নারীমূর্তি, হেফাজত আর তাসের ঘরে ইতিহাসের পাঠ


প্রকাশিত: ০৩:৫৫ এএম, ২২ মার্চ ২০১৭

হাইকোর্টের সামনে লেডি জাস্টিসের ‘মূর্তি’ নিয়ে হেফাজতে ইসলামীর আপত্তি এখন রাষ্ট্রীয় পেরেশানিতে পরিণত হয়েছে। হেফাজতকে তুষ্ট রাখা রাষ্ট্রযন্ত্র এখন শেষ পর্যন্ত কী করবেন, সেটা দেখার অপেক্ষাতেই হয়তো আছি আমরা। এর আগে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে হেফাজতের আবদার মেটানোর ব্যপারে সরকারের ত্বরিৎ পদক্ষেপ আমরা দেখেছি।

সরকার হয়তো ভেবেছিল, তাদের চালাকিটা খুব সূক্ষ্ণ হচ্ছে আর আমরা এসবের কিছুই বুঝতে পারবো না। সমস্যা হল, সরকার তার প্রাগৈতিহাসিক রাজনৈতিক চাল আর সংস্কৃতিকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেই শুধু রাখে না, সেই সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পুরো দেশের আপামর জনগণকে গোমূর্খ মনে করে। এখন পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘নাস্তিক’ ও ভিন্ন ধর্মের কবি সাহিত্যিকদের লেখা উধাও করে দিয়ে, ও তে ওড়না, অ তে অযু চালু করে, প তে প্রণাম ভ্যানিশ করে দিয়ে সরকার হয়তো ভেবেছিল, এইসব দেখার এবং তারচেয়ে বড় কথা বোঝার ক্ষমতা ও সময় জনগণের নাই।

হয়তো জনগণ ব্যস্ত আছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, চালের দাম কমে যাওয়ার মত ঘটনায়। কিন্তু সমস্যাটি হল, আমাদের সংসারে গ্যাস তেল চাল ডাল নূনের মতই সন্তানেরই লেখাপড়ার ঘটনাটিও আমাদের ভাবায়। আর ভাবায় বলেই হয়তো জনমানুষের একটা বড় অংশ সরকারের দ্বারা পাঠ্যপুস্তকের এই হেফাজতী মৌলবাদীকরণ ঘটনাটির জোর প্রতিবাদ করে গেছে। অবশ্য লাভের লাভ কিছু হয়নি তাতে। সরকার তো আপোসহীন, কঠোর কঠিন। আমরা জনগণ গুড়ে মেখে দিনরাত শুধু উন্নয়নের ছাতু খাচ্ছি। সেই ছাতুটাই আমাদের মুখে জড়িয়ে আঠা হয়ে লেপ্টে আছে। তাই বেশি কথা কওয়াও মুশকিল।

তো হেফাজতে ইসলাম বিখ্যাত পাঁচই মে শাপলা চত্বরে যে খেল দেখিয়েছিল, এরপর কেমনে তারা সাইজ হইলো আর ক্যামনে সবকিছুর ভিতরে ছোট্ট সূঁচের ফলা হয়ে ঢুকে গেল, তা তো দেখলুম। এখন সেই সূঁচ সরকারের নরম গদির নিচে ঢুকে ক্রমাগত খোঁচাইতেসে। এটা কর, ওটা কর, এটা বন্ধ কর, সেটা বন্ধ কর। তো সেই ধারাবাহিকতায় আসছে লেডি জাস্টিসের মূর্তিখানা।

এখন হাইকোর্টের সামনে এক নারী মূর্তি হেফাজত মেনে নেবেই বা কেন? হেফাজতের দর্শন, আদর্শ, চিন্তাধারা তো তাদের পথেই আছে। তারা তো আর ভোল পাল্টায় নাই। নিজেদের ভোলের ভিতরে থেকেই তারা দাবি তুলেছে। এখন তাদের সমস্যা তো মূর্তি বা ভাস্কর্য না, সমস্যা নারীতে, নারীর ভাস্কর্যে। দেশজুড়ে মূর্তি ভাস্কর্য তো কম নাই। হাইকোর্টের সামনে এই ভাস্কর্য তাদের গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে কেন? দুইটা পয়েন্ট। এক. তাদের একটা ইস্যু প্রয়োজন, পর্দার আড়াল থেকে কেউ তাদের খেলাচ্ছে বটে। সেই খেলাটা ব্যাটে বলে মিলেছে পয়েন্ট দুইতে এসে। সেটি হল, নারী। ন্যায়বিচারের মত একটি “পুরুষালি” কর্মকাণ্ডে নারীকে তার প্রতীক হিসেবে স্থাপন হেফাজতের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন বটে।

তার উপর নারীর শরীর- হোক না সে পাথরে তৈরি, হোক না তা প্রাণহীন, সে তো নারী শরীরই, নাকি? সেই নারী, যারে দেখলেই এইসব পুরুষের মনে পড়ে যায়, এর যোনি আছে, স্তন আছে, পেট বুক পা আছে, যা দেখলেই পুরুষের যৌনাঙ্গে এমন আলোড়ন শুরু হয়ে যায় যে আর কোন কাজই তারা সেরে উঠতে পারে না সেই বেলা। এখন হাইকোর্টের সামনে এমন এক নারী যদি দুই হাতে দাঁড়িপাল্লা ধরে দিনরাত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে তাদের তো সমস্যা হবেই। এই সহজ কথাটা সরকার বোঝে না ক্যানো?এখন যারা হেফাজতরে খেলায় নিতে চায়, তারা ঠিক আসল জায়গাটি ধরে নাড়া দিয়ে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। একটা সহজ আর সরল হিসাব।

তো আর কি, হেফাজতে ইসলামের সাথে যুক্ত হয়েছে ওলামা লীগ। সরকারকে নাকি পনেরো দিন সময় বেঁধে দিয়েছে। মূর্তি ফালাও। এখন এরশাদ সাহেবও সময়মত হাজিরা দিয়ে গেছেন, যদি কিছু পাওয়া যায়- এই আশায়। তো এখন জনগণের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী করার আছে? মূর্তি নামবে কি নামবে না! যদি হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে লেডি জাস্টিসের মূর্তিটি সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে আমাদের হিসাবটা পুরোপুরি মিলিয়ে নেয়াটা সহজ হয়। এতদিন বিএনপি সুযোগ পেলেই ভারতের কাছে আওয়ামী লীগ দেশ বিক্রি করে দিয়েছে বলে শোর তুলত। এখন পর্যন্ত কোনদিন বিএনপি বা আর কোন রাজনৈতিক দলকে বলতে শুনলাম না, সরকার হেফাজতকে বগলের তলায় নিয়ে নিয়েছে; একেবারে বন্ধুর মত, আপন আত্মীয়ের মত, যে সংসারে আশ্রিত থাকতে থাকতে সংরারেরই একটা অংশ হয়ে যায় একসময় আর নানা ব্যাপারে মতামত দেয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করে।

এখন সরকার বাহাদুর কী করবেন, দেখি। পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ, ভাস্কর্য অপসারণের মত বড় বড় বিষয়ে হেফাজতের প্রকাশ্য আবদার মেটাতে সরকার কতটা নিচে নামতে থাকেন, আমরাও দেখি। আমরা তো দর্শক। আমাদের ভোটও এখন আর তত মূল্যবান নয়। আমরা উন্নয়ন দেখি, সেতু ব্রিজ, ফ্লাইওভার, হাসপাতাল, রেমিটেন্স দেখি। দেখতে দেখতেই একদিন হয়তো দেখবো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অপসারণ দাবি করেছে হেফাজত, ওলামা লীগ। কারণ তিনি নারী।

রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকীকরণ, মৌলবাদীকরণের বাইরে আপনারা রয়ে যাবেন, এমন ভাবার কোন কারণ নাই। আপনারা হিসাবের ভিতরেই আছেন। চালে আপনারা যত পটুই হোন না কেন, মনে রাখবেন, ওরাও বিন্দু বিন্দু জমাচ্ছে জলকণা, একদিন সর্বনাশা বাঁধ ভেঙ্গে সেই কালস্রোত ভাসিয়ে নেবে আপনাকেও। তখন ক্ষমতার লোভ আর আপন জান বাঁচানোর চিরাচরিত তাগিদে স্রোতের সাথে যাত্রা করবে আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকটিও, যার বা যাদের পরামর্শ আর বিবেচনাবোধে আস্থা রেখে আপনি একের পর এক এমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন যা আতংকিত করছে আমাদের মত আমজনতাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নটা প্রতিনিয়ত মুখ থুবড়ে পড়ছে। জানি না, কবে এই আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ হবে। জানি না কবে সুস্থ রাজনীতির রাস্তা থেকে সরে আসার এই অশুভ তৎপরতা আপনাদের কাছে অশনি সংকেত পাঠাবে। জানি না কবে ক্ষমতার অন্ধগলিতে পথ হারানোর দিন শেষ হবে।

আমাদের প্রত্যাশার পথটিও সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। আমরা আজ কথা বলতেও ভয় পাই। আমাদের সন্তানদের জন্য কোন সে বাংলাদেশ আমরা রেখে যাব, জানি না। তার দায়ভার বর্তাবে পুরোটাই আমাদের ওপরে। যুগ যুগ ধরে আমরা ক্ষমতার রাজনীতি, মিথ্যা দেশপ্রেম, ধর্মের অন্ধ গোলামি আর সেই ধর্মকেই ব্যবহার করে উপরে ওঠার নোংরা প্রতিযোগিতার ভিতরে সেঁধিয়ে গেলাম। আমদের টেনে তোলার কেউ নাই, আমরা নিজেরা ছাড়া।
প্রতিবাদ তাই জারি থাকবে। প্রতিরোধও আসবে, বিশ্বাস করি। সকল মৌলবাদ, ধর্মের নামে অন্ধত্ব, গোঁড়ামি আর নোংরামির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিবাদ করবোই। বাকিটুকু আপনাদের। একটি তাসের ঘরের ভিতরে নিজেদের স্থাপন করে আপনাদের কী হাসিল হবে শেষ পর্যন্ত তা হয়তো ভবিষ্যৎ বলে দেবে। তার আগে পর্যন্ত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনারা শুধু সতর্ক আর সচেতন হতে পারেন, আমাদের জন্য না হোক, অন্তত নিজেদের জন্য!

লেখক : লেখক : প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ।

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।