জাতীয় ইতিহাসে গণহত্যা


প্রকাশিত: ০৩:২২ এএম, ২৫ মার্চ ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আমরা খুলনার চুকনগর গিয়েছিলাম তথ্য সংগ্রহে ২০০০ সালের দিকে। সেখানে আমরা গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া দুশোজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। চুকনগরে ১৯৭১ সালের মে মাসে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় কমপক্ষে দশ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এতো কম সময়ে এতো মানুষ হত্যার নজির বিরল। খালি কী চুকনগরে? বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে, বড় শহরে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড হয়েছে।

বেশ কিছু দিন আগে মাঠপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের জন্য বরিশালের স্বরূপকাঠির গভীর এক গ্রামে গিয়েছিলাম। ছোট গ্রাম। কয়েক ঘর চাষি বাস করেন। তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ১৯৭১ সালে পাকিরা এখানে এসেছিল কিনা? তারা জানালেন, গানবোটে করে এসেছিল এবং মানুষ হত্যা করেছিল। আমি যখন ওই অঞ্চলে যাই তখন যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তারপরও সে গ্রামে পৌঁছতে আমার বেশ সময় লেগেছে। ১৯৭১ সালে সে গ্রামে পৌঁছা আরো কষ্টকর ছিল। তারপরও পাকিরা সেই গ্রামে গিয়ে মানুষ হত্যা করেছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে পাকি ও তাদের অনুচররা গিয়ে মানুষ হত্যা করেনি। ৬৪ হাজার গ্রামে গড়ে ১০ করে হত্যা করলেও তো সে সংখ্যা হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। আমাদের হিসাব বাদ দিই, রাও ফরমান আলীও তো পঞ্চাশ হাজারের কথা স্বীকার করেছেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানের দুই নম্বর ব্যক্তিটিই যদি এ কথা বলেন তাহলে প্রকৃত সত্যটি সহজেই অনুমেয়।  

কোনো গণহত্যারই নির্দিষ্ট সংখ্যা কখনো নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব গণহত্যার সংখ্যা দেয়া হয়েছে তার সবগুলোই আনুমানিক। এই অনুমানের ভিত্তি প্রত্যক্ষভাবে দেখা, বিভিন্ন প্রতিবেদন, অভিজ্ঞতা। যে দেশ-জাতি গণহত্যার যে সংখ্যা নিরূপণ করে তা মোটামুটি এ কারণে মেনে নেয়া হয়।

কম্বোডিয়া থেকে রুয়ান্ডা বা হলোকাস্ট থেকে ইন্দোনেশিয়া কোথায় চুলচেরা হিসাব দেয়া হয়েছে? সুহার্তো ইন্দোনেশিয়ায় যে গণহত্যা চালিয়েছিলেন ১৯৬৫-৬৬ সালে, তাতে অনুমান করা হয় ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সেটি মানা না মানা অন্য কথা, কিন্তু সুহার্তো কী পরিমাণ হত্যা করেছিলেন সেটিই মূল বিষয়। ধরা যাক, কেউ বললেন বাংলাদেশে ২৯ লাখ ৯০ হাজার ৫১৯ জন মারা গেছেন। তাতে কি আসে যায়?
সংখ্যার নির্দিষ্টকরণের পেছনে এক ধনের রাজনীতি আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে নাপাম দিয়ে যে গণহত্যা চালিয়েছে সেটিকে পাশ্চাত্যের কেউ গণহত্যা বলেন না, বলেন যুদ্ধ। কারণ যুদ্ধ বললে হত্যার দায় হ্রাস পায়। দু’পক্ষে যুদ্ধ হলে তো মারা যাবেই। কিন্তু ভিয়েতনামে কি খালি যুদ্ধ হয়েছিল? নিরীহ সিভিলিয়ানদের হত্যা করা হয়নি বছরের পর বছর? সুহার্তোর হত্যা নিয়ে কখনো কথা বলা হয় না। ওই গণহত্যা স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চিন্তা করা হয়েছে, কেউ এ বিষয়ে কথা বলেন না, কারণ কাজটি আমেরিকার সাহায্যে করা হয়েছে। অন্যদিকে, কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব সোচ্চার কারণ, পলপট ছিলেন কম্বোডিয়ার এবং মার্কিন বিরোধী। কমিউনিস্ট শাসন যে কত খারাপ তা বোঝানোর জন্য কম্বোডিয়ার কথা বারবার আসে।

হামুদুর রহমান কমিশন নিয়ে আমি অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে তা আর করলাম না। আমি রাও ফরমান আলী ও তার বক্তব্য প্রসঙ্গে অন্যদের বক্তব্যও নিয়েছিলাম। রাও ফরমান আলী গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন এবং অন্যরা বলেছেন রাও ফরমান নিজেকে বাঁচাতে যা যা বলেছিলেন তাও ভড়ংবাজি। কমিশন অনেক সেনা অফিসারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা বলেছিল। পাকিস্তান তা করতে রাজি না হওয়ায় হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

রাও ফরমান আলীর যে সাক্ষাৎকার আমি ও মহিউদ্দিন আহমদ নিয়েছিলাম তাতে বুদ্ধিজীবী হত্যা প্রসঙ্গটি ছিল। ফরমান এ সম্পর্কে তার বইয়ে যা বলেছেন, হামুদুর রহমানের সামনেও তাই বলেছেন।

সাক্ষাৎকারের খানিকটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি-
‘আমার যদ্দুর মনে পড়ে’, বললাম আমি, ‘জেনারেল নিয়াজী লিখেছেন যে, বাগদাদে চেঙ্গিস খান বা হালাকু খান যে রকম নির্মমতা দেখিয়েছিলেন তা দেখাতে হবে। তিনি বলেছিলেন, তিনি মাটি চান, মানুষ নয়। শুধু তাই রাও ফরমান আলী সে আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। আপনার ডায়েরিতেও লেখা ছিল- বাংলার সবুজকে লাল করে দিতে হবে।’
‘দুটি আলাদা ব্যাপার’, বললেন রাও ফরমান আলী, ‘আমি দুঃখিত, কিন্তু আমাকে বলতে হচ্ছে যে, জেনারেল নিয়াজী একজন মিথ্যাবাদী। সবুজ রঙ লাল করার কথায় আমি…’
‘সেটি আপনার বইতে বলেছেন’, বলি আমি।
‘আপনি কাজী জাফরকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন যে, টঙ্গীতে ঐ সময় এ বিষয়ে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন কিনা।’ জানালেন ফরমান, ‘আরও ছিলেন দুই তোয়াহা, একজন জামায়াতের, আরেকজন মার্কসবাদী। তিনি বক্তৃতায় বলতে
চেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী ধ্যান-ধারণাকে কমিউনিস্ট ধারণায় বা লাল ঝাণ্ডায় রূপান্তরিত করবেন। জেনারেল ইয়াকুব বিষয়টি আমাকে জানালে আমি ডায়েরিতে তা লিখে রাখি। একটি বাক্যই ছিল সেখানে। একটি বাক্য দিয়ে কি পুরো একটি পরিকল্পনা করা যায়। জেনারেল নিয়াজী এখন অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। বইটি মিথ্যায় ভরা। বইটি তিনি নিজে লেখেনওনি। আপনি তাঁকে ঐ বইটির একটি পৃষ্ঠা না দেখে তাকে লিখতে বলুন। তিনি যদি পারেন তাহলে মেনে নেব বইটি তাঁর লেখা। টিক্কা কখনও ঐ ধরনের উক্তি করেননি যা আপনি বলেছেন। গভর্নর হিসেবে তিনি ছিলেন চমৎকার, অথচ দুর্ভাগ্য যে, বেলুচিস্তানে ও পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর একই দুর্নাম রটেছে।
‘আরও কী যেন বলছিলেন, নিয়াজী সম্পর্কে’, তাকে মনে করিয়ে দিই।
‘নিয়াজী যেদিন দায়িত্ব নিলেন’, ফরমান আবার শুরু করলেন, ‘সেদিন বললেন, মনে হয় দুশমনদের দেশে আছি। আমরা কিন্তু কখনো মনে করিনি আমরা দুশমনদের দেশে আছি, বরং আমরা মনে করেছি পাকিস্তানে আছি। তিনি আরো সব ভয়ঙ্কর কথা বলেছিলেন। যেমন এখানকার মানুষের পরিচয় বদলে দেব।’
‘বলা হয়ে থাকে আপনি রাজাকার বাহিনী গড়েছিলেন।’ জিজ্ঞেস করি আমি।
‘না, আমার মনে হয় মার্শাল ল’ সদর দফতর তা গঠন করেছিল।’ বললেন ফরমান।
‘আইডিয়াটা কার?’ জিজ্ঞেস করলেন মহিউদ্দিন ভাই।
‘ফোর্স কমান্ডারের।’
‘তিনি কে?’
‘নিয়াজী। তিনি আলশামস ও আলবদরের স্রষ্টা।’
‘তার বইটিও তিনি তাদের উৎসর্গ করেছেন।’ বলি আমি।
‘তিনি তাদের স্রষ্টা, ব্যবহারকারী সব।’ বললেন ফরমান।
‘নিয়াজী লিখেছেন, আলবদর ও আলশামস নেতাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছিল’, জিজ্ঞেস করলেন মহিউদ্দিন ভাই।
‘আমি জানি না।’ উত্তর দিলেন ফরমান।
‘আপনি তো দেখছি কিছুই জানেন না’, খানিকটা বিদ্রুপের সুরে বললেন মহিউদ্দিন ভাই।
‘দেখুন, আসল ঘটনা হলো ঐ সময় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়েছিল। আমি আর তখন কেউ না। গভর্নর মালেক পদত্যাগ করেন ভারতীয় আক্রমণের মুখে, আমার আর কোনো কিছু করার ছিল না।’
এরপর রাও ফরমান আলী ও আমার মধ্যে দ্রুত কিছু বাক্য বিনিময় হয় যা ছিল নিম্নরূপ:
আমি জিজ্ঞেস করি-
‘এ ঘটনা কী ১৩ ডিসেম্বর, বুদ্ধিজীবী হত্যার আগের দিন।’
‘হ্যাঁ, নিয়াজী ওদের হত্যার জন্য দোষারোপ করেছে … সকলেই আমাকে এজন্য দোষারোপ করে?’
‘তারা কেন আন্তর্জাতিক তথ্য মাধ্যমগুলোও এজন্য আপনাকে দায়ী করেছে। কেন?’
‘আমি জানি না। আমি তো একাই ছিলাম, তখন…’
‘আপনি যে বুদ্ধিজীবী হত্যার একজন তার তো সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে এবং কেউ সেগুলো এখনো অস্বীকার করেননি।’
‘আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আমি এগুলো দেখিনি।’
‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। আমার জানা মতে ঢাকার নটরডেম কলেজের সামনে একজন ডাক্তারকে হত্যা করা হয় অক্টোবরে। অনেক আগেই বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হয় যার চূড়ান্ত পরিণত ঘটে ১৪ ডিসেম্বর। তাছাড়া নিয়াজী ব্যস্ত ছিলেন রণাঙ্গন নিয়ে আর আপনি ছিলেন প্রশাসনের ক্ষমতায়।’
‘নিয়াজী ছিলেন সামরিক আইন প্রশাসক।’
‘আপনি ছিলেন বেসামরিক প্রশাসন ও রাজনীতির দায়িত্বে। যেমন গোলাম আযম বা আবদুল মান্নানের সঙ্গে আপনার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তারা আপনার সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করত, বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করত। সুতরাং আপনার জানার বাইরে ঐ সময় কিছু ঘটবে কী করে। আপনি আমার এ মন্তব্যের সঙ্গে একমত?’
‘কেন একমত হব?’
‘কেননা আপনিই তো…’
‘কিছু না বলতে কি হত্যাকে বোঝায়?’
‘আপনি প্রশাসনের ক্ষমতায় ছিলেন।’
‘না, সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পর দৃশ্যপট বদলে যায়। এ আইনে গভর্নর হাউসের নিজস্ব কোনো স্থান ছিল না। গভর্নর হাউসের নিয়ন্ত্রণ ছিল শুধু সচিবালয়, পুলিশ ও রাজাকারের ওপর। সেনাবাহিনী, ইপিসিএএফ ছিল সামরিক আইন প্রশাসক ও কোর কমান্ডারের নিয়ন্ত্রণে। আমার অধীনে কিছুই ছিল না।’
‘তাহলে সব কিছুর জন্য জেনারেল নিয়াজী দায়ী?’
‘জেনারেল নিয়াজী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়ী।’
‘কিন্তু ঘটনা যা ঘটেছে বলে জানি…’
‘শুনুন।’ আমাকে থামিয়ে বিশাল বর্ণনা শুরু করেন রাও ফরমান আলী, ‘জেনারেল শামসের ছিলেন পিলখানার দায়িত্বে। তিনি আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তিনি জানান, আমাদেরকে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে সাধারণত আমাদের কোনো বৈঠক হয় না। জেনারেল শামসেরকে বললাম, ঠিক আছে যাব। পিলখানায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে এল। সেখানে দেখলাম কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে কেন। তিনি বললেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে আমরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে যাচ্ছি, সে জন্যই গাড়িগুলো এখানে। তারপর বললেন, কয়েকজন লোককে গ্রেপ্তার করতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বললেন, কথাটা নিয়াজীকেই তুমি জিজ্ঞেস করো। এতে তোমার মত কী? আমি বললাম, স্যার, এখন কাউকে গ্রেপ্তারের সময় নয় বরং এখন কত লোক আমাদের সঙ্গে আছে সেটিই দেখার কথা।’
‘কত তারিখের ঘটনা এটা?’
‘৯ কিংবা ১০ ডিসেম্বরের ঘটনা। তারপর আমি আর কিছু জানি না।’
‘ঢাকার পতনের পর গভর্নর হাউসে আপনার একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে সেখানে নিহত বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা ছিল।’
‘কাউকে হত্যা করতে হলে কি আমি এভাবে তালিকা সংরক্ষণ করব? অনেকে আমার কাছে এসে অনেকের নামে অভিযোগ করত। যেমন তিনি এটা করছেন, ওকে সাহায্য করছেন। আমি তাদের নাম টুকে রাখতাম, এর সঙ্গে ঐ হত্যার কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘তার মানে দাঁড়ালো, আপনি বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে জানেন না, বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে জানেন না…’
কথাটা শেষ করতে দিলেন না ফরমান। বললেন, ‘গণহত্যা, গণহত্যা হয়নি।’
‘গণহত্যা হয়নি মানে কী বলতে চান?’ পাল্টা প্রশ্ন করি আমি।
‘গণহত্যা হয়নি।’
‘পৃথিবীর সমস্ত সংবাদপত্রে লিখেছে গণহত্যা হয়েছে।’
‘না ঠিক নয়।’
‘আচ্ছা জেনারেল’, প্রশ্ন করি আমি, ‘বসনিয়া, হার্জিগোভেনিয়ায় কী হয়েছে বা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলো যে খবর দিচ্ছে তা কি মিথ্যা?’
‘সঠিক খবর তারা দিচ্ছে না।’
‘আচ্ছা, গণহত্যা হয়নি। কিন্তু মানুষ তো মারা গিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ, এ রকম একটা ঘটনা ঘটলে তো কয়েকজন মারা যাবেই।’
‘আচ্ছা কত মারা যেতে পারে। দশ, বিশ, পঞ্চাশ হাজার?’ পঞ্চাশ হাজারটি জোরের সঙ্গে বলি।
‘হ্যাঁ, হতে পারে।’
আমি এ উত্তরের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ধীর কণ্ঠে বললাম, ‘জেনারেল, ৫০ হাজার লোক হত্যা যদি গণহত্যা না হয়, তাহলে গণহত্যা কাকে বলে?’
জেনারেল রাও ফরমান আলীর উত্তর দেয়ার কিছু ছিল না।

দুই.
বাংলাদেশে গণহত্যার ৩০ লাখ শহীদকে নিয়ে এতদিন কোনো প্রশ্ন ওঠানো হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে গণহত্যার চেয়েও বিচার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বার্গম্যান বা ক্যাডমান বা অন্য কেউ। কিন্তু তা ধোপে টেকেনি। গত নির্বাচনের পর থেকেই হঠাৎ গণহত্যার বিষয়টি তোলা হচ্ছে। এখানে আরো মনে রাখা উচিত, আমেরিকা এই নির্বাচন সমর্থন করেনি। হঠাৎ গত কিছুদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারেক রহমান, খালেদা জিয়া প্রশ্ন তুলছেন। গণহত্যায় যে ৩০ লাখ শহীদ হয়নি সে কথা খালেদা জিয়া প্রথম বলেছেন যা আগে কখনো বলেননি। এখন ডেভিড বার্গম্যান বিদেশের কাগজে এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাকিস্তানিরা তুলছে। এগুলো কি কাকতলীয়? মোটেই না। এর পেছনে অন্য রাজনীতি আছে। বাংলাদেশে কেন গণহত্যার বিষয়টি এতদিন চাপা পড়ে গিয়েছিল? এর একটি কারণ আমরা নিজে, অন্য কারণ, আমেরিকা, পাকিস্তান, সৌদি আরব বা চীনের দৃষ্টিভঙ্গি।
এ কথা বলা অন্যায় হবে না, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং মিডিয়া মুক্তিযুদ্ধকে সজীব রেখেছিল। তিন দশক তাদের নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার ফল আজ পাওয়া যাচ্ছে। বৈরি পরিবেশেও তো আমরা মুক্তিযুদ্ধের কাজ করেছি। আজ কি অস্বীকার করা যাবে, নতুন জেনারেশন এখন অনেক সজাগ মুক্তিযুদ্ধ, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে। যখন আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলতাম, অনেকেই আমাদের টিটকারি দিত। এ ধারাটি ছিল একেবারে ক্ষীণ। এখন কি অস্বীকার করাতে পারবেন যে এই ধারা এখন স্ফীত। বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া সারাদেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলব আমাদের রাজনীতিটাও স্পষ্ট করতে হবে। আমাদের পরিষ্কার ভাষায় বলতে হবে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না তারা পাকিস্তানমনা। তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তাদের রাজনীতি অপরাজনীতি। দেশের ক্ষমতা কিছুতেই তাদের হাতে হস্তান্তরিত করা যায় না। এ ক্ষেত্রে আপসের সংস্কৃতি বিসর্জন দেয়াই বিধেয়।

মুক্তিযুদ্ধের জন্য শেখ হাসিনাই সবচেয়ে বেশি করেছেন এ কথাটাও মুক্তভাবে বলতে হবে। মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক তৈরি, মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবারদের ভাতা বৃদ্ধি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তিনিই বেশি দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বঙ্গবন্ধু করতে পারেননি কিন্তু তার কন্যা সেটা করে দেখার সাহস দেখিয়েছেন। তখন বিদেশি যারা মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করেছিলেন তাদের সম্মাননা দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। ব্যক্তি উদ্যোগে যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে উঠেছিল তা স্থায়ী ভবনে স্থানান্তরে শ’কোটির টাকার বেশি সাহায্য করেছেন শেখ হাসিনা। আমরা কয়েকজন খুলনায় যখন ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলাম তখন তিনি একটি ছোট বাড়িসহ খানিকটা জমি দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে তার কাছে গিয়ে কেউ ফেরত এসেছে শুনিনি। কিন্তু একই সঙ্গে আমার মনে হয়েছে আমলাতন্ত্র মুক্তিযুদ্ধ-বান্ধব নয়।

প্রশ্ন হলো সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে কেন? আমরা যার যার অবস্থান থেকে তো কাজ করতে পারি। আমরা ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের জন্য আন্দোলন করেছি। এখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হবে। তবে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও কিছু কাজ প্রয়োজন। যেমন-

১. পাকিস্তানে বা অন্য কোনো দেশে সরকারিভাবে মুক্তিযুদ্ধ বা গণহত্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে সরকারের কঠোরভাবে তা প্রতিবাদ করা উচিত যা আগে করা হয়নি তেমনভাবে।

২. মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল অটুট রাখা। এবং যেখানে তা হচ্ছে সেই ইমারতটিকে গণহত্যা জাদুঘরে পরিণত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ।

৩. গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারাদেশে যেসব উদ্যোগ বেসরকারিভাবে নেয়া হয়েছে সেগুলোকে সহায়তা করা।

৪. জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা। এ সংক্রান্ত আইন তৈরি হয়েছে কিন্তু সরকার তা এখনো আমলে নিচ্ছে না।

৫. মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার নিয়ে বা গণহত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে শাস্তির সম্মুখীন করা। এ সংক্রান্ত আইনও প্রস্তুত করেছে ল’কমিশন কিন্তু সরকার তা আমলে নিচ্ছে না।

৬. কয়েক বছর আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত স্থান সংরক্ষণে যে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট তা বাস্তবায়ন করা। হাইকোর্টের সেই মাইলফলক রায় দিয়েছিলেন বর্তমান ল’কমিশনের প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ও প্রেস ইনস্টিটিউটের সভাপতি বিচারপতি মমতাজউদ্দীন।

৭. ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ ডাকবিভাগকে প্রস্তাব দিয়েছিল গণহত্যা সংক্রান্ত ৭১টি ডাকটিকেট প্রকাশ করার। দেশে-বিদেশে গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়ে এটি অন্যতম হাতিয়ার। প্রধানমন্ত্রী এতে সম্মতি দিয়েছেন। ২৫ মার্চ যেন তা সাড়ম্বরে প্রকাশিত হয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যেন তা স্থগিত হয়ে না যায়।

৮. আরো কয়েক বছর আগে যদি সরকারিভাবে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালিত হতো তাহলে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো ২৫ মার্চও আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষিত হত্যা। কিন্তু জাতিসংঘ ইতোমধ্যে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং এখন গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কাজ করতে হবে। এজন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে [অর্থাৎ সংসদে বা সরকার যদি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়] এই গণহত্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না।
৯. ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস যাতে উপজেলা পর্যায়ে পালিত হয় তার ব্যবস্থা করা। মুক্তিযুদ্ধ সজীব রাখতে সরকারকে সব করতে হবে তা নয়। বিজয় দিবস এলে কি দেখেননি, সারাদেশে রাস্তায় রাস্তায় পতাকা বিক্রি হয় হু হু করে। রিকশাওয়ালা থেকে গাড়িওয়ালা সবাই রিকশা বা গাড়ির স্ট্যান্ডে একটি পতাকা লাগায়। অনেকে ছাদে ওড়ায়, তরুণরা মাথায় ব্যান্ড বাঁধে। মুক্তিযুদ্ধের ফ্যাশন [মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাপড়ের ফ্যাশন] নিয়ে মেতে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের জমিন এখনো উর্বর। ফসল বুনতে পারলেই হয়। এর অর্থ, আমরা যে যার পেশায় আছি, যে যেই এলাকায় আছি যদি একটু উদ্যোগ নেই ছোট ছোট কাজগুলো করার, তা হলেই তা বিরাট কর্মযজ্ঞে পরিণত হবে। শুধু একটু ইচ্ছা। একটু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
মুক্তিযুদ্ধ যখন হয় তখন যৌবনে পা দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ যখন মৃতপ্রায় তখন মধ্য যৌবনে। আমাদের জেনারেশন সেই মুক্তিযুদ্ধ সজীব করার জন্য চেষ্টা করেছি। আজ প্রৌঢ়ত্বে পড়ে অনুধাবন করছি, বিজয়ী হয়েও হয়তো অনেক কিছু করতে পারিনি কিন্তু একেবারে কিছু করতে পারিনি তা নয় বা সব কিছুই বৃথা যায়নি। বৃথা যায় না। একটি জেনারেশন তৈরি হয়েছে। আমাদের আরাধ্য কাজ হয়তো তারা এগিয়ে নেবে।
আমাদের সব জানালা খোলা রেখেছি। আমরা বিজয়ের গান শুনব। বিজয়ীরা কখনো পরাজিতের গান শোনে না। পরাজিতের সঙ্গে হাত মেলায় না। বিজয়ীরা বিজয়ী থাকব থাকবে, এবং ক্রমান্বয়ে খালি বিজয়ের গানই রচিত হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।