জাতীয় গণহত্যা দিবস
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যা হয়েছিল কিনা এ নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করে থাকেন। কথাবার্তায় মনে হয় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ারও মনে এই সংশয় রয়েছে।
শহীদের সঠিক সংখ্যা ত্রিশ লক্ষ কিনা এ নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে, কিন্তু গণহত্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ বিস্ময়কর ব্যাপার। তবে শহীদের সংখ্যাও যে বাড়িয়ে বলা হয় নি তাও এখন নানা তথ্যে বোঝা যাচ্ছে। যুদ্ধের বলি হয়েছে প্রায় দশ লক্ষ শিশু, যার বেশির ভাগ প্রাণ হারিয়েছে শরণার্থী শিবিরে সে বছরের দীর্ঘ বর্ষার সময়। শিশুরা ব্যক্তিপরিচয় গড়ে ওঠার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, ফলে তাদের কথা কারুর মনে থাকে না।
মুক্তিযুদ্ধ কেবল কতিপয় রণাঙ্গনে সীমাবদ্ধ ছিল না, সারাদেশে গেরিলা যোদ্ধারা লড়াই করেছে, কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা তাদের নরহত্যা তো কেবল রণাঙ্গনে বা যুদ্ধে সীমাবদ্ধ রাখেনি, তারা বাঙালির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাদের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং হিন্দু জনগোষ্ঠীমাত্রই ছিল পাকিস্তানের শত্রু। আর আমরা তো জানি সত্তরের নির্বাচনে এদেশের সিংহভাগ ভোটার আওয়ামী লীগের পক্ষে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় পাকিস্তানি জান্তা সরকারকে বিস্মিত করে দিয়েছিল, দুইটি ছাড়া সব আসন পেয়ে কেবল এই প্রদেশের আসনেই আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। বাঙালির হাতে পাকিস্তানের ক্ষমতা ঠেকানোর জন্যেই পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক চক্র সেদিন ষড়যন্ত্র করেছিল।
পাকিস্তান গোটা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আর এদেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ সেদিন বঙ্গবন্ধুর পেছনে কাতার বন্দি ছিল। ফলে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হত্যা করার অর্থ হল সারা দেশের মানুষকে হত্যার লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করা। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ায়, পাকিস্তানি বাহিনির বিরুদ্ধে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিরোধ করেছি। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বা বাঙালির প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তানি সৈন্য, আধা সামরিক বাহিনি এবং তাদের এদেশীয় দোসর। এরা সবাই মিলে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখের মত হবে। আর এর বিপরীতে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনির টার্গেট ছিল অন্তত সাত কোটি বাঙালি। তারা কোনো প্রতিরোধ বা যুদ্ধের অপেক্ষায় থাকেনি, যুদ্ধের পুরো নয়মাস জুড়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। আবারও বলি, তাদের চোখে বাঙালিমাত্রই ছিল সন্দেহভাজন এবং হত্যার টার্গেট।
পাকিস্তানি বাহিনি পঁচিশে মার্চ রাতে এই হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল। গ্রাম পর্যায়ে বাঙালিদের কিছু প্রতিরোধ ছিল। কিন্তু উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত অত্যাধুনিক প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনির সামনে তা বেশিদিন টেকেনি। সৌভাগ্যক্রমে পাকিস্তানিদের এই ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং এ নিয়ে পাকিস্তান সরকার চাপের মধ্যে পড়ে যায়। ফলে তাদের ওপর দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে এমন বাস্তবতা দেখানোর দায়ও পড়ে। তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যেতে পারেনি। আর তাই মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ত্রিশ লক্ষের এদিক-ওদিক থাকছে। নয়ত এ সংখ্যা কী পরিমাণ হত তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। মনে রাখতে হবে আমাদের তিনদিক জুড়ে ছিল সহানুভূতিশীল দেশ ভারতের সীমানা। তাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির আক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিপুল মানুষ দ্রুত দেশ ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচিয়েছিল। শরণার্থীর এ সংখ্যা শেষ পর্যন্ত এক কোটিতে গিয়ে ঠেকে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যাও এরকম হত যদি না পাশে ভারত থাকত আর আন্তর্জাতিক চাপ দ্রুত আসত।
পঁচিশে মার্চ অতএব আমাদের জন্যে গণহত্যা দিবস। যথা সময়ে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগুলে হয়ত একুশে ফেব্রুয়ারি যেভাবে জাতিসংঘের স্বীকৃতিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে এদিনটিও সেভাবে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হতে পারত। যেহেতু জাতিসংঘ অন্য একটি দিনকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছে তাই আপাতত আমরা গণহত্যার তালিকায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের হত্যাযজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলতে পারি।
প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ক কুড়ি হাজার আর্মেনিয়ানকে হত্যা করেছিল। আর্মেনিয়া অবশ্য এ সংখ্যা আরো বেশি দাবি করে থাকে। তবে তা হাজারের ঘরেই আছে। এটি গণহত্যা হিসেবে তারা দাবি করে এবং ইউরোপ স্বীকার করে। বসনিয়ার গণহত্যাতেও মৃতের সংখ্যা আমাদের চেয়ে কম। সব রকম গণহত্যার বিরোধিতা করেও আমরা বলব যে সাম্প্রতিক ইতিহাসে সংঘটিত এত বড় গণহত্যার একটা পৃথক স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক মহলে থাকা দরকার।
বাংলাদেশেরও উচিত এর একটি বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরা। এসব কাজ আমরা যথাসময়ে করিনি। স্বাধীনতার পরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুর্নগঠন ও এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন এবং দেশকে একটি শাসনতান্ত্রিক কাঠামোয় ফেরানোর মত জরুরি কাজেই সরকারকে মনোযোগ দিতে হয়েছে। তারপরে পঁচাত্তরের হত্যাযজ্ঞ সরকারের অবস্থান ও নীতিকে পাল্টে দিল। পাকিস্তানি ধারার রাজনীতিই কেবল ফিরিয়ে আনা হয় নি, পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধকে আড়াল করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়। সেই ধারা চললো ছিয়ানব্বই পর্যন্ত। পরবর্তী সরকারের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থাকলেও সরকার ছিল দুর্বল, আর বহু বছরের উল্টোযাত্রা থেকে দেশকে ফেরানোর কাজ ছিল কঠিন। বস্তুতপক্ষে ২০০৯ সনে ক্ষমতায় আসার পরই কেবল বর্তমান সরকার ইতিহাস বিকৃতি রোধ ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে সংহত করার চেষ্টা করতে পারছে।
ইতোমধ্যে বিদেশে বসবাসরত কিছু দেশপ্রেমিক বাঙালির উদ্যোগেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা সম্ভব হয়েছে। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন আমাদের সঠিক সত্য ইতিহাসের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নয়ত জাতীয় ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো ও বিতর্ক সৃষ্টি থামবে না। এ কাজে সরকার ও নাগরিকসমাজ, বিশেষত দেশের ইতিহাসবিদ ও সচেতন নাগরিকদের যৌথ উদ্যোগ থাকা বাঞ্ছনীয়।
ভালো ফল পেতে হলে বিষয় সম্পর্কে গভীর ধারণা, উপলব্ধি, জ্ঞান এবং কাজে আন্তরিকতা থাকতে হবে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে মন্ত্রণালয় বারবার হোঁচট খাচ্ছে। গণহত্যার চিত্র তৈরিতে আমাদের মনে হয় আরো সাবধানি ও সতর্ক হওয়া উচিত। তবে এ কাজ বেসরকারিভাবে শুরু হয়েছে। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি কিছু কাজ করেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর পক্ষ থেকেও কিছু কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। এভাবে মাঠ পর্যায়ে জরিপ ও তথ্যসংগ্রহ এবং সঠিক গবেষণার পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমরা গণহত্যা সম্পর্কিত বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াশা কাটাতে পারব।
আমাদের জাতীয় জীবনে দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। ২৫ মার্চের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধকে সকল বাঙালির প্রাণের লড়াইয়ে পরিণত করেছিল। এটি হয়ে উঠেছিল জনযুদ্ধ।
আমাদের ইতিহাসের বীরত্ব ও ত্যাগের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলো সবার জানা প্রয়োজন, বিশেষভাবে নবীন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের জানা জরুরি। আজ প্রথমবারের মত জাতীয় গণহত্যা দিবস পালিত হচ্ছে। আমরা এদিন সকল শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানাই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, সমাজচিন্তাবিদ।
এইচআর/এমএস