দয়া করে বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না


প্রকাশিত: ০৫:৫৯ এএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে আনীত মামলাগুলি যদি কেউ পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে, যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, মামলার বাদি ও বিবাদি উভয় পক্ষই বিচার ব্যবস্থাকে কী করে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় তার তালে থাকেন। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু কিংবা অন্যান্য বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থী রাজনীতিবিদদের কথায় কথায় জেল দেওয়া হতো, আদালতকে ব্যবহার করে ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ দায়ের করে সাজাও প্রদানের নজির রয়েছে সে সময়। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে এর প্রবণতা পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন করে লক্ষ্য করা যায়।

সামরিক আদালতে বিচার করে শাস্তি দেওয়ার ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত কিংবা জনগণের অজান্তেই ফাঁসি কার্যকরের ইতিহাসও এদেশে রয়েছে। কিন্তু আমরা যদি নব্বইয়ের পরবর্তী সরকারগুলোর দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখি যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে মামলা ও আদালতকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা কমবেশি প্রতিটি সরকারই করেছে। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের সরকার যে ন্যক্কারজনকভাবে এই কাজটি করেছে তাতে বিচারব্যবস্থার প্রতি এদেশের মানুষের আস্থা প্রায় উঠে যেতেই বসেছিল। সেই আস্থাহীনতাকে ফিরিয়ে আনতে ২০০৮ সালের পর এদেশের বিচার ব্যবস্থাকে কম প্রচেষ্টা করতে হয়নি। এর আগে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা লক্ষ্যমান ছিল। কিন্তু এটুকু প্রশংসা করা জরুরি যে, এদেশের বিচার ব্যবস্থা নিজেদের স্বাধীন অবস্থাটি ফিরে পায় রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছার কারণেই এবং সেটাই এখনও চলমান।

কিন্তু তারপরও এদেশের বিরোধী রাজনীতির পক্ষ থেকে বার বারই দেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে আমরা দেখেছি বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষ থেকে কারণে-অকারণে দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে এবং বিদেশিদের কাছে বার বার অভিযোগ করেছে যে, এদেশের আদালতে ন্যায় বিচার পাওয়া যায় না।

এমনকি বিদেশিরাও কোনো প্রমাণাদি ছাড়াই দেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে, অদ্ভুত সব অভিযোগ এনেছে বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এমনকি একদল নতুন ‘সুশীল’একজন বিদেশি সাংবাদিকের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে এদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি নিন্দাসূচক বক্তব্য দিয়ে বসেন। আদালত তাদের এই কর্মকাণ্ডকে শাস্তিযোগ্য মনে করে এবং নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দেয়। মোটকথা আদালত ও বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে প্রচেষ্টা তাতে এদেশের রাজনীতিবিদরাই নন কেবল, তাতে এদেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও যুক্ত হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালে। বিশেষ করে সেই সব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী বিচারের রায়ে যাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন আর কেউই এ নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন না, কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচারতো এখনও চলমান। এতে প্রমাণিত হয় যে, বিচার প্রক্রিয়ার চেয়েও তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ওইসব ক্ষমতাবান যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো কিংবা এও হতে পারে যে, রাজনৈতিক ভাবে আসলে এরা সকলেই ওইসব যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের মানুষ ছিলেন কিংবা হতে পারে অন্য কোনো স্বার্থও এখানে জড়িত থেকে থাকবে।

প্রশ্ন করতে পারেন, হঠাৎ আদালত, বিচার ব্যবস্থা নিয়ে এতো কথা বলছি কেন? বলছি এ কারণে যে, বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা দুর্নীতি মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন হয়ে এসেছে এবং এই মামলাটি নিয়েই আবার এদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টায় নেমে পড়েছেন রাজনীতিবিদগণ। বিএনপি’র পক্ষ থেকে বার বারই বলা হচ্ছে যে, বেগম জিয়াকে সরকার শাস্তি দিতে চায়, নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়, রাজনৈতিক ভাবে জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে চায়। একটি প্রশ্ন সবিনয়ে বিএনপি নেতাদেরকে করতে ইচ্ছে করে যে, আদালত নিশ্চয়ই প্রমাণাদি দিয়েই বিচারকার্য সম্পন্ন করে, এবং আদালতের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান আছে এমন মানুষও জানেন যে, দু’পক্ষের সওয়াল-জওয়াবের মধ্য দিয়েই দোষী বা নির্দোষ সাব্যস্ত করে আদালত।

বিএনপি নেতার পাশে ঘাগু ঘাগু সব আইনজীবী রয়েছেন, তারা কি বিএনপি নেত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করা থেকে রক্ষা করতে পারছেন না? সরকারের কাছে কী এমন তথ্য-প্রমাণ আছে যার পাল্টা অস্ত্র বিএনপি’র উকিলদের কাছে নেই? জানি এসব প্রশ্ন করলেই, বিএনপি-সমর্থকরা ‘আওয়ামী লীগার’ বলে গাল দেবেন। আমরা জানি যে, এই বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে বেগম জিয়া বেয়াল্লিশবার আদালত নির্ধারিত তারিখে হাজিরা দিতে যাননি। কখনও অসুস্থতা, কখনও অন্যান্য অজুহাত দেখিয়েছেন। দেশের আর কোনো নাগরিকের পক্ষে এই কাজটি সম্ভব ছিল? কিন্তু যেহেতু এটি একটি ‘হাই ক্লাশ কেইস’ সেহেতু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ কারোরই নেই। আদালত যদি বেগম জিয়াকে এতোবার অনুপস্থিত থাকার সুযোগ দিয়ে থাকেন, আত্মপক্ষ সমর্থনে সকল সুযোগাদিও দিয়ে থাকেন, এমনকি মামলাটি বদ্ধ কক্ষেও যদি পরিচালিত না হয়ে থাকে তাহলে এই প্রশ্নটি থেকেই যায় যে, আদালতের বিরুদ্ধে বিএনপি আসলে কী ধরনের অভিযোগ আনতে চাইছে বা পারে?

এরই মধ্যে বেগম জিয়ার পক্ষ থেকে বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে বিষয়টিকে জটিল করে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা যেমন আদালত প্রাঙ্গণে হয়েছে তেমনই বাইরে বিএনপি নেতারা সরকার ও আদালতকে একাকার করে ফেলার জন্য এমন সব বক্তব্য রেখে চলেছেন যাতে মনে হতে পারে যে, এদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি তাদের কোনো আস্থাই আর অবশিষ্ট নেই। অথচ, এদেশের বিচার ব্যবস্থা বার বার এরকম অভিযোগ থেকে বের হয়ে স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ইতোমধ্যে কিন্তু তারপরও সবারই লক্ষ্য যেনো বিচার ব্যবস্থাকে কী করে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় সেই কাজটি করতে।

মজার ব্যাপার হলো বিএনপি নেতারা ধরেই নিয়েছেন যে, মামলায় বেগম জিয়ার শাস্তি হবেই। একই সঙ্গে আদালত ও বিচার ব্যবস্থাকেতো বটেই সেই সঙ্গে বিএনপি নেতারা নিজেদের আইনজীবীদের প্রতিও আস্থা রাখতে পারছেন না। কেউ কেউ অবশ্য একথা জোর দিয়েই বলছেন যে, বিএনপি নেতাদের অনেকেই চাইছেন যে, বেগম জিয়ার শাস্তি হোক। কারণ তাতে এক ঢিলে বহু পাখি মারা সম্ভব। তারেক জিয়ার কারাদণ্ড হওয়ার পরে এখন বাকি আছেন বেগম জিয়া। যে সব নেতারা বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটিকে কেবল তাদের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের প্ল্যাটফরম বলে মনে করেন তারা ভাবছেন, এই সুযোগে যদি বিএনপি-নেতৃত্বের আসনটিও পাওয়া যায় তাতেই বা মন্দ কি? এই খায়েশ অবশ্য বহুদিনের এবং দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই এমন রাজনীতিবিদের দেখা মেলে। কিন্তু বিএনপি নেত্রীর ক্ষেত্রে এই নেতারা ক্রমশঃ নখ-দন্ত বের করে মাঠে নেমেছেন এবং হুঙ্কার দিচ্ছেন এই বলে যে, বেগম জিয়ার শাস্তি হলে দেশ অচল করে দেয়া হবে কিন্তু তাদের মনের কথাটি যে ভিন্ন সেটি তার দলের সাধারণ নেতাকর্মীরাও জানেন।

অপরদিকে সরকার দলীয় নেতারা কথায় কথায় বিএনপি নেত্রীকে শাস্তি দিয়ে দিচ্ছেন তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে। এও এক ভয়ঙ্কর রোগ আমাদের দেশের রাজনীতির, সরকারে থাকলেই এমন এক গর্বে তারা গর্বিত হন যে, কখনওই মনে করেন না, কোনোদিন তাদেরকেও সরকারের বাইরে যেতে হতে পারে। ফলে তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বিএনপি রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল রাজনৈতিক দল সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ জামায়াতের মতো অর্থ ও পেশি শক্তির রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির জনসমর্থন যোগ হলে একটি বিশাল রাজনৈতিক শক্তির উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান সরকারের কিছু মন্ত্রী বা নেতার বক্তব্য শুনলে মনে হয় তারা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন- নিঃসন্দেহে এই প্রবণতা ভয়ঙ্কর।

তাছাড়া, আদালতে বিচারাধীন কোনো বিষয়ে মন্তব্য করার এখতিয়ার কারোরই নেই। তাতে আদালতের প্রতি অসম্মানই কেবল নয়, সরকারের প্রতি বিএনপি’র যে অভিযোগ একটু আগে উল্লেখ করেছি সেটাই প্রমাণিত হয়। যে কারণে শুরুতেই বলেছিলাম যে, বাংলাদেশের আদালতে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিচার চলাকালে আসলে বোঝা যায় এদেশের রাজনীতি আসলে কতোটা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। পক্ষ ও প্রতিপক্ষ উভয়েই তখন বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই কাছাখুলে নেমে পড়ে। আবারও একথা বলেই শেষ করি যে, দু’পক্ষের জন্যই এই প্রবণতা ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী। আজকে কেউ সরকার চালাচ্ছে, কেউ বিরোধী পক্ষে আছেন, কিন্তু চাকাতো একদিন ঘুরতেই পারে, তখন আবার পরিস্থিতি ঠিক উল্টো হবে কিন্তু লক্ষ্য সেই বিচার ব্যবস্থাই থেকে যায় সব সময়। আমি এটাকেই ভয়ঙ্কর প্রবণতা বলছি। দেশের স্বার্থে, রাজনীতির স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে এই প্রবণতা থেকে আমাদের রাজনীতিকে মুক্ত করতে সকলকেই এ পথ পরিত্যাগের অনুরোধ জানাই।

ঢাকা, ২৮ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৭

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।