তোমার পতাকা যারে দাও


প্রকাশিত: ০৪:০৭ এএম, ০৯ এপ্রিল ২০১৭

দীর্ঘ দিন পরে লোকাল বাসে উঠলাম। ধাক্কা খেতে খেতে বসার একটা সিট পেলাম। মেয়ে মানুষ হবার জন্য পাশের পুরুষ মানুষেরা সিট ছেড়ে দিলেন। ভীষণ কৃতজ্ঞ হয়ে বসে পড়লাম। লোকাল বাসটি চলতে শুরু করলো। হঠাৎ বাসে উঠলো এক বৃদ্ধ। আনুমানিক ৬৫-৭০ বছরের। বাজারের সবচেয়ে কমদামী কাপড়ের পাঞ্জাবি ছিল তাঁর গায়ে। সাদা পায়জামা। হাল্কা দাড়ি। ছোট চুল। হাতে শিক্ষকের ব্যাগ। পুরো চেহারা জুড়ে ভীষণ পবিত্রতা। আর বিনয়ের ছোঁয়া।

কে যেন পেছনের সিট থেকে বলে উঠলো, “আঙ্কেল ধাক্কা লেগে পড়ে যাবেন। পেছনে চলে আসেন। একটা সিট আছে।” কিন্তু মানুষ জনের ভিড়ে তিনি পেছনে যেতে পারলেন না। সামনের সারিতে সিটের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আর বলে উঠলেন, “আমি বুড়ো মানুষ নইরে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ঐ পাক সেনাদের পরাজিত করেছি। দেহের জোর কমতে পারে কিন্তু মনের জোর এখনো কমে যায়নি। তোমাদের ভয় পাবার কিছু নাই। আমি পড়ে যাবো না।”

এতো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বললেন যে, মুহূর্তেই যেন পুরো বাসে নীরবতা নেমে এলো। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। জানতে পেরে সামনের সারিতে বসা এক যুবক জোর করে উনাকে সিট দিলেন। তিনি কতো নম্বর সেক্টরের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, ঠিক শুনতে পেলাম না। কারণ রাস্তায় যানবাহনের ভয়ানক শব্দ। কানে ভেসে আসলো তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।

বললেন, “ছোট্ট বেলা থেকেই রাষ্ট্রকে ভালোবাসতাম। আজও ভালোবাসি। আর মৃত্যুর পরেও ভালোবাসবো। এই দুই হাত দিয়ে অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করেছি। আজও যুদ্ধ করেই যাচ্ছি। কিন্তু কিছু খারাপ রাজনীতিবিদদের জন্য এই দেশের মুক্তিযুদ্ধটা এখনো চলছেই।”  তাঁর পাশে বসা অপর এক যুবককে বললেন, “শোনো, আমরা অনেক কিছু হারিয়ে এই দেশকে পেয়েছি। তোমরা এই দেশটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলো। বাবারে, আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি। তোমরাতো যুবক মানুষ। তোমাদের বুকে তাজা রক্ত।”

অদ্ভুত সুন্দর বক্তা তিনি। রাস্তার ভয়ানক শব্দের মধ্যেও তাঁর পাশের সবাই মনোযোগ দিয়ে উনার কথা শুনছিলেন। গরম, রাস্তার শব্দ আর বাসের ঝাঁকুনির মধ্যেও উনার চেহারা জুড়ে ছিল পবিত্রতার ছাপ। অবাক হয়ে ভাবলাম। হায়রে দেশ! রাজাকার, ঠকবাজ, বাটপার কিছু শয়তান রাজনীতিবিদেরা নামীদামী ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। আর একজন মুক্তিযোদ্ধা, যে মানুষটা দেশকে ভালোবেসে আপনজনদের তুচ্ছ করে, যুদ্ধে গেছিলো, সেই মানুষকে এই দেশের মানুষেরা কি উপহার দিলো??

এই বৃদ্ধ বয়সে কমদামী এক লোকাল বাসে চলাফেরা করছেন। হাজারটা মানুষের ধাক্কা খেয়ে, বাসের হ্যান্ডেল ধরে, ঝুলে যাতায়াত করছেন। অথচ এই আমাদের মতো মানুষগুলোর একটি পতাকার জন্য তাঁরা (মুক্তিযোদ্ধারা) মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এই সেনা, দেশপ্রেমিক মানুষগুলোর রক্ত, মাংস, অস্থিমজ্জা জুড়ে প্রবল দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেমের টানেই তাঁরা যুদ্ধ করেছেন। আর তাঁদের সেই ত্যাগের জন্যই আমরা স্বাধীন জাতি।

কয়েকদিন পূর্বে একজনের ফেসবুকে দেখলাম, এক বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা রিক্সা চালায়। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কার্ডের জন্য যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছে চল্লিশ হাজার টাকা ঘুষ দিলে তাকে সেই কার্ড দেয়া হবে। তিনি সেই কার্ড পাবার জন্য আর যোগাযোগ করেন নি। এই দেশে অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এখনো অনেকেই অবহেলিত। প্রচণ্ড বঞ্চিত। লোকাল বাসের সেই মুক্তিযোদ্ধার পরণে ছিল বাজারের পলেস্টার (সবচেয়ে কমদামী কাপড়) কাপড়ের পাঞ্জাবি। আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই কার্ড বানিয়ে চাকরি, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজের স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। আর বঞ্চিত হচ্ছেন, এই ধরনের মহান ও ভালো মানুষেরা। যা কখনোই কাম্য নয়।

এই বিষয়ে  সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কেউ যেন মুক্তিযোদ্ধা কার্ড না পায়, এই জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অনেক বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর সেই সাথে গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাদের দায়িত্ব হওয়া উচিৎ, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার-পরিজন কেমন আছেন, কি অবস্থায় আছেন, তা খুঁজে বের করা।

মিডিয়ার কল্যাণে সেই মহান মানুষগুলোর আত্মত্যাগের এক বিন্দু ঋণ শোধ করাটা আমাদেরই দায়িত্ব। খুব ইচ্ছে ছিল, সেই মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নেয়ার। কিন্তু একটা স্টপেজে গাড়ি থামতেই, তিনি ঝড়ের বেগে নেমে গেলেন। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, আঙ্কেল। তিনি শুনতে পেলেন না। খুব ইচ্ছে ছিল, এই মহান মানুষটাকে নিয়ে কিছু লেখার, কিন্তু আফসোস, আমি উনার নামটা পর্যন্ত জানতে ভুলে গেলাম।

মহান সেই মুক্তিযোদ্ধাকে হাজারো সালাম। আঙ্কেল, আপনাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি পতাকা, নিজেদের মানচিত্র। এখন এই পতাকা আর মানচিত্রের সম্মান বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদেরই কাঁধে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সবাইকে আমাদর লক্ষ কোটি সালাম। ভয়ানক ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই দেশটাকে ভালোবাসার দায়িত্ব আমার, আপনার আর আমাদের সবার।

“আমাদের দেশ,
আমাদের মাটি,
তোমার জন্য
ভালোবাসা খাঁটি”

লেখক : চিকিৎসক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।