‘একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না !’


প্রকাশিত: ০৪:২৫ এএম, ১৫ মার্চ ২০১৭

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মামলার রায়ে বেশ কিছুদিন তোলপাড় হলো। স্লোগান ছিল “একটা দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না।” কান্নাটা কিন্তু দুর্ঘটনায় আহত নিহতের পরিবারের শুধু না। যার হাতে এই দুর্ঘটনা ঘটে গেল তার নিজের ও তার পরিবারেরও, অন্তত সভ্য আইনে তাই বলে। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় প্রতিটা যানবাহন এবং পথচারীকে দেখে মনে হয় জীবনের দাম খুবই গৌণ।

বিস্ময়ের বিষয়, দেশে সপ্তাখানেক কাটাবার পর আমিই যখন রাস্তা পার হয়ে অপরপাশে আমার অপেক্ষমান গাড়িতে উঠতে যাই খুব আহামরি সতর্কতা মনে হয় না মেনে চলি। যস্মিন দেশে যদাচার! অথচ,জাপান থেকে প্রতিবার দেশে আসার পর কয়েকদিন পথে ঘাটে ভয়ে চোখ বন্ধ রাখি। গায়ে গায়ে সব যানবাহন, ধুম করে চলন্ত গাড়ির সামনে পথচারীর লাফ, কোনদিকে না তাকিয়ে; বিশেষ করে গার্মেন্টস বহুল মিরপুর এলাকায়। অন্যদিকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা গণপরিবহন অপ্রতুল, অনিরাপদ। সকাল বিকাল অফিসগামী যাত্রীর ভোগান্তির সীমা নাই। খাঁচায় মোড়া চলন্ত সিএনজির ছাদ ফুঁড়ে ছিনতাই ঘ্টছে। অগত্যা ধারদেনা করে কেনো নিজের গাড়ি। প্রবল চাহিদার মুখে গাড়িও অনুমোদন পেয়ে বা না পেয়ে রোজ নেমেই যাচ্ছে, চাহিদার মুখে লাইসেন্স পেয়ে না পেয়ে ড্রাইভারও নামছে।

আনুপাতিক হিসাবে ভূমির প্রয়োজনীয় রাস্তার চেয়ে রাস্তা কম, এই রাস্তায় রোজ বাড়ছে গাড়ি, বাড়ছে জ্যাম। খানা খন্দ, সংস্করণও চলছে হুটহাট। গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় পর পর নাইট শিফট করছে দূরপাল্লার ভারী বাহন। এক ড্রাইভারের কাছে শোনা, সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন লেখা কোন ট্রাক নাকি সর্বনিম্ন ১৭ টনের নিচে মাল নেয় না। এখন এই ১৭ টন মাল টানতে ইঞ্জিনের কতটুকু শক্তি প্রয়োগ করতে হচ্ছে! এবং নির্ঘুম কয়েকরাত গাড়িটানা এক চালক এবং এই বিপুল শক্তিতে টেনে নেয়া তার ট্রাকের সামনে আচমকা কিছু এসে গেলে তাৎক্ষণিক ব্রেক কষলেও এই মোমেন্টাম থামাতে ট্রাক কতদূর চলে যাবে স্বাভাবিক হিসেবে পাঠক বলেন।

আমি খুনি ড্রাইভারের সাফাই গাইবোনা। খুনের শাস্তি সর্বোচ্চ । কিন্তু এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যদি কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জায়গাই না রাখে তো খুনের বদলা তো খুন হয়ে গেল, বিচার হলো কোথায়? প্রথম থেকে আসি, কেন রাস্তা অপ্রতুল, কেন এত ঘনবসতির দেশে প্রাসাদ সাইজের বাসাবাড়ি আর স্থাপনাতে সব বেদখল হবে যে রাস্তা হবে এতো অপ্রতুল? পাবলিক ট্রান্সপোর্টে জনগণের ভোগান্তি কেন হবে? চালকের মর্জির কাছে কেন হাতে পায়ে ধরা জিম্মি হতে হবে যাত্রীকে? তারা তো পয়সা দিয়েই সেবা নেবে, নাকি?

দোকানে পয়সা দিয়ে শাড়ি কিনতে গেলে দোকানী কি বলতে পারবে শাড়ি এটা আপনার কাছে বেচবোনা? কেন একজন মানুষের জন্য একটা করে গাড়ি রাস্তায় নামতে বাধ্য হতে হবে? এরপর আসে সড়ক ব্যবস্থা। উল্লেখ্য , বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় উপরের সারিতে ঢাকার নাম থাকলেও সবচেয়ে বাজে রাস্তা, সবচেয়ে বাজে ড্রাইভিং , সবচেয়ে বেশি রোড এক্সিডেন্ট এর কোন তালিকাতেই কিন্তু অন্তত প্রথম ১০/১৫ টা দেশের মধ্যে আমাদের নাম নেই।

জাপানে এসে প্রথম মনে হত অন্ধ বা শিশুরাও এদেশে নিশ্চিন্তে গাড়ি চালাতে পারবে, এতো নিয়ম শৃঙ্খলা। কিন্তু এই জাপানও সবচেয়ে নিরাপদ সড়ক, কম এক্সিডেন্টে ১৫ তম কেবল। তবুও লক্ষ্য করি উল্লেখিত গলদগুলির এইখানে কি উপশম। ভূমি বণ্টনে বাসাবাড়ির সাইজ উল্লেখ করতে হচ্ছে। এদেরও জনসংখ্যা বেশি। তথাপি, আমাদের দুই তৃতীয়াংশ। সমুদ্র থেকে জমি আহরণ করে। তাও সব অনুর্বর জমি। সাগরঘেরা এক দ্বীপের দেশ। ভূমি এখন আমাদের তিনগুণ। হিসাবমতে জনবসতি আমাদের অনুপাতে ১:৬ ।

এদের স্ট্যান্ডার্ড বাসা হয় ৫০০ স্কয়ারফিট । জ্বি, ৪ জনের পরিবারের মধ্যবিত্তের বাসা, একা লোকের স্টুডিও অ্যাপার্টম্যান্ট না । টয়লেট বেসিন বাথরুম একটা করে। বাসা যদি সেটা উচ্চ বা উচ্চ মধ্যবিত্তের ১০০০ স্কয়ার ফিটেও হয়, তাতেও বাথরুম, বেসিন- এসব একটাই। বাসাপ্রতি একটা গ্যারেজ, যার আলাদা উচ্চমূল্য ভাড়া। এছাড়া যেখানেই যাও, পার্কিং মূল্য অনেক। বড় শহরে তা এতোই বেশি যে গাড়ি রাখার বদলে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত ছাড়া গত্যন্তর নাই। স্কুল নবম শ্রেণি ( জুনিয়র হাই স্কুল ) পর্যন্ত সরকারি এবং এলাকার স্কুলে পড়তে এবং হেঁটে যেতে বাধ্যতামূলক বলে বাচ্চাদের সকালের স্কুলযাত্রার বিশাল গাড়ি সমাবেশ নাই।

এবারে আসি লাইসেন্স। আমার বর ঢাকার রাস্তায় দীর্ঘ ৭ বছর সুদক্ষ চালকের অভিজ্ঞতা নিয়েও ৪ বার পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে। ১১, ১২ বারেও পাশ করেনা এমন নজিরও আছে। এবং সেই পরীক্ষা দিতে যেতে গোটা ১ দিন খারিজ হয়। বরাদ্দ ছুটি কাটা যায়। আমি জীবনে বহু পরীক্ষা পাশ করেও জাপানিজ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাস করতে ১০০ রাকাত নফল নামাজ, ৪ টা নফল রোজা মানত করে নাকের পানি চোখের পানি এক করে অফিস থেকে ৫দিনের ছুটি নষ্ট করে গেছি। দেশে ড্রাইভ করিনি বলে এর আগে ট্রেনিং স্কুলে মোটা টাকা গচ্চা দিয়ে ক্লিয়ারেন্সও পেতে হয়েছে। আর সবার আগে পাশ করতে হয় যে লিখিত পরীক্ষা তাতে রুলস গুলিয়ে খাইয়ে দেয়। যতোবার লাইসেন্স নবায়ণে যেতে হবে ততোবার সারাদিনের এই ক্লাস। এবং এর মূল কারণ, আপনাকে হাড়ে মজ্জায় বুঝিয়ে দেয়া, যে, ড্রাইভিং একটা অত্যন্ত কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং স্পর্শকাতর দক্ষতা।

সাইকেল আরোহী বা পথিক যদি চলার নিয়ম না জানে তো সে একাই মারা যাবে । কিন্ত ড্রাইভার ভুল করলে তার সাথে ঝুঁকিতে যাবে অনেকগুলি প্রাণ। এই ড্রাইভিং লাইসেন্স টেস্টে এটাও দেখা হয় ড্রাইভার যে কোন প্রাণের প্রতি মনোযোগী এবং দায়িত্বশীল কিনা । সে চালাবার শুরুতেই তার গাড়ির নিচে বেড়াল কুকুর বসে আছে কিনা, দেখে নিচ্ছে কিনা। তার হর্নে বা চালানোর স্পিডে যদি পথচারী, সাইকেল বা মোটরসাইকেল আরোহী ঘাবড়ে যায় বা তার ওপরে পড়ে তো তারই দোষ। ওভারস্পিড, ওভারটেক, মোবাইল রিসিভ করা সব কিছুতেই জরিমানা, ২ ঘ্ণ্টা দাঁড়িয়ে পুলিশের লেকচার শোনা, লাইসেন্সের পয়েণ্ট কাটা থেকে লাইসেন্স বাজেয়াপ্তও আছে। নিয়ম না মেনে “পালাবি কোথায়”? আর আমাদের দেশে শুধু গরু ছাগল চিনলেই লাইসেন্স! জীবনের দাম এত কম! আজকে ধর পাকড় , লাইসেন্স আর গাড়ির ফিটনেস চেকিং হচ্ছে, যাদের গলদ আছে ( বেশির ভাগেরই ) সব এখন গা ঢাকা দেবে, পরে আবার যেই কে সেই।

দেশকে দেখতে এখন সত্যিই অনেক ভাল লাগে, কারণ, ২০০৯ তে যেই দেশ রেখে গেছি, তাতে অনেক পরিবর্তন দেখতে পাই। উড়াল সড়ক, দামী গাড়ি, স্থাপনা, ম্যুরাল, আলোকসজ্জা। কিন্তু শৃঙ্খলার অভাব যা দেখে গেছি তাই, হয়তো আরো খারাপ। নিয়মনীতি নাই। তবে জোর গলায় বলছি, বইমেলার সাক্ষাৎকারেও বলেছি, আমাদের বাক স্বাধীনতা আছে। অবশ্যই আছে, নাহলে এতো বেসরকারি চ্যানেল, অসংখ্য পত্রিকা, নিউজ পোর্টাল, ব্লগ এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যে কোন অনিয়মের তুলা ধুনা করতে পারতোনা, কেউ বরদাশত করতো না। বাকস্বাধীনতা যখন আছে তখন আশাও আছে এসব কথা একদিন কর্তা ব্যক্তির কাছে পৌঁছাবে, যে কোন অগ্নি স্ফুলিঙ্গে ধর পাকড় সমাধানে না গিয়ে একটা একটা সমস্যা যেগুলির একে অপরের সাথে ওতপ্রোত মিশে গেছে, সেই জট খুলতে উদ্যোগী হবে।

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।