‘উর্দুর’ শিকার আরেক মাতৃভাষা : ভাষার জন্য লড়ছে বেলুচরা


প্রকাশিত: ০৬:৩৮ এএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মাতৃভাষা একটি জনগোষ্টির আত্মমর্যাদার অপার শক্তি। এর একটু রকম ফের হলেই রক্ত কথা বলে উঠবে। মুখের ভাষা কেড়ে নিলে রক্ত তার নিজের মতো করে কথা বলে। পৃথিবীতে এর একমাত্র দৃষ্টান্ত অমর একুশে। ১৯৪৮ থেকে মাতৃভাষা বাংলাকে রুখতে পাকিস্তান অপকৌশল করেছিল। যার পরিণতি ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। মুখের ভাষার জন্য কথা বলেছিল বাংলার সূর্য সন্তানদের রক্ত। ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে রক্ষা হয়েছিল ‘বাংলা ভাষা’। মাকে মা বলার অধিকার। তারপর মহান স্বাধীনতার যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামে স্বাধীন একটি ভূখণ্ডের।

সম্ভবত পৃথিবীর অধিকাংশ জাতির দেশের নাম তার মায়ের ভাষার নামে। তৎকালীন দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর বাংলা নামের ব-দ্বীপটুকু পড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে। বাংলার নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। এরপর পাকিস্তান সরকারের নানা অত্যাচারের মধ্যে অন্যতম ছিল ভাষা চাপানোর আগ্রাসন। বাংলা বলা মুখে উর্দু চাপাতে গিয়ে ব্যাপক আগ্রসী ছিল পাক সরকার। বর্তমানেও উর্দুকে অন্য মায়ের মুখে চাপাতে পাকিস্তানের অপকৌশল অব্যাহত রয়েছে।

সম্প্রতি বেলুচিস্তান ঘুরে এসে পাকিস্তানের প্রভাবশালী ‘দৈনিক ডন’ পত্রিকার সাংবাদিক নাজিহা আলী ‘ভাষার জন্য যুদ্ধ’ শিরোনামে বালুচদের ওপর পাকিস্তানের ভাষাগত আগ্রাসনের একটি বিশ্লেষণমূলক চিত্র তুলে ধরেছেন। তাতে তিনি লিখেছেন-পাকিস্তানের একটি প্রদেশের নাম বেলুচিস্তান। আয়তনের দিক দিয়ে এটি পাকিস্তানের প্রায় অর্ধেক। প্রদেশটির আশি লাখ মানুষ বেলুচ ভাষায় কথা বলে। অথচ বেলুচদের রাষ্ট্রভাষা উর্দু। ভিন্ন ভাষাভাষী এই জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মুছে দিতে তৎপর পাকিস্তান সরকার।

১৯৪৮ সালে বেলুচি ভাষা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে সেখানে উর্দু দিয়েছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা। এখনও সেখানকার প্রাথমিক স্কুলগুলোতে বেলুচ ভাষায় পড়ানো হয় না। এমনকি বেলুচ ভাষা শিক্ষার ওপরও কোন বই নেই স্কুলগুলোর শিক্ষা কারিকুলামে। হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি স্কুল বেলুচ ভাষা পড়ানো শুরু করেছে। তাও অতি সম্প্রতি। নিজ ভূমিতে একরকম পরাধীন বেলুচরা এই ভাষাকে প্রদেশিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্দোলন করে আসলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি কোনদিন। কারণ এই ভাষাটিকে পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়াই ছিল পাকিস্তানের  কেন্দ্রিয় সরকারের প্রধানতম ষড়যন্ত্র।

একসময়ে বাংলা ভাষার ওপর উর্দু ভাষা জোর করে চাপানোর পশ্চিম পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের কারণে পাকিস্তান ভেঙে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। মাতৃভাষার অধিকার হরণ করার চক্রান্তের সঙ্গে উর্দু ভাষা এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল যে তখন বাংলা ভাষা শুধু ভাষাই ছিল না, তখন বাংলা ভাষা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার প্রধানতম অনুষঙ্গ হিসেবে।

ভাষা নিয়ে এত চক্রান্ত করেও  এখন পর্যন্ত হুশ ফেরেনি পাকিস্তানি শাসকদের। যারাই যখন ক্ষমতায় এসেছে তারা বেলুচ ভাষাভাষী মানুষের ওপর একইভাবে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। তাদের এ কূটকৌশল একসময়ে সফল হলেও বর্তমানে পরিস্থিতি পাল্টেছে। তরুণ প্রজন্মের শিক্ষিত বেলুচরা তাদের মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামে নেমেছে। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে তাদের এই দাবি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মতই  বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। গত কয়েকযুগ ধরে চলে আসা পাকিস্তানের সামরিক অভিযানও রুখতে পারছে না বেলুচ স্বাধীনতাকামীদের।

ওই প্রতিবেদনে নাজিহা আলী বলেন, বেলুচিস্তানের মাতৃভাষা ‘বেলুচি’। প্রদেশটির প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা এটি। অথচ পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ওপর উর্দু ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে বালুচদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার। মূলত পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ও দরিদ্রতম প্রদেশ হলেও বেলুচিস্তান স্বর্ণ তামা ও প্রাকৃতিক গ্যাসে সমুদ্ধ। অথচ এর সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগ করছে কেন্দ্রিয় সরকার। বেলুচিস্তান থেকে আহরিত অর্থে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে পাঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশের।

নিজস্ব ভাষা, সংষ্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় কয়েক দশক ধরে বালুচরা পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকারের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। বেলুচিস্তানের একজন জাতীয়তাবাদী নেতা ‘ডন’কে বলেন, ‘বেলুচিস্তানে স্বাধীনতার জন্য বেশ কয়েকটি দল সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি, বেলুচিস্তান স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন, বেলুচিস্তান লিবারেশন ইউনাইটেড ফ্রন্ট ইত্যাদি। পাকিস্তানি সরকার স্বাধীনতাকামী এই যোদ্ধাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে বেলুচিস্তানে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে। বেলুচিস্তানে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার স্বাধীনতাকামী বেলুচ নিহত হয়েছে, নিখোঁজ হয়েছে আরও কয়েক হাজার। দমন-পীড়নমূলক পদক্ষেপের কারণে পাকিস্তান ইতোমধ্যে বেলুচিস্তানকে হাতছাড়া করে ফেলেছে। সাধারণ বালুচরা এখন আর পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি কোন ধরনের আনুগত্য বোধ করে না।

বেলুচিস্তান দরিদ্র  অঞ্চল হলেও প্রদেশটি প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৌশলগত কারণে পাকিস্তানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রদেশটির দুই সীমান্তে ইরান ও আফগানিস্তানের অবস্থান। দক্ষিণে রয়েছে আরব সাগর যেখানে গাওদার নামে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর রয়েছে। বাংলাদেশ হাতছাড়া হওয়ার পর পাকিস্তান কেন্দ্রিয় সরকার চায় যে কোন মূল্যে বেলুচিস্তানকে ধরে রাখতে। ২০০৬ সালের পর থেকে বেলুচিস্তানে কোন বিদেশি সাংবাদিককে প্রবেশ করতে দেয়নি পাকিস্তান আর্মি। প্রকৃতপক্ষে পুরো বেলুচিস্তানকে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক কারাগারে পরিণত করে রেখেছে পাকিস্তান।

বালুচদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা দমনে পাকিস্তান  সেখানে শুধু যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে তাই নয়, বরং ১৯৫২ সালে বাঙালিদের ওপর যেভাবে ভাষাগত যুদ্ধ শুরু করেছিল ঠিক একই রকম ভাষাগত যুদ্ধ শুরু করেছে বেলুচিস্তানের ওপর। সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ভাবে বালুচদের ওপরে ভাষাগত আগ্রাসন চাপিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। মাতৃভাষা বেলুচিতে কথা বলার অধিকার হারিয়েছে বালুচরা।

পাকিস্তান সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকার থেকে বালুচদের পীড়নমূলক বঞ্চিত করছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- নাগরিকদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও উন্নীত করার অধিকার আইগতভাবে সংরক্ষণে রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকবে। কোন অবস্থাতেই এই মৌলিক অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তান কেন্দ্রিয় সরকার নিয়ন্ত্রিত বেলুচিস্তানের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ মানা হয় না। সেখানে মাতৃভাষায় শিক্ষা নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। বিশেষত শহরের স্কুলগুলোতে। সেখানে বালুচদের বাধ্যতামূলক উর্দু ভাষায় শিক্ষা নিতে হয়। প্রদেশটিতে শুধুমাত্র অল্প কিছু প্রাইভেট স্কুলে বেলুচি ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা আছে।

রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নিকৃষ্ট ও বিধ্বংসী অস্ত্র মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার হরণ। পাকিস্তান সরকার বালুচদের ওপর এই মোক্ষম  অস্ত্র বিগত কয়েক দশক ধরে ব্যবহার করে আসছে। ইতিহাসে এই ধরনের জবরদস্তিমূলক নিপীড়নের উদাহরণ অনেক পাওয়া যায়। জাতিগত নির্মূলের অন্যতম হাতিয়ার এই ভাষার আগ্রাসন। মজার বিষয় হচ্ছে বেলুচিস্তানের তুরবাত বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বালুচ। তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাবজেক্ট হচ্ছে ‘বেলুচি ভাষা শিক্ষা’ যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ‘বেলুচি ভাষা শিক্ষা’ সাবজেক্টটি অপশনাল। এমনকি ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে নিজেদের মাঝে আলোচনা ও বিতর্কের ক্ষেত্রেও বেলুচি ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে।  তবে আশার কথা হচ্ছে তরুণ বালুচদের মাঝে মাতৃভাষার ওপর একধরনের আবেগ সৃষ্টি হয়েছে। মাতৃভাষায় পড়াশুনা ও কথা বলার অধিকারের দাবিতে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন এবং সোচ্চারও বটে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তুরবাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলুচিস্তান ভাষা একাডেমির একজন সিনিয়র ফ্যাকাল্টি সদস্য বলেন, ‘বেলুচি ভাষা ঐতিহ্যগতভাবেই সমৃদ্ধশালী, বিশেষত এর কাব্যিক ও সাহিত্যিক ধারা। বেলুচি ভাষার এই ধারা দিন দিন  আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে। শুধুমাত্র পশ্চিম বেলুচিস্তান থেকেই বেলুচি ভাষার প্রায় ১ হাজার প্রবাদ সংগ্রহ করে বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে’।

গত বছর নিরাপত্তাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়টি রেইড দিয়ে আপত্তিজনক বই থাকার অজুহাতে বেলুচিস্তান একাডেমি থেকে আটটি বুক সেলফ সরিয়ে নিয়ে যায়। যার সবগুলোই ছিল বালুচদের মাতৃভাষায় রচিত। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে একাডেমিতে আর কোন বেলুচ ভাষার বই সংগ্রহ করা হয়নি কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কারণে। তবে একাডেমিতে বেলুচি ভাষায় রচিত করাচি ভিত্তিক পাবলিকেশনের কিছু বই পাওয়া যায়। যে বইগুলো পাকিস্তান কেন্দ্রিয় সরকারের নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থের অভিপ্রায়ে রচিত। এবং এটা তাদের আয়ের একটি অন্যতম উৎসও বটে। একাডেমিটির জন্য প্রাদেশিক সরকার বছরে মাত্র ৫ লাখ রুপি বরাদ্দ দিয়ে থাকে যা একাডেমিটির প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই নগন্য।

বেলুচিস্তানের অধিকাংশ প্রাইভেট স্কুল, কলেজের ও ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের কারিকুলাম ও টেক্সট বুক করাচি থেকে আসে। প্রদেশটির অনেক ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে। বিশেষ করে যে সব এলাকায় সেনা ঘাটি রয়েছে সে সব এলাকার ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে গত দুই বছরে একটি নতুন বইও কেনা হয়নি এবং সরকারি কোন বরাদ্দও দেওয়া হয়নি।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।