নির্বাচন আনফেয়ার, ফলাফল ফেয়ার
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘নির্বাচন ফেয়ার, ফলাফল আনফেয়ার’। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পরও মুখ খুলেছেন বাবু সাহেব। এবার বলেছেন ঠিক উল্টোটা, ‘নির্বাচন আনফেয়ার, ফলাফল ফেয়ার’। হা হা হা। শুনে আমার তালগাছের গল্পটা মনে পড়ে গেল। বিচার মানি, তালগাছ আমার। এটা শুধু গয়েশ্বর বা বিএনপির সমস্যা নয়; এটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সবাই শুধু জিততে চায়।
নির্বাচনে যে জয়-পরাজয় দুটিই আছে, এটা আমরা মানতেই চাই না। হেরে গেলেই- আনফেয়ার, কারচুপি, ইঞ্জিনিয়ারিং; নানা অজুহাত সামনে চলে আসে। তবে এখন বিএনপি একটু সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কোনো নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জিতে গেলে তারা বলে, জনরায় তাদের পক্ষে। আর হেরে গেলে বলে, কারচুপি করে জনরায় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে এই সুবিধাটা বিএনপি পুরোপুরি নিতে পারছে না। কখনো তারা নির্বাচনে অংশ নেয়, কখনো নির্বাচনের আগের দিন সরে দাঁড়ায়, কখনো নির্বাচনের মাঝপথে মাঠ ছেড়ে দেয়। গত প্রায় দশ বছর ধরে সরকারের দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা, গুম-খুনে বিএনপি বিপর্যস্ত। কিন্তু এত কিছুর পরেও, বিএনপি এখনও দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল। কিন্তু জনপ্রিয়তাকে ঠিক কাজে লাগাতে পারে না বিএনপি, সেই সাংগঠনিক দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে তাদের।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ঠিক আগে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দারুণ জয় পেলেও, জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি তারা, নির্বাচন ঠেকাতেও পারেনি। ফলে আওয়ামী লীগ তাদের ইচ্ছামত দেশ শাসন করার সুযোগ পেয়ে যায়। বিএনপি এখন সংসদে নেই, রাজপথেও নেই। এখন বিএনপি যতই চিৎকার করুক, আওয়ামী লীগ বৈধভাবেই ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করতে পারছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়া যে ভুল ছিল, তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও, এরপর থেকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। দেরিতে হলেও বিএনপি বুঝতে পেরেছে, তাদের মাঠে থাকার, টিকে থাকার একমাত্র উপায় নির্বাচন। বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, এটি একটি নির্বাচনমুখী, ক্ষমতামুখী দল। দল ধরে রাখতে হলে, কর্মীদের চাঙা রাখতে হলে; যে কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিতে হবে, মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। পেট্রলবোমার আন্দোলন দিয়ে, সরকার হটানো যাবে না, জনগণের কাছেও যাওয়া যাবে না।
নির্বাচন ভালো হোক, মন্দ হোক; বিএনপির স্বভাব হলো, দিনভর কারচুপির অভিযোগ করা। সব নির্বাচনেই রিজভী আহমেদের একই বক্তব্য, যেন ভাঙা রেকর্ড। কুমিল্লায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দিনভর কারচুপি করলো আওয়ামী লীগ, রাতে জিতলোও তাদের প্রার্থী। তাহলে কারচুপিটা করলো কে? বিএনপি নেতারা বলছেন, কারচুপি হয়েছে। এর বিরুদ্ধেই তাদের প্রার্থীকে লড়াই করে জিততে হয়েছে। কারচুপি না হলে ব্যবধান আরো অনেক বেশি। তবে বাস্তবতা হলো সরকার যদি কারচুপি করতে চাইতোই তাহলে বিএনপির সাধ্য ছিল না তা ঠেকানোর।
কুমিল্লায় বিএনপি জিতেছে, আওয়ামী লীগ হেরেছে; তবে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে নির্বাচন কমিশনের। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা ছিল কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন। এই পরীক্ষায় তারা জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেছে। নির্বাচনের মাঠে কমিশন যথেষ্ট শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। এমনকি নির্বাচনের দুদিন আগে এইচটি ইমাম বলেছেন, নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করছে। একই সুর পরাজিত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার কণ্ঠেও। পরাজয়ের পর তিনি বলেছেন, নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন তার প্রতি বিরূপ আচরণ করেছে। নির্বাচন কমিশন প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বটে, তবে সবকিছু নির্ভর করছে ফাইনাল পরীক্ষা, মানে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের ওপর। পরাজয়ের পর কুমিল্লার এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, এটা আসলে সরকারের টোপ। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করে সরকার বিএনপিকে জাতীয় নির্বাচনে আনার চেষ্টা করবে। কথাটা হয়তো নিজেদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলা। তবে খুব বেশি ভুল হয়তো বলেননি তিনি। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি হবে না, তা নির্ভর করে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর; নির্বাচন কমিশনের ওপর নয়।
কুমিল্লা নির্বাচনের ফল নিয়ে নানামুখী পর্যালোচনা চলছে। তবে জয়ী প্রার্থীকে নিয়ে যতটা আলোচনা, তারচেয়ে বেশি পর্যালোচনা সীমা কেন হারলেন, তা নিয়ে। আলোচনার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নিশ্চিত জয় কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে। পৌরসভা ধরলে বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু যে গত দুই মেয়াদেও জনগণের ভোটে জিতে মেয়র হয়েছিলেন, তা যেন সবাই ভুলে বসে আছেন। সীমার পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা যেন মনিরুল হক সাক্কুর অর্জনকে ভুলে না যাই। সাক্কুর জয়কে খাটো করা মানে কিন্তু জনরায়কে হেয় করা।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের জন্য সবাই মূলত দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বকে দায়ী করছেন। কুমিল্লায় আফজাল-বাহার বিরোধ তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের ক্ল্যাসিক উদাহরণ। কিন্তু কুমিল্লা আওয়ামী লীগে গ্রুপ এখন পাঁচটা। সীমার পরাজয়ের জন্য বাহারকে যেমন দায়ী করা হচ্ছে, অভিযোগের আঙুল উঠছে পরিকল্পনা মন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লোটাস কামালের দিকেও। বাহার গ্রুপের লোকজন পরাজয়ের দায় ঠেলতে চাইছেন লোটাস কামালের দিকে, আর সবাই মিলে দায় দিচ্ছেন বাহারকে। পরাজিত প্রার্থী সীমার বাবা আফজল খানের সাথে কুমিল্লা সদরের বর্তমান এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের দ্বন্দ্ব প্রায় চার দশকের পুরনো। আশির দশকের শুরুতে বাহার আফজল গ্রুপেই ছিলেন।
সম্ভবত ’৮২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আলাদা প্যানেল দিয়ে গুরু আফজল খানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ান বাহার। গুরুকে টেক্কা দিয়ে শিষ্য বাহারের দেয়া সফিক-জাহাঙ্গীর প্যানেল জিতে যায় ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদে। তারুণ্যের সেই জোয়ারকে পুঁজি করে আফজল খানকে হারিয়ে পৌরসভা চেয়ারম্যান হন তখনকার ক্রেজ বাহার। তখন বোম্বেতে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। তরুণ বাহার দেখতে একদম অমিতাভের মত। তিনি চাইলে জনপ্রিয় নেতা না হয়ে, সুপারহিট অভিনেতাও হতে পারতেন। আশির দশক থেকেই তরুণ কর্মী বাহিনী আর প্রবল ব্যক্তিত্বের গুণে নিজের জনপ্রিয়তা ও অবস্থান ধরে রেখেছেন বাহার। ধরে রেখেছেন আফজল খানের সাথে তার বিরোধও। কুমিল্লার রাজনীতিতে নানা হিসাব-নিকাশ হয়েছে, পক্ষ বদলের ঘটনা ঘটেছে, নতুন মুখের খোঁজে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে; কিন্তু বদলায়নি আফজল-বাহারের দ্বন্দ্বের রসায়ন।
এই দ্বন্দ্বের ফলে আফজল খান এরশাদ পতনের আগে অল্প সময়ের জন্য জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন বাহার। আর আফজল-বাহারের এই দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে ’৭৩ সালের পর বারবার কুমিল্লা সদর থেকে এমপি হয়েছেন বিএনপির আকবর হোসেন। লোকে মজা করে তাকে ‘একবার হোসেন’ ডাকতো। কারণ নির্বাচনের আগে একবারই তিনি জনগণের কাছে যেতেন। আর রসিক আকবর হোসেন বলতেন, আমার দুই বিশ্বস্ত কর্মী আফজল-বাহার থাকলে, তার জেতার জন্য বারবার আসার দরকার নেই। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাহারের হাত ধরেই আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। তারপর থেকে কুমিল্লা শহরে বাহারের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সারাদেশে যেমন এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কিছু নেই, কুমিল্লাতেও বাহার ছাড়া কেউ নেই। বাহারের কথা ছাড়া নাকি কুমিল্লায় গাছের পাতাও নড়ার সাহস পায় না। কুমিল্লার যা কিছু কু, যা কিছু সু; সবই বাহারের ইশারায় হয়। হয়তো সেই একাধিপত্যে ভারসাম্য আনতেই বাহারের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী আফজল খানের মেয়ে সীমাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয়।
নারায়ণগঞ্জে যে বাজিটা ধরেছিলেন শেখ হাসিনা, তা ধরতে চেয়েছিলেন কুমিল্লায়ও। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান আর কুমিল্লার বাহার এক নয়। তাই নারায়ণগঞ্জের ফল মেলেনি কুমিল্লায়। শামীম ওসমান যে বিপদে পড়েছিলেন, সেই একই বিপদে পড়েছিলেন বাহারও। কিন্তু দারুণ কৌশলে সেই বিপদ সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারলেন কিনা, তা বলার সময় এখনও আসেনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্র জানিয়েছে, শামীম ওসমানের মত বাহারকে দলীয় মেয়র প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার শর্ত দেয়া হয়েছিল। নইলে কঠোর ব্যবস্থা বা পরবর্তী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ার হুমকিও ছিল। কিন্তু সে হুমকিকে থোরাই কেয়ার করেছেন বাহার।
আমার ধারণা, তার হিসাব ছিল পরিষ্কার- দুই বছর পর কী হবে, তা নিয়ে ভাবার চেয়ে, নগদ শত্রু বিনাশকেই জরুরি মনে করেছেন তিনি। কারণ সীমা একবার মেয়র হয়ে গেলে বাহারের একাধিপত্যে বিঘ্ন ঘটবে। আর সীমা মেয়র হয়ে গেলে নিশ্চয়ই তার বাবার পুরনো শত্রু বাহারকে নানাভাবে ডিস্টার্ব করার চেষ্টা করবেন। তারচেয়ে বড় কথা হলো, সীমা একবার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারলে পরে তাকে সামলানো কঠিন হবে বাহারের জন্য। বাহারের কাছে মেয়র হিসেবে আওয়ামী লীগের সীমার চেয়ে বিএনপির সাক্কু অনেক স্বস্তিদায়ক। গত ১০ বছর ধরে বাহার আর সাক্কু মিলেমিশেই কুমিল্লা শাসন করছেন। দেশে আমরা যেমন সৌহার্দ্যের রাজনীতি চাই, কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের এমপি আর বিএনপির মেয়রের মধ্যে তেমন সৌহার্দ্য বিরাজ করছে। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের বিরোধীদলীয় মেয়ররা রীতিমত দৌড়ের ওপরে আছেন। বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমায় কেউ পদ হারিয়েছেন, কেউ জেল খেটেছেন। কিন্তু মনিরুল হক সাক্কু দায়িত্ব পালন করে গেছেন নির্বিঘ্নে। সবার ধারণা বাহারের আশীর্বাদ আছে বলেই সাক্কু এতোটা নিশ্চিন্ত, নির্ভার।
বাহাউদ্দিন বাহার ভালো করেই জানেন, দুই বছর পর যখন মনোনয়নের প্রশ্ন আসবে, তখন তার চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প পাবে না দল। এর আগে বাহার-আফজলের বিকল্পের সন্ধানে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পায়নি। তাই তো ২০০৮ সালের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করেই তাড়াহুড়ো করে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল বাহারকে। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যারা দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঙ্কার দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা সবাই যেমন জানি, বাহারও নিশ্চয়ই জানেন, এসব তর্জন-গর্জনই সার। অতীতে অনেক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বা কাজ করে অনেকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার হয়েছেন। কিন্তু কিছুদিন পর আবার ঝাঁকের কই ঝাঁকে মেশে গেছেন। বিদ্রোহীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বরাবরই উদার। সাময়িক বহিষ্কারাদেশ নিছকই সাময়িক। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বাহার নিজেই।
ছাত্রলীগ কর্মী দুলাল হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কৃত থাকা অবস্থায়ই তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আর আগামী নির্বাচনের আগে বহিষ্কারের মত কঠোর সিদ্ধান্ত আছে আওয়ামী লীগের। আর দল যদি বাহারের ব্যাপারে অন্যদের মত উদার নাও হয়, তাতেও অসুবিধা নেই, বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবেও বাহার যথেষ্টই শক্তিশালী। নিজে জিততে পারেন আর না পারেন, দলীয় প্রার্থীকে হারানোর ক্ষমতা তার আছে। দুইবার পৌরসভার চেয়ারম্যান ও দুইবার এমপি হয়ে তিনি তার জনপ্রিয়তার প্রমাণও রেখেছেন। বাহারের মূল শক্তি তার কর্মী বাহিনী। কিন্তু সেই কর্মীরাই যে প্রায় ১০ বছরে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করে তার জনপ্রিয়তার দুর্গের তলা কেটে দিচ্ছে, সে খবরও নিশ্চয়ই বাহার রাখেন। ভয় পাওয়া আর ভালোবেসে গোপন ব্যালটে ভোট দেয়া যে এক কথা নয়, কুমিল্লা সিটি নির্বাচনই তো তার বড় প্রমাণ।
এটা ঠিক, সারাদেশে এখন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। বারবার নানা হুমকি দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। ক্ষুব্ধরা যদি জানেনই, বিদ্রোহ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তাহলে কোনোদিনই তা মিটবে না। অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটাতে হলে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা দলের ক্ষতি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে সত্যি সত্যি কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
কুমিল্লায় পরাজয়ের জন্য অনেকে প্রার্থী মনোনয়নকে দায়ী করেন। সীমা কিন্তু প্রার্থী হিসেবে খারাপ নন। সাধারণ মানুষের সাথে তিনি মিশে যান অনায়াসে। এর আগে দুইবার তিনি কাউন্সিলর, একবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এটা ঠিক আফজল খানের মেয়ে-এই পরিচয়ই মেয়র পদে তার মনোনয়ন নিশ্চিত করেছে। আবার আফজল খানের পরিচয়ই তার পরাজয়ের অন্যতম কারণও। আফজল খানের পরিবারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন হত্যা, সন্ত্রাস, দখলসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। সীমার বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ না থাকলেও, পারিবারিক অপকর্মের দায় বহন করতে হয়েছে তাকে। আর পরাজয়ের দায় বাহার বা লোটাস কামালের ঘাড়ে দেয়ার আগে নিজেদের ঘরের দিকেও তাকানো দরকার। দীর্ঘদিন বাহারের একাধিপত্যের কারণে আফজল খানের গ্রুপ এখন অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। আফজল খান পরিবারের সেই দাপট আর নেই। বাহার যেমন দুলাল হত্যার ঘটনায় দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, আফজলও তেমন শঙ্কর হত্যার দায়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। নির্বাচন পরিচালনায় সুপরিকল্পনা, সংগঠিত কর্মী বাহিনীর সমন্বয় করতে পারেননি সীমা।
তবে কুমিল্লায় পরাজয়ের জন্য অন্তর্দ্বন্দ্ব আর প্রার্থীর ওপর দায় দিলে আড়ালে থেকে যাবে অনেক সমস্যা। নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে কোনো হাত দেয়নি সরকার। কিন্তু দলীয় প্রার্থীকে জেতানোর জন্য কম চেষ্টা করেনি আওয়ামী লীগ। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা বড় দল নিয়মিত কুমিল্লার প্রচারণায় ছিল। কিন্তু তারা সেলফি বা ফটোসেশনে যতটা ব্যস্ত ছিলেন, দলীয় প্রার্থীকে জেতানোর জন্য বাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে ততটা কাজ করেননি। সমন্বয়হীন প্রচারণায় আওয়াজ যতটা হয়েছে, কাজ ততটা হয়নি। বরং ভবিষ্যৎ পদ-পদবি নিশ্চিত করতে স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রটোকল দিতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
তবে কুমিল্লার নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের শেখার আছে অনেক কিছু। বাংলাদেশে এখন দৃশ্যত আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দল নেই। সারাদেশেই আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। দলে দলে বিভিন্ন দলের, এমনকি জামায়াতের লোকজনও আওয়ামীর লীগে যোগ দিচ্ছেন। ব্যতিক্রম নয় কুমিল্লাও। এমনকি নির্বাচনের দিনেও মাঠে বেশিরভাগ দেখা গেছে নৌকার ব্যাজ লাগানো কর্মী। ধানের শীষকে খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপ লেগেছে। অনেক কেন্দ্রে ধানের শীষের পোলিং এজেন্টও ছিল না। কিন্তু ফলাফলে প্রমাণিত, নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে ধানের শীষে ভোট দিয়ে এসেছেন অনেকে। নির্বাচনে বিএনপি যতটা কৌশলী ছিল, আওয়ামী লীগ ততটাই এলোমেলো।
আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, শুধু উন্নয়ন দিয়ে যে ভোট পাওয়া যায় না; রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, গাজীপুরের পর কুমিল্লায়ও তা প্রমাণিত হলো। উন্নয়ন চাই, তবে তার আগে চাই গণতন্ত্র, চাই আইনের শাসন, চাই মানবাধিকার। সুযোগ পেয়ে মানুষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে গোপন ব্যালটে।
আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপি, নির্বাচনে জিততে হলে মানুষের অন্তর পড়তে জানতে হবে।
১ এপ্রিল, ২০১৭
[email protected]
এইচআর/এমএস