উষ্ণতার জন্য


প্রকাশিত: ০৪:০৬ এএম, ০৮ এপ্রিল ২০১৭

২০০২ সালে চীনের সাথে একটি পূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিল সে সময়ে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার। জাতি তার কিছুই জানতে পারেনি। সংসদে কোন আলোচনা হয়নি, গণমাধ্যমও ছিল অন্ধকারে। সেই চুক্তির ধরন ছিল অনেকটা চীনের সাথে পাকিস্তানের সামরিক চুক্তির মতোই। এই যখন বাস্তবতা, তখন প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে যথেষ্ট চিৎকার হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ কল্পিত প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে। এ লেখা যখন লিখছি, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে অবস্থান করছেন।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এ মুহূর্তে যে উচ্চতায় অবস্থান করছে তা অতীতে কখনো ছিল না। সবচেয়ে নিকট দুই প্রতিবেশির সম্পর্ক যতটা নিবিড় হতে পারে, সে চেষ্টা করছে দুই দেশ।  নিরাপত্তা, যোগাযোগ, জ্বালানি, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার উষ্ণ মনোভাব লক্ষণীয়। এই উচ্চতা এমনিতেই আসেনি, অর্জন করতে হয়েছে। এবং এটি হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় এবং ভারতীয় নেতৃত্বের প্রচেষ্টায়। যার কারণে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়, ছিটমহল সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়।

যারা এই চুক্তিকে গোলামীর চুক্তি বলেছিল, তারা সমাধানের চেষ্টা না করে একে পুঁজি করে রাজনীতি করেছে কেবল, যেমন এখন রাজনীতি করছে তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে। এবং একথা সত্য যে, এই চুক্তিও শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব হবে অচিরেই। যেসব দল সমালোচনা করছে তাদের একমাত্র রাজনৈতিক পুঁজি ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট উসকে দেয়া।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ভারত সফরের সময় সহযোগিতার যে নতুন মাত্রার বার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন, তার অনুসরণ করেছেন সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং করে চলেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সাত বছরের বেশি সময় পরে শেখ হাসিনা এখন আবার দিল্লি সফরে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দায়িত্ব গ্রহণের পর এটা হবে ভারতে শেখ হাসিনার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। আর নতুন বাস্তবতায় নিশ্চয়ই দুটি নিকট প্রতিবেশি দেশের সম্পর্ক আরো নতুন উচ্চতার সন্ধান করবে। বেশ কিছু পুরোনো ইস্যুর সুরাহার পথ খুলবে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বড় জায়গা জুড়ে আছে অর্থনৈতিক সহযোগিতা। গত আট বছরে এর মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। ভারতে বাজারে বাংলাদেশের পণ্য এখন যেভাবে যাচ্ছে তা আগে কখনো হয়নি। কিন্তু বেশি সরব আলোচনা হচ্ছে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতা নিয়ে। দুই দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলো একই। দুই দেশকেই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আর এখানেই নিরাপত্তা, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও সহযোগিতার প্রয়োজন।

চীনের সাথে চুক্তি হলে সমস্যা নেই, ভারতের সাথে হলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে? এমন মানসিকতা দেশপ্রেমমূলক নয়। কারণ যারা এসব বলে তারা হয়তো দেখতে চায়, জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হোক বাংলাদেশ। এমনিতে বলার সময় বলবে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশিসুলভ, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই, কিন্তু রাজনীতি হবে শুধু সেই বিরোধী সেন্টিমেন্ট বিক্রি করে।

অনেকেই বলছে, ভারতের সাথে যেকোন ধরনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে সন্দেহের চোখে দেখবে চীন। কিন্তু সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান (যিনি ভারতেও একসময় রাষ্ট্রদূত ছিলেন) সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “চীনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বুঝেছি যে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে তাদের অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং পরিপক্ব বোঝাপড়া রয়েছে। আমার অনুভব হলো, বাংলাদেশ ও ভারতের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে চীন স্বাগত জানায়। চীন বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক শক্তিশালী হলে তার পক্ষে ভারত ও চীনকে কাছাকাছি আনা বা ত্রিদেশীয় সহযোগিতার ভিত্তি জোরালো করতে তার নেওয়া যেকোনো উদ্যোগের প্রতি ভারতের পক্ষে ইতিবাচক মনোভাব দেখানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়”।

ভারতের দিক থেকেও নিশ্চয়ই একই বাস্তবতা অনভূত। চীন-ভারত সম্পর্ক, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক আলাদা ধরনের। বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরের সঙ্গে দীর্ঘতম সীমান্তরেখার অংশীদার। তাই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিক থেকে ভারত ও চীনের তুলনা হতে পারে। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই কোন একক বাজারের উপর নির্ভর না করে এর বহুমুখিকরণ জাতীয় স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের একটি আধুনিক সেনাবাহিনী প্রয়োজন। বাংলাদেশ বন্ধু প্রতিবেশি হিসেবে ভারতের নিরাপত্তার প্রতি কোনো হুমকি হতে চায় না। যখন দুই দেশের নিরাপত্তাগত সম্পর্ক চমৎকার, তখন সহযোগিতার সব ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও আস্থা নির্মাণ করা প্রয়োজন। তাই সামরিক খাতেও এই সম্পর্ক উষ্ণ হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিতকালে সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, ভারত বিরোধী বিচ্ছিন্নবাদি ও সন্ত্রাসি গোষ্ঠি কোনঠাসা হয়ে রয়েছে দীর্ঘকাল। এখন ভারতের দিক থেকেও সাড়া দেয়ার পালা। সীমান্ত হত্যা শূন্যতে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে আগ্রহী বাংলাদেশ। তবে এটাও সত্য যে সীমান্তে নানা ধরনের চোরাচালান হয় এবং এর মধ্যে অস্ত্র চোরাচালানও রয়েছে।

জঙ্গিরাও এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বা সেগুলো তাদের হাতে চলে যায়। ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে সচেতন থাকতে হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠি নিয়ে। তাই নিরাপত্তার স্বার্থেই সীমান্তে কড়া নজরদারি ও সতর্কতা প্রয়োজন। সীমান্তে অনাকাঙ্খিত হতাহতের ঘটনা কমতে পারে কেবল মাত্র কেবল দুই সীমান্ত বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায়। একইভাবে ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের মনোভাবকে অনুধাবন করতে হবে, আরো বেশি  সংবেদনশীল হতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে অগ্রাধিকার তিস্তা চুক্তি। এদেশ তিস্তা পানি চুক্তি সইয়ের অপেক্ষায় আছে। নিশ্চয় দ্রুততার সাথে সে পথে অগ্রসর হবে ভারত।

দুই দেশের নাগরিক সমাজের যোগাযোগ সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। দুই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা প্রকল্প চলছে। সাংবাদিকদের মধ্যে যাতায়াত বেড়েছে। সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ছে। নাগরিক সমাজের এমন যোগাযোগই ভাল কিছুর জন্ম দিতে পারে।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।