হিজাব ও একটি রায়


প্রকাশিত: ০৩:৫৯ এএম, ২৭ মার্চ ২০১৭

অতি সম্প্রতি ইউরোপের শীর্ষ আদালত কর্মস্থলে কোন ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতবাদকে তুলে ধরে এমন পোশাক পরিধানের বিষয়ে একটি রায় প্রদান করেছেন। রায়টি বেলজিয়ামের জি ফোর এস নামের একটি সিকিউরিটি কোম্পানির অভ্যর্থনা কর্মী সামিরা আচবিতার দায়ের করা ধর্মীয় বৈষম্যের মামলার ক্ষেত্রে প্রদান করা হয়েছে। ঘটনাসূত্রে জানা যায়, সামিরা তিন বছর ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর কর্মস্থলে ইসলামিক হেডস্কার্ফ পরতে চাইলে প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে অসম্মতি প্রদান করে।

কোম্পানি মৌখিকভাবে তাকে ইসলামিক হেডস্কার্ফ পরিধান না করে গ্রাহক সেবায় নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করতে নির্দেশ প্রদান করে। সামিরা তা অমান্য করে। প্রতিষ্ঠানটি চাকুরি বিধি সংশোধন করে সেই মৌখিক নির্দেশকে লিখিতভাবে চাকুরিবিধির অন্তর্ভুক্ত করে। সংশোধনীতে বলা হয় " Employees are prohibited, in the workplace, from wearing any visible signs of their political, philosophical or religious beliefs and/or from engaging in any observance of such beliefs." এরপর ২০০৬ সালের ২৯ মে সামিরাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

এতে সামিরা আদালতের শরণাপন্ন হন এবং দাবি করেন যে `ইকুয়াল অপারচুনিটি এক্ট` এর ধর্মীয় প্রবিধান অমান্য করে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। বেলজিয়ামের আদালত আইনী ব্যাখ্যার জন্য ইউরোপের সর্বোচ্চ আদালতে এই মামলা হস্তান্তর করেন। এই মামলার রায়ে আদালত বলেছে `কর্মক্ষেত্রে যদি সকলের জন্য দৃশ্যমান ধর্মীয় পোশাক বা প্রতীক নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে, তবে হেডস্কার্ফকে নিষিদ্ধ করাটা বৈষম্যমূলক নয়`। রায়টিতে আরো বলা হয়েছে যে কোন ধর্মীয়, রাজনৈতিক, জাতিগত অথবা গোত্রীয় পরিচয়ের দৃশ্যমান প্রতীক বহন করে` এরুপ পোশাক কোন কর্মচারী ব্যবহার করলে মালিক চাইলে ওই কর্মচারীকে কর্মস্থলে নিষেধ করতে পারবে। এবং কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে এ জাতীয় পোশাকধারীকে মালিক চাইলে নিয়োগ নাও দিতে পারে।

অর্থাৎ এখানে কর্মী ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছ। যা মালিক বা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ অনুযায়ী গ্রহণ এবং প্রয়োগ করতে পারে। এখানে আদালতের রায়ে বলা হয়নি মালিককে বা প্রতিষ্ঠানকে এটি আবশ্যিক ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এর প্রয়োগ মালিক পক্ষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে এটিও খেয়াল করতে হবে যে চাকুরি থেকে ছাঁটাই করার আগে সেবাগ্রহণকারীদের সামনে আসতে হয় না এমন কোন কাজে উক্ত কর্মীকে বদলি করা সম্ভব ছিল কিনা। আদালতের এই পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে এ রায়ে নিরপেক্ষতা এবং বাদীর প্রতি সহানুভূতির বিষয়টিও বেশ গুরুত্ব পেয়েছে।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে এটি কেবল ইসলাম ধর্মের হিজাবের ক্ষেত্রে নয়, বরং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পোশাক বা প্রতীককেও এর আওতাভুক্ত করা হয়েছে। যেমন শিখ ধর্মাবলম্বীদের পাগড়ী, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ক্রস, ইহুদীদের কাপ্পা ইত্যাদি পোশাকি প্রতীকগুলোকেও মালিক কর্তৃপক্ষ চাইলে কর্মস্থলে ব্যান করতে পারবেন। সেই সঙ্গে কোন পেশাগত পরিচয় ধারণ করে, যেমন আর্মিদের পোশাক বা র্যাং ক, কোন রাজনৈতিক দলের পোশাক পরে কর্মস্থলে আসলে বা চাকুরির আবেদন করলেও তাকে ছাঁটাই করার আইনি অধিকার পাবেন মালিক পক্ষ। চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠান যদি উক্ত নির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে কর্মীকে চাকুরি হতে বাদ দেয় তাহলে সেটি আইনের কাছে সেই কর্মীর প্রতি `বৈষম্যমূলক আচরণ` বলে বিবেচিত হবে না।

এখানে স্পষ্ট যে, এই রায়ে এমন কথা বলা হয়নি ওই প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে নির্দিষ্ট করে ইসলাম ধর্মের হিজাবের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে হেডস্কার্ফ এর কথা। যা ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও ব্যবহার করে। কিন্তু অনেকেই স্কার্ফ এর বাংলা হিজাব হিসাবেই ধরে নিলেন। স্কার্ফ এর প্রতিশব্দ শুধু হিজাব মনে করা হলে সাধারণ মানুষের কাছে, বিশেষ করে মুসলিম কমিউনিটির কাছে ভুল তথ্য পৌঁছে যেতে পারে। তাতে করে হিজাব পরিহিত নারীদের মধ্যে এক ধরনের আক্রোশ এবং ক্ষোভের জন্ম নিতে পারে। অন্যদিকে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা এই তথ্যের ভুল ব্যাখ্যা দিতে অতি উৎসাহী হয়ে উঠতে পারেন।

কিন্তু এ রায়কে কেন্দ্র করে যদি বলা হয় `সমগ্র ইউরোপে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে` অথবা ইউরোপের কর্মস্থলে হিজাব নিষিদ্ধ বা দণ্ডনীয় অপরাধ তাহলে সাধারণ মানুষের মধ্যে কনফিউশনের সৃষ্টি হবে। এই রায়ে অনেকেই ভাবতে পারেন যে সমগ্র ইউরোপের দেশগুলোতে ইসলাম ধর্মের নারীদের হিজাব ব্যবহারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বস্তুত, কর্মক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানে এই রায় প্রযোজ্য নয় এবং কর্মচারীগণের সাজপোশাক নিরপেক্ষ রাখার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের চাকুরি বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।

রায়ে বলা হয়েছে একজন ক্রেতা বা গ্রাহকের আপত্তির কারণে একটি প্রতিষ্ঠান কোন কর্মচারীর ক্ষেত্রে এ ধরনের নির্দেশ প্রদান করতে পারবে না। এবং এটা নিশ্চিতভাবে দেখতে হবে যে ওই প্রতিষ্ঠানের নীতি সব কর্মচারীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে কীনা। এ রায়টিতে এমন কথা বলা হয়নি যে, যে কোন ধর্মীয় প্রতীক একেবারে নিষিদ্ধ। সে ক্ষেত্রে কোন প্রতিষ্ঠান যদি মনে করে এ সকল প্রতীক বহনকারী কোন কর্মী ছাঁটাই করা তাঁদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বা ক্ষতিকর, তবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারও তাদেরই থাকবে।

সকল দিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে যে আদালতের এই রায়ে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে, সেবাগ্রহণকারীদের কাছে প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রক্ষা করা, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক প্রতীককে নিরুৎসাহিত করে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া, প্রতিষ্ঠানের নীতি সব কর্মচারীর জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা এবং ছাঁটাই করার আগে কর্মীকে অন্যত্র বদলির চেষ্টা করা। এই সকল বিষয়গুলো রায়ে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে এটিই মনে হচ্ছে যে আদতে বৈষম্য নিরসনের পক্ষেই এই রায়।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে সার্বজনীন স্বার্থকে এই রায়ে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। সামিরা আবিচতা সেই অর্থে এই মামলায় ব্যক্তিগতভাবে জয়ী না হলেও, গোষ্ঠীগত বৈষম্য নিরোধ করে যেন হেরে গিয়েও জিতে গেলেন।
লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড ।

[email protected]

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।