আট মাসের শিশু ধর্ষণ বাহ!


প্রকাশিত: ০৪:১১ এএম, ২০ মার্চ ২০১৭

আনন্দের আর সীমা নাই আমাদের। আট মাসের শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। গাজীপুরে ঘটেছে এই ঘটনা। ধর্ষক সেলিম মিয়ার বয়স ৪০ বছর। এই সপ্তাহেই পাঁচ বছরের আরেকটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ব্র্যাকের এক গোল টেবিল বৈঠক থেকে জানা যায় গত বছর গড়ে প্রতিদিন ১.৭ জন মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার  হয়েছে। শূন্য থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুরাও রেহাই পায়নি এই নির্যাতন থেকে। এর আগে দিনাজপুরের একটি পাঁচ বছরের মেয়ে শিশুর উপর বীভৎস ধর্ষণের খবরে স্তম্ভিত হয় দেশ। তারপরও তোফা মনি নামে আরেকটি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।

গত সপ্তাহে আরেকটি খবর হলো রাজধানীতে ডাস্টবিনে এক নবজাতককে জীবিত অবস্থায় ফেলে দিয়ে গেছে কে বা কারা। শিশুটি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। শিশুটির নাম রাখা হয়েছে জয়িতা। যদিও সারা রাত ডাস্টবিনে পড়ে থাকা শিশুটির নিওমোনিয়া হয়ে গেছে। জয়িতা বাঁচবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়।  কতখানি পাষণ্ড হলে নবজাতক সন্তানকে ফেলে দিতে পারেন বাবা-মা। ধরে নিলাম শিশুটি তারা বাবা-মায়ের বিবাহিত সম্পর্কের ফসল নয়। তাতে কি, যে শিশুটির জন্ম হলো তাকে কেন পরিত্যাগ করতে হবে? যে সমাজ মাকে ঠেলে দেয় এমন হন্তারকের ভূমিকায় সেই সমাজকে কি সভ্য বলা যায় কোনোভাবে?

কিছুদিন আগে আরেকটি শিশুর মৃত্যুর খবরও পত্রিকায় এসেছে। এই শিশুটির মা মানসিক রোগী আর বাবা দরিদ্র শ্রমজীবী।

শিশুটিকে মান্নান নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে দেওয়া হয়। সে বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয় মেয়েটি। কিন্তু তাকে চিকিৎসা না দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে থানা তারপর হাসপাতাল। অবশেষে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শিশুটির মৃত্যু। খবরগুলো পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম যে সমাজে শিশুর উপর এমন নির্যাতন ঘটে সে সমাজকে কি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সভ্য বলে অভিহিত করা চলে?

শুধু যে মেয়েশিশুর উপর নির্যাতন চলে তাতো নয়। ছেলে শিশুরাও নিরাপদ নয় এ সমাজে। রাজন, রাকিব এদের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি পাঠক। রাকিবের পরও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জে  এক শিশু শ্রমিকের উপর। মারাও গেছে ছোট ছেলেটি।  ধর্ষণের এর শিকার হচ্ছে ছেলে শিশুরাও। প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ছে একটি ঘটনা। প্রায় বছর চল্লিশেক আগের ঘটনা। আমাদের বাড়িতে এক গৃহকর্মী কাজ করতেন। স্বামী নেই। ছোট ছেলেটিকে দিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। কারণ তাকে খাওয়া পরা দেওয়ার সামর্থ্য তার ছিল না। মাদ্রাসায় ফ্রি খাবে, লেখাপড়া করবে। কিছুদিন পর শিশুটির মৃত্যুর খবর আসে। দশবছরের ছেলেটি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গিয়েছিল। আমার চোখে আজও ভাসে ছেলেটির মায়ের বুকভাঙা কান্না। সেদিনের থেকে খুব কি এগোতে পেরেছি আমরা?

শিশুর প্রতি আচরণে যে সমাজ যত মানবিক সে সমাজ সার্বিকভাবে ততো উন্নত। যে সমাজে শিশুরা নিরাপদ নয় সে সমাজ ‘সভ্য’ নয় কিছুতেই।

এখনও আমাদের সমাজে ঘরে ঘরে শিশু গৃহকর্মী রাখা হয়। সমাজের নামীদামী ব্যক্তিরাও পরিবারে একটি বা দুটি শিশু গৃহকর্মী রাখেন। বেশিরভাগ সময়েই শিশুটির দরিদ্র অভিভাবককে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, বড়লোকের বাড়িতে ও খেয়ে পরে ভালো থাকবে, লেখাপড়াও শিখবে। অভিভাবকের হাতে কিছু টাকা দিয়ে যেন কিনে নেওয়া হয় শিশুটিকে। তারপর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার উপর চলে নির্যাতন। পরিবার ছেড়ে আসা একটি শিশু। তাকে মানসিক নির্যাতন করা হয় অহরহ। তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়, ব্যাঙ্গাত্মক নামে ডাকা হয়। বেতন কখনও হয় নামমাত্র আবার কখনও কিছুই দেওয়া হয় না। ভালো খাবার দাবার? ফ্রিজের যত পঁচা বাসি খাবার জোটে তার। থাকতে দেওয়া হয় রান্নাঘরে। অনেক আগে একটি সিনেমা দেখেছিলাম ‘খারিজ’ নামে। এক শিশু গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনাকে কিভাবে হত্যা মামলা থেকে ‘খারিজ’ করে দেওয়া হয়  সেটি ছিল ছবির মূল উপজীব্য।

এমন ‘খারিজ’ অহরহ ঘটছে আমাদের সমাজে। কিছুদিন আগে এক ক্রিকেটারের বাসায় শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের পরও মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে। কারণ শিশুটির অভিভাবক খুব অল্পটাকায় বিক্রি হয়েছেন।  একটি ছোট শিশু আমার বাড়িতে কাজ করবে আর আমি পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকবো, ওকে মারবো, আহত করব, মেরেও ফেলবো, তারপরও নিজেকে মানুষ বলে দাবি করব, সেমিনারে বড় বড় কথা বলবো, সেলিব্রিটি হিসেবে সমাজের আদর কুড়াবো-এটা কোন জাতের সভ্যতা?  কেন শিশু গৃহকর্মী রাখার বিষয়ে কঠোর হতে পারছে না রাষ্ট্র? কোনো অবস্থাতেই শিশুকে দিয়ে শ্রম করানো চলবে না এমন আইন কেন বাস্তবায়ন করতে পারছি না আমরা?

এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যেতে চেয়েছিলেন কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তারপরও অনেক বছর পার হয়েছে। আমাদের দেশ আজও শিশুর বাসযোগ্য হয়নি। আট মাসের শিশু ধর্ষণের এই খবর শুনে আমার বলতে ইচ্ছা করছে বাহবা সমাজ, কি চমৎকার শিশু-বান্ধব তুমি! ক্যানিবলরা মানুষের মাংস খায়। আমরা তাদের চেয়ে কম কিসে? আমরা আমাদের শিশুদের হত্যা করি। জন্মমাত্র তাদের ফেলে দেই ডাস্টবিনে, তাদের ধর্ষণ করি, তাদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাই, তাদের পিটিয়ে মারি, তাদের বাতাসের মতো ফুলিয়ে বেলুন বানাই।

আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সচেতন মানুষের এবার শিশুরক্ষায় পথে নামার সময় হয়েছে। আসুন প্রতিজ্ঞা করি যতদিন সমাজের প্রতিটি শিশুকে নিরাপদ করতে না পারব, ততোদিন ঘরে ফিরবো না।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।