হত্যার স্বাধীনতা চাই


প্রকাশিত: ১১:০৭ এএম, ০১ মার্চ ২০১৭

মিশুক মুনীর আর তারেক মাসুদ- দেশের দুই প্রতিভাবান মানুষ। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের জোকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এ দুজন প্রাণ হারান। এ দুজনের সাথে আরো তিনজন মারা গেছেন।

বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়। প্রতিটি মানুষের জীবনই অমূল্য। কারণ বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতি হলেও মানুষের জীবন দিতে পারে না। তারপরও কোনো কোনো মানুষের জীবন সত্যিই অমূল্য। মিশুক মুনীর আর তারেক মাসুদ তেমন দুজন মানুষ। একজন সম্প্রচার সাংবাদিকতার পথিকৃত মানুষদের একজন, আর তারেক মাসুদ বিকল্প ধারার সিনেমার প্রাণপুরুষ। এ দুজনের মৃত্যু সত্যিই জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। দুর্ঘটনার সাড়ে পাঁচ বছর পর মানিকগঞ্জের একটি আদালত এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এ রায়ের ব্যাপারে মিশুক মুনীর বা তারেক মাসুদের পরিবারের কোনো হাত নেই। সাংবাদিক বা সিনেমার লোকজন কেউ এ মামলায় হস্তক্ষেপ করেননি।

মিশুক মুনীর-তারেক মাসুদ নিহত হওয়ার পর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে দারুণ গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরও এ মামলার রায় পেতে সাড়ে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর মিশুক মুনীর-তারেক মাসুদসহ পাঁচজনের জীবনহানির দায়ে বাসচালক জামিরের মাত্র যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। গুরুপাপে লঘুদণ্ড। কিন্তু এই লঘুদণ্ডও সহ্য করতে পারেনি চালকরা। দেশের ১০টি জেলায় টানা অবরোধ ডাকে তারা। সোমবার দুপুরে খুলনা সার্কিট হাউসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের বৈঠক শেষে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু রাতেই নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের সরকারি বাসভবনে পাল্টে যায় সিদ্ধান্ত। বৈঠক চলাকালে খবর আসে সাভারে এক ট্রাকচালকের ফাঁসির রায়ের। ব্যস, তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশে যান চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত আসে মন্ত্রীর বাসা থেকে। মন্ত্রী খুব কৌশলী। তিনি সরাসরি ধর্মঘট ডাকেননি। ফোনে ফোনে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শাজাহান খান জানিয়ে দেন, ‘চালকরা ধর্মঘট ডাকেনি, স্বেচ্ছায় গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছে।’


যৌক্তিক দাবি আদায়ে হরতাল-ধর্মঘট-কর্মবিরতি পালন করা সবারই গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আপনি গায়ের জোরে, সাংগঠনিক শক্তির জোরে অন্যায় দাবি আদায় করতে যান, তখন সেটা অন্যায়, অযৌক্তিক, বেআইনি। পরিবহন শ্রমিকরা আদালতের যাবজ্জীবনের একটি রায়ের প্রতিবাদে ১০ জেলায় ধর্মঘট পালন করছিল। আর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে সারাদেশ অচল করে দেয়। তার মানে কি চালকরা ইচ্ছামতো রাস্তায় মানুষ মারবেন, কিন্তু তাদের কিছু বলা যাবে না। বাসচালকরা কি আইনের ঊর্ধ্বে?

বাংলাদেশের যেকোনো আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ আছে। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে, আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধেও রিভিউ আবেদন করা যায়। সব কিছুর পর রাষ্ট্রপতির অনুকম্পার সুযোগও আছে। কিন্তু বাসচালকরা আইনি কোনো ব্যবস্থায় না গিয়ে সোজা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে চাইলো। তারা যে দাবিতে ধর্মঘট করছে, তা পূরণের ক্ষমতা বাংলাদেশে কারো নেই। সড়কমন্ত্রী তো বটেই, এমনকি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীও এ পর্যায়ে শাস্তি পাওয়া দুই চালকের দণ্ড মওকুফ করতে পারবেন না। একমাত্র বিচারিক প্রক্রিয়ার দিকেই তাদের তাকিয়ে থাকতে হবে।

মিশুক মুনীর-তারেক মাসুদসহ পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনা। বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে। দোষ মাইক্রোবাস চালকেরও হতে পারতো। তবে তিনি যেহেতু নিজেও এ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, তাই তিনি সব বিচারের ঊর্ধ্বে। আদালত দীর্ঘ এবং স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়া শেষে জামিরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। কিন্তু সাভারের ট্রাকচালক মীর হোসেন রীতিমতো হুমকি দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দিয়ে এক নারীকে হত্যা করেছেন। এটি কোনো সড়ক বা মহাসড়কের দুর্ঘটনা নয়। নিহত গৃহবধূ খোদেজা বেগমদের পারিবারিক রাস্তা দিয়ে মাটিভর্তি ট্রাক নিয়ে যাচ্ছিলেন মীর হোসেন। তাকে বাধা দিলে তিনি প্রথমে হুমকি দেন এবং পরে ট্রাক চালিয়ে দেন। এটা পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। আর বাংলাদেশে খুনের শাস্তি ফাঁসি।

এখন যদি পরিবহন শ্রমিকদের দাবি মেনে সব চালককে আইনের ঊর্ধ্বে বলে ঘোষণা দেয়া হয়, তাহলে তারা মনের আনন্দে সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর উৎসবকে মহোৎসবে পরিণত করবে। দৈনিক প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আর চালকরা যদি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যান, তাহলে কী হবে ভাবুন। সংগঠিত মাস্তানির মুখে চালকদের দাবি যদি মেনে নেয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ আর মানুষ মারার জন্য অস্ত্রধারী ভাড়া করবে না, ট্রাকচালক ভাড়া করবে। ভাবুন কাদের খান যদি লোক ভাড়া না করে, ট্রাকচালক ভাড়া করে এমপি লিটনকে খুন করতেন, তাহলে এখন আর এত হইচই হতো না।

তবে চালকরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাদের ক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি। তারা চাইলে বিনা নোটিশে সারাদেশ অচল করে দিতে পারেন। এমনিতে হরতাল-ধর্মঘট-কর্মবিরতি যাই হোক তা একটি আলটিমেটাম দিয়ে সময় দিয়ে ডাকা হয়। কিন্তু এবার শ্রমিকরা যা করলো তা অবিশ্বাস্য। মন্ত্রীর বাসায় বসে ফোনে ফোনে কর্মবিরতি শুরু হয়ে যায়, মন্ত্রীর ভাষায় যা স্বেচ্ছায় গাড়ি না চালানো। মঙ্গলবার ভোরে মানুষ ঘুম ভেঙে দেখে সারাদেশে যান চলাচল বন্ধ। তাই দাবি জানাচ্ছি, চালকদের মানুষ মারার অবাধ লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হোক। তাহলে আমরা একেবারে মরে যাবো। নইলে তারা হুটহাট কর্মবিরতি করে আমাদের দুর্ভোগে ফেলে তিলে তিলে মারবে।
১ মার্চ, ২০১৭
[email protected]

Amin

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।