সংস্কৃতিতে জাপান বনাম বাংলাদেশ


প্রকাশিত: ০৪:০৪ এএম, ০৫ এপ্রিল ২০১৭

আমার গার্লফ্রেন্ড জানো এতো খারাপ!  -কত খারাপ?  -এত্ত খারাপ যে ফোন করলে, দেখা হলে জিজ্ঞেস করেনা যে ভাত খেয়েছি কিনা। একটু থতমত খেয়ে বললাম,  -জরুরি কাজে ফোন করলে বা হঠাৎ সাক্ষাতে ভাত খাবার কথা তো জিজ্ঞেস না করতেই পারে! -আরে! কথা হলে প্রথম প্রশ্নই তো ভাত খেয়েছি কিনা? আমি ততধিক অবাক! -প্রথম প্রশ্ন কিভাবে ভাত খেয়েছ কিনা? প্রথম প্রশ্ন হল কেমন আছ?  কণ্ঠ দ্বিগুণ ঝাঁঝালো করে আমার চাইনিজ কলিগ উত্তর দিল, -কেমন আছ মানে? ভাত খেলেই তো ভাল আছি!  হাসতে হাসতে জান যাবার অবস্থা আমার, কিন্তু কলিগ বুঝতেই পারছে না এই হাসির রহস্য কি। পরে জানলাম এটাই চাইনিজদের প্রথম প্রশ্ন, হ্যালো ( নি হাও ) বলার পরেই।  এর শানে নজুল সম্ভবত ভাতপ্রিয় এই জাতি অনেকদিন ভাতের কষ্ট করেছে, তাই ভাত খেতে পারাই ভাল থাকার প্রতিশব্দ।  এই সূত্রে  আমরা যারা হয়তো কখনোই ভাল থাকিনা বা থাকাটা খুব অনিশ্চিত তাদের প্রথম প্রশ্ন “ভাল আছ?”   আফসোস এই প্রশ্নের উত্তর সাধারণভাবে আমরা মিথ্যাটাই বলি, মানে “আমি ভাল আছি।” কিন্তু ভাত না খেয়ে খেয়েছি বলতে কঠিন মিথ্যা বলতে হয়, সুতরাং চাইনিজদের উত্তর সত্যিটাই হয়।

তো যাই হোক, আমি থাকি জাপানে। কাজেই চাইনিজ আদবকেতা আমাকে রপ্ত করতে হবেনা। কিন্ত জাপানিজ আদবকেতাটা কেমন?  প্রতিবেশির সাথে দেখা একদিন হলো, জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ?  সে সন্দিঘ্ন দৃষ্টিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার সাথে না কালকেই দেখা হলো!”  -হ্যাঁ, তো?  -কালকেই তো জেনেছ কেমন আছি।  -ওমা, তো আজকে তো খারাপ থাকতে পারো। এক সেকেন্ডের নাই ভরসা!  -না না, এটা কোন প্রশ্ন হলো? কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে অনেকদিন পর দেখা হলে। -কেন ! তাহলে রোজ দেখা হলে খালি “কোন্নিচুয়া” বলে হাঁটা দিব?  - না ! তা কেন? জিজ্ঞেস করবা যে আজকে কত শীত না? আজকের রোদটা কি সুন্দর না?   বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ওঠে, -রোদ, শীত তো আমি দেখতেই পাচ্ছি, ফিল করতেই পারছি, তোমাকে জিজ্ঞেস করবো কেন? তুমি কি weather ডট কম?  বুড়ি বেশ বিরক্ত। এরা অনুভূতি সব চাপা দিতে জানে, কিন্ত বয়স হলে মাঝে মাঝে স্লিপ করে যায়।  বুড়ি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,  - এটাই জাপানিজ আদব। তুমি জাপানিজ ভাষা শেখার ক্লাসে যাবে, টিচার তোমাকে এসব শিখিয়ে দেবে। ঘরে ভাষা শেখার বই পড়ে কিচ্ছু হবেনা। জাপানিজ ভাষা আমাদের সংস্কৃতি দিয়ে তৈরি। একটা অন্যটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন জাপানিজ টিচারই তোমাকে এসব শেখাতে পারবে, হাজারটা বইও পারবে না।

বুঝলাম, এইজন্যই জাপানিজরা বিশ্বাস করে একজন নৃতাত্ত্বিকভাবে জাপানি না হলে কিছুইতেই জাপানি হয় না, উল্টা এ দেশে থেকে সংস্কৃতি নষ্ট করে দেয়।  জাপানি টিচারের কাছে যাবার আগেই রেডিও NHKর বাংলা চ্যানেলে একদিন জাপানি ভাষা শেখার লেসন শুনতে বসলাম।  প্রথম দিনের লেসনঃ ধরো একদিন অফিসে বস তোমার টেবিলে এসে বলল, “ তোমার টেবিলটা একটু গুছিয়ে রাখলে হয় না?  “ তুমি ভাবলে, আচ্ছা ভাল তো কত কিছুতেই হয়, কোনদিন গোছাবো।  কিন্তু আসলে বস তোমাকে যেটা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো , “এই মুহূর্তে টেবিলটা গোছাও নইলে আজ তোমার এই অফিসে শেষ দিন!”  একজন জাপানি এটা ঠিকই বুঝে নেবে কারণ জাপানি বস কাজের বাইরে এমন কথা কখন বলতে পারেন এবং তার ভাবার্থ কি তা জাপানিরাই জানে। কিন্তু আর কেউই তা বুঝতে পারবে না।  কাজেই জাপানি ভাষা শুধু শিখলেই হবে না, এদের সংস্কৃতি জানাটাও পাশাপাশি ততোটাই জরুরি।

এদের বর্ণমালা আমাদের মত অক্ষরভিত্তিক না, একেক শব্দের জন্য একেক ছবি, তার ব্যাখ্যাও বেশ মজার। এভাবে হাজার তিনেক ছবি ভিত্তিক বর্ণমালা “কাঞ্জি” শিখলে তবেই জাপানি ভাষা পড়া যাবে। অতি অতি দুরূহ এক ভাষা! পথে ঘাটে সবাই তো এমনিই দয়ার ও বিনয়ের অবতার, তায় আবার কথায় কথায় প্রশংসা। ধন্যবাদ দেই, কিন্তু কাহাতক! আমার প্রতিবেশি আমেরিকান প্রায় বিশ বছর জাপানে আছে, স্বামী  কিউশ্যু ইউনিভার্সিটিরই জাপানিজ ইতিহাসের শিক্ষক। মহিলা ইংরেজির। আমাকে গল্পে গল্পে বললেন, তুমি প্রশংসা শুনলে থ্যাংকস দাও কেন?  আমি বললাম, “কি বলব? নো থ্যাংকস !”  - আরে না! প্রশংসাটা ফিরিয়ে দিবে। তোমার নিজের তো বটেই এমনকি এমনও যদি বলে যে তোমার বাচ্চা তো খুব কিউট বা স্মার্ট, তুমি জবাব দেবে, `না না ছিঃ ছিঃ একদমই না`, এমন।  দুজনেই একচোট হাসলাম। সে আবারো বলল,  - প্রথম প্রথম আমারো এমন হতো, আর ওরাও মনে মনে খুব অবাক হত এমন নির্লজ্জভাবে প্রশংসাবাক্য স্বীকার করছি দেখে। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।  এখন তো জানাই হয়ে গেছে যে এরা যেমন সবাইকেই প্রশংসা করে, তেমনই প্রশংসার জবাবে “ না  না না !” করতেই হয়, তা আপনি যতই প্রশংসার যোগ্য হোন।

জাপানি জাতির অভিনয় সর্বস্বতা নিয়ে হাঁপিয়ে উঠি, কিন্তু গেল সপ্তাহেই মনে হলো ভাগ্যিস এরা সবাই অভিনয় করে!  দুটো নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি প্রায় ৭/ ৮ মাস। জাপান সরকারের কাছে ফান্ডের জন্য প্রপোজাল জমা দেয়া হল মাত্র! এতো দেরি কখনই হয় না, শুরু থেকেই এতো সম্ভাবনাময় প্রজেক্ট দুটোতে এত গাফিলতি আমার মনে কু-ডাক দিয়ে চলেছে। শেষ মেষ এরা মুখ খুললেন, তাও ইমেইলে।  বাংলাদেশ লেবেল-২ ডেঞ্জার এলার্টের ভেতরে আছে, এই মার্চের ৭ তারিখেও জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন ঘোষণা এসেছে। অতি জরুরি এবং অনিবার্য কারণ ছাড়া বাংলাদেশে যাওয়া যাবে না। এবং এর কারণ হিসেবে হলি আর্টিজান মুখ্য কারণ উল্লেখ থাকলেও ধারাবাহিকভাবে ইতালীর নাগরিক তাবেলা হ্ত্যাকাণ্ড থেকে এখন পর্যন্ত সব ঘটনাই দিনক্ষণের ডিটেইলসহ নথিবদ্ধ।

এর মানে এরা এতদিন ধরে সবাই সব অবগত। শুধু আমাকে টের পেতে দেয়নি! এখন এই মর্মে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যায়নপত্র আনতে হবে যে প্রজেক্টের কাজ চলাকালীন এদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করবো। সম্মত হবার আগে পাঠানো লিংকটা ভালমত নিরীক্ষণ করলাম কিসে কিসে তারা এলার্ট করেছে।  কি নেই? কোন স্থানের ব্যাপারে নেই!  বের হলে দিনের আলোয় হোটেলে ফিরে আসতে হবে, এমনকি জুম্মাবার, রমজান মাস বিশেষ আতংকের তালিকায়। আমাদের ডিরেক্টর যে দুজন কলিগকে ইমেইলের কপিতে রেখেছেন আড়চোখে তাদের দিকে তাকালাম। সবাই স্বাভাবিক, কিছুই হয়নি`র পার্মানেন্ট মুখোশে আচ্ছাদিত।  আমি একা বাংলাদেশি, এই অসহায়ত্ব ভাগাভাগির কাঁধ নাই। এরা আমাদের মত অভদ্র হলে অফিসে আমার কত কিছু শুনতে হতো, কত দুর্ব্যবহার অপদস্তির ভেতরে যেতে হতো। ভাগ্যিস এরা অভিনয় করে! ভাগ্যিস এরা বিনয় ভদ্রতার চিরস্থায়ী মুখোশটা অন্তত সেঁটেই রাখে!

সবসময় বলি, এদের সব আছে শুধু প্রাণ নেই। আমাদের কিছুই নেই, শুধু প্রাণশক্তি অফুরান। রাস্তার পাশে ছোট একটা চায়ের দোকানেও আমাদের প্রাণ আছে। আজ সেই প্রাণশক্তি প্রমাণে আমার দেশে এদের নেবার শক্তি আমার নাই। দেশ অনিরাপদ, আমরা স্বদেশি, প্রতিবেশির খুনের রক্তে লাল। অথচ আমরা ভাতে মাছে বেড়ে ওঠা নিরীহ এক জাতি। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের উপর চেপে এসেছিল। আদতে আমরা যোদ্ধা জাতিও না, সহিংসও না। আচমকা আঘাত বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের যে মহামারীতে আমরাও আক্রান্ত তা মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলি যেখানে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমাদের এখন পর্যন্ত সাফল্যের পতাকা তুলে চলছি, এও এক উদাহরণ যাবতীয় অনিয়ম আর নৈরাজ্যের মাঝে। আমি দেশ থেকে এই মর্মেই তাদের নিরাপত্তার আশ্বস্তপত্র  আনালাম। আমরা অহিংস, আমাদের সংস্কৃতিতে অন্যের ভূমিতে গিয়ে রক্তপাত ঘটানো, অন্যায় যুদ্ধ নেই। দেশ জনসংখ্যায় ভেঙে পড়লেও আমরা বৈধ অভিবাসী-অতিথিকে আজীবন স্বাগত জানাই। তাই আমার দেশে, আমার সংস্কৃতিতে আবারো তোমাদের স্বাগতম।

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।