বেগম জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাটি কবে দেবেন?


প্রকাশিত: ০৬:০২ এএম, ১০ এপ্রিল ২০১৭

আজকের এই লেখাটি একটি বিক্রি হয়ে যাওয়া দেশে বসে লিখছি!
দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গত দু’দিন যাবত আবারও বলছেন যে, দেশটা বিক্রি হয়ে গেছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটা ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়ে আগামি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট পেয়েছেন। দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা যখন দেশ বিক্রি করার কথা বলেন তখন আমাদের মনে কিছু বিষয় নিয়ে সংশয় তৈরি হয়।

এক. একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ আসলে বিক্রি করা যায়?
দুই. দেশটা বিক্রি হলো কতো টাকার বিনিময়ে?
তিন. কতোবার দেশ বিক্রি করা যায়? কারণ তিনি বহুদিন ধরেই বহুবারই দেশ বিক্রি হয়ে গেছে বলে বক্তব্য দিচ্ছেন। তার মানে হচ্ছে শেখ হাসিনা ও তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার বারই একটি দেশকে বিক্রি করে দিতে পারছেন, অর্থাৎ দেশ-ব্যবসায়ী হিসেবে তারা বেশ সফল বলতেই হবে।
চার. যেহেতু দেশটি বিক্রি হয়ে গেছে আগেই তাহলে বিক্রি হয়ে যাওয়া দেশে বেগম জিয়া কী করে আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন? বিরোধী দলীয় নেত্রীই বা কী করে ছিলেন? এখনই বা তিনি এবং তার দল কী করে এই বিক্রি হয়ে যাওয়া দেশে রাজনীতি করছেন?
পাঁচ. যেহেতু দেশটি বিক্রি হয়েই গেছে সেহেতু তিনি এই বিক্রি হয়ে যাওয়া দেশকে স্বাধীন করার জন্য তার স্বামী জেনারেল জিয়ার ঘোষণা পাঠের মতো কবে আবার স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন?

ওপরের এই প্রশ্নগুলো একটিও আমার নিজস্ব নয়। সোস্যাল মিডিয়া তথা ফেসবুকে বিভিন্নজন এসব প্রশ্ন গত দু’দিন ধরে উচ্চারণ করছেন। এমনকি বেগম জিয়ার বক্তব্যকে উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করে গণমাধ্যম যে সব সংবাদ পরিবেশন করেছে তার নিচেও সাধারণ পাঠকের মন্তব্য থেকে এসব প্রশ্ন আমি গ্রহণ করেছি। সুতরাং, পাবলিক ডোমেইনকে এসব নিয়ে প্রশ্ন যেহেতু আলোচনায় আসছেই সেহেতু এসব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া জরুরি। কারণ, বার বার একটি দেশ বলা নেই কওয়া বিক্রি হয়ে যাবে, একই পক্ষ বার বার দেশটিকে বিক্রি করবে আবার আরেকটি পক্ষ বার বার দেশটিকে বোকার মতো কিনবে বিষয়টা কেমন ঘোলাটে হয়ে ওঠে, নয়?

প্রথমেই আমরা এ প্রশ্নটি নিয়ে একটু কথা বলি যে, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র কি আসলে বিক্রি করা যায়? এ পর্যন্ত কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কি বিক্রি হয়েছে বলে আমরা জানি? গুগুল নামক সার্চ ইঞ্জিনে এরকম একটি প্রশ্ন লিখে যদি আমরা খোঁজার চেষ্টা করি তাহলে দেখতে পাই যে, এরকম কোনো প্রশ্ন সম্পর্কেই গুগুলের জানা নেই প্রায়। অথচ, গুগুল নাকি যে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেয়। তবে হ্যাঁ, আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে গোষ্ঠীপতিরা একটি গ্রাম বা এলাকা আরেক গোষ্ঠীপতির কাছে বিক্রি করেন বটে, কিন্তু আমরাতো সে যুগ পেরিয়ে এসেছি বহু আগেই। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টির মূল তিনটি উপকরণ হচ্ছে: একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড, জনগণ এবং একটি সরকার। আরেকটি বিষয় এখানে জরুরি, তাহলো, অন্য দেশের স্বীকৃতি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির এর সবই আছে, ১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছে, ৭ কোটি বা তারও বেশি জনগণ পেয়েছে, পেয়েছে একটি নির্বাচিত সরকার (৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া) এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশ লাভ করেছে বিশ্বের সকল দেশের স্বীকৃতি।

সৌদি আরব ও চীনের মতো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকার করেনি সে সময় কিন্তু পরবর্তীতে তারাও দিয়েছে যখন তাদের পেয়ারের ‘ডিক্টেটর’ ক্ষমতায় বসেছে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে তাদের পছন্দ নয়, কারণ তারা সে ধরনের কোনো সরকার-ব্যবস্থার সঙ্গে ঠিক পরিচিত নয়। এখন বলুন, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৪৫ পার হবার পরও কী করে সে দেশেরই একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশটাকে বিক্রি করে দেওয়ার ধুয়া তুলতে পারেন? একটু আগেই বলেছি যে, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকে বিক্রি করার কোনো উদাহরণ এখনও নেই কোথাও। এমনকি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতনের পর কোনো দেশকে সম্পূর্ণভাবে কলোনি বা ঊপনিবেশ হিসেবে ব্যবহারের উদাহরণও একবিংশ শতাব্দীতে ঠিক পাওয়া যাবে না। যদি না দেশটিকে যুদ্ধের মাধ্যমে দখল করা হয়ে থাকে, যেমনটি মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে হয়েছে। সুখের কথা হলো, বাংলাদেশ এখনও অবধি সেরকম কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হয়নি। পাঠককে এই ‘এখনও’ শব্দটি মনে রাখার জন্য অনুরোধ করবো।

এদেশের রাজনীতিতে দেশ বিক্রির ধুয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। এর আগেও বিশেষ করে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর, সীমান্ত চুক্তি হওয়ার পর এবং কারণে ও অ-কারণে তিনি ও তার দল বার বারই বলেছেন যে, বাংলাদেশ ভারতের দখলে চলে গেছে। ফেনি পর্যন্ত ভারত হয়ে যাওয়ার গল্পটি তিনি বার বার ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনার অভিযোগ করেছেন, আজান নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো চরম ও নিন্দনীয় সাম্প্রদায়িক বক্তব্য রেখেছেন, সে জন্য তাকে কেউ কখনও প্রশ্ন করেছে বলে জানা নেই, বিশেষ করে দেশের সুশীল সমাজের সেই অংশটি তার কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা দাবি করেননি, যারা নিজেদের মনে করেন অসাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল। যে দায় ও দায়িত্ব নিয়ে তারা আজকে একটি বিদেশি সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করছেন যে, ভারতের সঙ্গে হওয়া চুক্তিগুলি জনসম্মখে প্রকাশ করতে হবে। তারা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন, সংসদের দায় ও দায়িত্ব নিয়ে কথা বলেন, হঠাৎ করে তারা ভারতের সঙ্গে হওয়া চুক্তি নিয়েও কথা বলবেন সেটা আসলে ধারণার বাইরে ছিল, কারণ এই সংস্থাটি কোনো দেশেই এরকম চুক্তি বিষয়ে কথা বলে না সাধারণতঃ।

মজার ব্যাপার হলো, ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বেগম জিয়া যখন চীনের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি করে আসেন সে বিষয়ে আমাদের কারোরই কোনো হুঁশ ছিল না, এবং এই সংস্থাটি তখন অন্য অনেক ব্যাপারে সরব থাকলেও এই চুক্তি বিষয়ে মুখে ছিপি এঁটে ছিলেন বলে আমরা জানি। এই সিলেক্টিভ অবস্থানের জন্য যে এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি এদেশে তাদের মুখ হারাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু আমরা এর সঙ্গে জড়িত সুশীল ব্যক্তিদের কাছে এ প্রশ্নটি করতেই পারি যে, তারাও কি মনে করেন যে, শেখ হাসিনা দেশটিকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়ে এসেছেন কি না? আগেই বলেছি, দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে এরকম নগ্নভাবে ব্যবহারের বিষয়ে তারা কিন্তু কোনোদিন কোনো শব্দ ব্যবহার করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফর নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিষয়টি ফলাও করে আলোচিত হয়েছে। এই আলোচনার মূল কারণ আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা। বিশেষ করে অর্থনীতিতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কারণে সকলেই মনে করছেন যে, শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণে। যতোদূর জানা যায় এরপর শেখ হাসিনা চীন সফর করবেন এবং সেটিও হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সফর। এর আগে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেছেন, সফর করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। উভয় পক্ষই বাংলাদেশকে তাদের সঙ্গে রাখার জন্য নানারকম প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। এই সাথে রাখা কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক এবং পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। যে কোনো বুদ্ধিমান মানুষই দু’পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ যা কিছু আদায় সম্ভব সেটিই করবেন। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে চিরশত্রু বলে কিছুই নেই, নেই চিরবন্ধুত্বও। ফলে সম্পর্কের টানাপড়েন হতেই পারে, হয়ও। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উঠতি দেশের পক্ষে কোনো দেশকেই শত্রু বানিয়ে খুব বেশিদূর এগোনো সম্ভব নয়।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শেখ হাসিনার সরকার এই সত্যটি উপলব্ধি করেছেন এবং সকলের সঙ্গে বিশেষ করে চীন ও ভারতের সঙ্গে একটি ‘ব্যালেন্সড ডিপ্লোমেসি’র মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এতে কী ভাবে দেশটি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট করে আমাদের জানার প্রয়োজন রয়েছে আর সেটি আসা উচিত তাদেরই কাছ থেকে যারা এই অভিযোগটি তুলেছেন। যদিও জানি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরকম ব্যাখ্যা দেওয়ার ঘটনা বিরল এবং এবারও হয়তো এরকম ধোয়াশার ভেতর দিয়েই আমাদেরকে যেতে হবে। আশাকরি, সরকার এবারের ভারত সফর ও স্বাক্ষরিত চুক্তি বিষয়ে জনগণকে বিশদ জানাবে, নাহলে দেশ বিক্রির অভিযোগটি আমাদের সামনে জ্বলজ্বল করতেই থাকবে দীর্ঘদিন।

শেষ করতে চাই সেই ‘এখনও’ শব্দটির ব্যাখ্যা দিয়ে। আগেই বলেছি যে, বাংলাদেশ ‘এখনও’ মধ্যপ্রাচ্য নয় তাই এদেশ বিক্রি বা দখল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এখনও শূন্য। কিন্তু বেগম জিয়ার মতো দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদের মুখ থেকে যখন দেশ বিক্রি হয়ে যাওয়ার অভিযোগ আসে তখন আসলে ভয় লাগে যে, সামনে কি কোনো ভয়াবহ দুঃসময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে? দেশ বিক্রি হয়ে গেলেতো আমরা আবার পরাধীন হয়ে গেলাম, এবারও নিশ্চয়ই বেগম জিয়া তার স্বামী জেনারেল জিয়ার ঘোষণা পাঠের মতো একটি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন, সে অপেক্ষা আমাদের করতেই হচ্ছে আপাতত। কিন্তু, ভয়টা অন্যখানে, সেটা হলো, বেগম জিয়ার দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলনে আমরা দেখেছি মানুষকে পুড়ে মরতে, দেদারছে দেশের সম্পদ নষ্ট হতে, এবারকার স্বাধীনতার ঘোষণায় বেগম জিয়া কার অনিষ্ট করবেন আর, মানুষ ছাড়া?

ঢাকা ১০ এপ্রিল, সোমবার ২০১৭

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।