উন্নত দেশেই জেনেছি আমাদের নারীরাই অদম্য বহ্নি শিখা


প্রকাশিত: ০৪:৩৩ এএম, ০৮ মার্চ ২০১৭

সাল ২০১৩, ৬ই জুলাই । দেশের জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক খবরে আমি বিস্মিত। “সাবেক বিশ্বসুন্দরী যুক্তামুখীর সম্প্রতি তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা ।” বিশেষত পরের লাইনঃ স্বামীর পাশাপাশি শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের বিরুদ্ধেও যৌতুকের জন্য গায়ে হাত তোলার অভিযোগ করেছেন তিনি।

একজন বিশ্বসুন্দরী যদি যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে তো এই উপমহাদেশের মেয়ে হিসেবে আমি যে এমন কোন নির্যাতনের শিকার হইনাই, আলহামদুলিল্লাহ, এই জন্যই তো আমার দিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ২ রাকাত করে অতিরিক্ত নফল নামাজ পড়ার কথা!  আদতে আমার স্বামী বিয়ের সময় এই একটা ব্যাপারেই খুব কঠিন ছিলেন যে “একমাত্র মেয়েকে খুশি হয়ে দিলাম” ফর্মেও যেন এমন কোন কিছু তাদের বাড়িতে না ঢুকে।  

তবে, হ্যাঁ পণপ্রথার এই ভয়াবহতা ভবিষ্যত সুপার পাওয়ার ভারতেই সবচেয়ে প্রকট। এজন্যই ভারতে মেয়ে শিশুর ভ্রূণহত্যার হার এখনো  প্রকট, যেটা আমাদের দেশেও হয় না। তা সেটা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ইসলামে ভ্রূণহত্যা নিষিদ্ধ বলেই বা যে কারণেই হোক।  এছাড়া হিউমেন ইন্ডেস্কেও আমরা ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে।  তবে এই যে এই উপমহাদেশসহ আরো অনেক দেশে যৌতুক এখনো ভালভাবেই প্রচলিত আছে- এটাই হতাশাজনক। আরবদের ক্ষেত্রে বরের বাড়ি কনের বাড়িতে যৌতুক দেয়। কোনদিন নজরেও আসেনি সেক্ষেত্রেও বরকে যৌতুক অনাদায়ে কনের বাড়ির লোক অত্যাচার করেন কিনা, মেরে ধরে আগুনে পুড়িয়ে দেয় কিনা সন্দেহ।

আর এই উপমহাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের প্রকৃত পরিসংখ্যান এ ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স কতটা নথিভুক্ত হয় সেটাও এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। কারণ অনেক শ্রেণির মানুষের কাছেই এখনো , “ জামাই মারবে না তো কে মারবে?” মানসিকতা। মেয়েরা যেন পরিবারে সেকেন্ড ক্লাস সদস্য, তাকে মারধোর, হেয় করা জায়েজ। এখন আমার দেশের একটি মেয়ের মনেই  হবে, আহা উন্নত বিশ্বে মেয়েরা কত সুখে আছে! যৌতুকই নাই, তো আর নির্যাতন। কোন ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য নাই। তাদের উদ্দেশ্যে বলি, পার্থক্য অন্যখানে। আমাদের দেশে মেয়েরা রাস্তা ঘাটে চলতে পারে না যে নোংরা দৃষ্টির জন্য, তা আমি উন্নত দেশ জাপানে কখনই দেখি নাই। রাত সাড়ে ১২টায় নিশ্চিন্তে হেটে “7-11”  জাতীয় ২৪ ঘণ্টার কনভেনিয়েন্ট স্টোর থেকে সদাই কিনেছি, রাত ১০টা/১১টায় সান্ধ্য ভ্রমণে যাই। কোন নোংরা দৃষ্টি বা অস্বস্তিকর বা অনিরাপদ বোধ আমার চলার পথে অনাকাঙ্খিত সঙ্গী হয় না। জীবনে প্রথম মনে হয় মেয়েরাও সমানভাবে বাঁচে।  

এখানে বিষয়টা নারী পুরুষ না, সবার জন্যই তাই। ছেলেবেলা থেকে স্কুলে, স্যোসাইটিতে কঠিন অনুশাসনেই কারো প্রাইভেসি অনতিক্রম্যতার ব্যাপারটা মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছে। না মানা হলে কঠিন শাস্তি। নিরাপদ, নিশ্চিত জীবনের গ্যারান্টি, যেটা বিশ্বের মোড়ল দেশ আমেরিকাতেও নাই।   আর এখানেই আমাদের দেশের মেয়েরা কত দৃঢ় , কত স্বপ্নভেদী , কত অদম্য তা আমি জাপানিদের দেখে বুঝেছি। ঘরে বাইরে, সমাজে ধর্মে পদে পদে এতো প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের মেয়েরা কত এগিয়ে। দেশের অর্থনীতির সিংহভাগ এখন প্রস্তুত পোশাক শিল্প যার কর্মী বেশির ভাগ নারী। সংসারে কোনরকম অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নেই এমন নারী বাংলাদেশে খুব কম।   অথচ জাপানে মেয়েরা এতো উন্নত সুরক্ষিত নিশ্চিন্ত জীবনের সুবিধা ও প্রিভিলেজ পেয়েও কিছুই অগ্রসর হয়নি। বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির এই দেশেও মেয়েরা মনে করে “লেখনং পড়নং বিবাহের কারণং”, হায়ার সেকেন্ডারি শেষ করে বেশির ভাগ মেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ে বড়জোর পলিটেকনিক জাতীয় ভোকেশনাল কলেজ পড়ে। পাশ করে সেক্রেটারিয়াল জব করে আর বিয়ের অপেক্ষায় থাকে। বিয়ে হলে ব্যস, ঘরকন্না।

কেউ কেউ একদম শেষ সন্তান হাই স্কুলে উঠে গেলে একাকীত্ব থেকেই কাজে ফিরে যান। কিন্তু সেটাও আনস্কিল্ড ম্যানুয়াল কাজ এবং পার্টটাইম। অনন্যসাধারণ কোন ঘটনা ছাড়া এর ব্যতিক্রম কোন মেয়েই চিন্তা করতে পারে না, স্বামীর চিন্তা করা তো অনেক পরের প্রসঙ্গ! এমনকি রেগুলার চাকরিতে, অর্থাৎ অফিস জবে নারী-পুরুষের বেতন স্ক্লেলেও প্রচুর তফাৎ। কাঙালিনী সুফিয়ার “বুড়ি হইলাম তোর কারণে” গানটার ভিডিও টা মনে পড়ে? একই কাজে ময়নার বাপ সুফিয়ার চেয়ে পেল অনেক বেশি পারিশ্রমিক কারণ সুফিয়া মেয়ে। বাংলাদেশে পেশাগত ৮ বছরে অন্তত কোন অফিসে এমন দেখিওনাই, শুনিওনাই। অথচ জাপানে এসে সরকারি বেতন স্কেলের চার্টেই দেখেছি!  

অবরুদ্ধ যুগের ( ১৮৬৮তে উন্মুক্ত হয় জাপান) আগে থেকেই জাপানে নারীরা শুধুই বংশগতির ধারা অব্যাহত রাখার উপায়। তেমনি এখনের সমাজেও এরা বিয়ে করে শুধু যখন সন্তান ধারণ করতে চায় তখুনি। এবং প্রচলিত নিয়মে সন্তান ধারণের পর স্বামী স্ত্রীতে তেমন কোন রোমান্টিক সম্পর্ক আর বিদ্যমান থাকেনা। এমনকি সহকর্মী বা বন্ধুদের মতই স্বামী স্ত্রী বা মেয়েবন্ধু -ছেলেবন্ধু বেড়াতে গেলেও যার যার বিল সে দেয়। চলা ফেরায় এরা খুব রক্ষণশীল, হাতে হাত রেখেও চলতে নারাজ। এই সম্পর্ক ঢেকে রাখার অভিনয় তুঙ্গে ওঠে যখন পথে ঘাটে স্বামীর বান্ধবীর (বা ফ্লিং, যেটা খুব সাধারণ এ সমাজে ) এর মুখোমুখি হলেও এরা খুব মিষ্টি সম্ভাষণে ভাব বিনিময় করে যা আমাদের অনুন্নত সমাজে অধিকার বিহীন মেয়েরা ভাবতেই পারবেনা। হয়তো  এটাই সভ্যতা!  

এদিকে, আত্মহত্যায় শীর্ষস্থানীয় বলে বাড়ির ভেতর কেউ মারা গেলে পুলিশ সাধারণত আত্মহত্যা লিখেই লাশ ছেড়ে দেয় , যদিনা খূব লক্ষ্যযোগ্য নমুনা বা যৌক্তিক সাক্ষীর সাক্ষ্য তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়। কে জানে কত নারী কিভাবে ঝরে গেলেন!  তারপরও যখন এদের মেয়েরা চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করে আমাদের সমাজে মেয়েরা নাকি মারধোর খায়, বর একাধিক বিয়ে করে, আমার বলতে ইচ্ছা হয় “ আমাদের মেয়েরা এখন প্রতিবাদ করতে জানে তাই প্রতিরোধ আসে। তোমাদের মেয়েদের তো কণ্ঠই নাই! অধিকারই নাই, তো সম-অধিকার”!!

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।

[email protected]

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।