববর্ষ দেশের প্রধান সামাজিক উৎসবে পরিণত হলেও বাংলা ক্যালেন্ডারের সাথে মানুষের সংশ্রব ক্রমেই কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় দাপ্তরিক কাজে যদিও ইংরেজির সাথে বাংলা তারিখ ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং বাংলা তারিখকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় তবুও এর ব্যবহার তাতে নিশ্চিত করা যায় নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষি আগের মত আর প্রকৃতির খামখেয়ালের ওপর নির্ভরশীল মৌসুমী খাত নয়; তিন ফসলা চাষের এ যুগে কৃষকের পরিকল্পনায় তিথি-নক্ষত্রের ভূমিকার চেয়ে অর্থসহ আরো জাগতিক উপাদানের কদর অনেক বেড়েছে। তাছাড়া শিক্ষার বিস্তার এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আওতা সবার জীবনে ছড়িয়ে পড়ায় গ্রামীণ সমাজেও ইংরেজি ক্যালেন্ডারের প্রভাব এড়িয়ে চলা আর সম্ভব নয়। এরই পাশাপাশি  নববর্ষে উৎসবের আমেজে সবার মন নেচে উঠছে, এছাড়া মানুষের আর্থিক সামর্থ্য আগের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় এতে অংশগ্রহণ, এর জৌলুস বাড়ানোর প্রবণতাও বেড়েছে। তাই আজকাল সর্বস্তরের সব ধর্ম-গোত্রের নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধকেও নববর্ষে রাজপথে, অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে শরিক হতে দেখা যায়। তাতে কিন্তু বাংলা বর্ষ পঞ্জিকার ব্যবহার একটুও বাড়ছে না।

একটু হয়ত ভাবা যেতে পারে, বোধহয় ভাবাই উচিত, জাতীয় জীবনে বাংলা ক্যালেন্ডার চালু করা কি কোনোভাবে সম্ভব নয়? বোধহয় অসম্ভবও নয়। আমরা দেখি ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের প্রথম পর্যায়ে পঞ্জিকা অনুযায়ী তিথির ভিত্তিতে স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটি ধার্য হচ্ছিল। কিন্তু তার ফলে ছুটির দিনের কোনো স্থিরতা থাকত না। এদেশে আধুনিক শিক্ষার প্রবাদপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংস্কারকের মন কেবল ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ভাষা, সাহিত্য, এমনকি ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনেও কাজ করেছে। তিনিই পঞ্জিকার প্রভাব এড়িয়ে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের নিয়মে নির্ধারিত দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি প্রবর্তন করেন।

চারটি কাজ করলে ইংরেজি ক্যালেন্ডারকে ছাপিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জির গুরুত্ব জনজীবনেও বাড়বে বলে মনে হয়- ১. সরকারি দপ্তরের মত বেসরকারি অফিসসহ সব কাজে বাংলা তারিখের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে, ২. শিক্ষাবর্ষ বৈশাখ-চৈত্র করা যায়, ৩. একইভাবে সরকারের অর্থবর্ষও বৈশাখ-চৈত্র হতে পারে এবং ৪. সরকারি বেসরকারি সকল ক্ষেত্রে কর্মীদের বেতন-ভাতা বাংলা মাস অনুযায়ী প্রদান করতে হবে। এ ছাড়া সব চাকুরিতেই নববর্ষ উপলক্ষে উৎসব বোনাস চালু করলে বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসরণে উৎসাহ বাড়বে।

বর্তমানে মানুষ কেবল বৈশাখের প্রথম দিনে অর্থাৎ ১৪ই এপ্রিল সরকারি ছুটির দিনটিতে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূত্রে বাংলা বর্ষপঞ্জির কথা মনে রাখছে, সারা বছর কিন্তু এ বিষয়ে মানুষ একেবারেই উদাসীন থাকে। বছরের অন্য সময়ে মাস, তারিখ বা বাংলা সন সম্পর্কে কেউই প্রায় ঠিকভাবে বলতে পারেন না। এমনও দেখা গেছে নববর্ষ উদযাপনে ব্যস্ত মানুষটিও নতুন সনটি নির্দিষ্টভাবে বলতে পারেন না। এ আমাদের এক মজ্জাগত জাতীয় দুর্বলতা। একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে দারুণ আবেগ ও উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে, সেই সাথে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত নিয়েও আবেগের কমতি নেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ক্রমেই তো বাংলার চর্চা কমছে, বাংলায় দুর্বল থেকে ইংরেজিমাধ্যমে লেখাপড়ার ঝোঁক বাড়ছে, দিনে  দিনে শিক্ষিত বাঙালির জীবনে বাংলাভাষার মূল্য ও কদর কমে যাচ্ছে। ভাষা তো চর্চার বিষয়, ভাষার প্রতি ভালোবাসার যথার্থ প্রকাশ ঘটতে পারে আন্তরিকভাবে তা চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু সে বিষয়ে আমরা আন্তরিক নই। আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যাঁরা পুরোধা ব্যক্তি, যাঁরা সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদেরও নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলাচর্চার ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ভাষার মত বাংলা নববর্ষের ক্ষেত্রেও এই একটি উপলক্ষকে ঘিরে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আবেগপূর্ণ উচ্ছ্বাস যাঁরা প্রকাশ করেন তাঁদের মধ্যে এই বর্ষপঞ্জি ব্যবহারের কোনো রেওয়াজ তো নেই, তাগিদ নেই, আগ্রহও নেই। শূন্যের মাঝারে মরমি ভাবের সৌধ গড়া যায়, বাস্তবে যার অস্তিত্ব আছে, যার ব্যবহারিক মূল্য গুরুত্বপূর্ণ এবং যা অনুশীলনের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে ও এগিয়ে নিতে হয় তার অস্তিত্ব কেবল আবেগ ও ভাবালুতা দিয়ে রক্ষা করা মুশকিল। সময় থাকতে বাঙালিকে, বাংলাভাষাভাষী মানুষের দেশ বাংলাদেশকেই বরং, সবার আগে এ নিয়ে ভাবতে হবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, সমাজচিন্তাবিদ।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।