ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কী ভাবছি?


প্রকাশিত: ০৪:১১ এএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে গেল মাতৃভাষা নিয়ে কথকতা। ফেব্রুয়ারি মানেই অমর একুশে। ফেব্রুয়ারি মানেই শহীদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ফেব্রুয়ারি মানেই বইমেলা। শত শত বই, হাজার হাজার বই। পাঠক, বিক্রি, প্রকাশক, মোড়ক উন্মোচন, প্রকাশনা উৎসব। আমাদের (বাঙালিদের) মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে আমরা গর্বিত। শহীদদের আত্মত্যাগে আমরা (বাঙালিরা) অর্জন করে নিয়েছিলাম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। সেই পাকিস্তান আমলেই শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবার মতো সাহস, প্রত্যয় রাখতে পেরেছি।

১৯৪৮ সালের আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের  একুশে ফেব্রুয়ারিতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার এবং আরও অন্য শহীদদের আত্মত্যাগ বাংলাকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। গঠন করেছি স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। এজন্য আমরা গর্বিত। কিন্তু একটা কথা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই, বাংলাদেশে শুধু বাঙালিরাই নয়, এদেশে কিন্তু অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষও বসবাস করে। চাকমা, মারমা, গারো, মং, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, ত্রিপুরা, মণিপুরী, লুসাই, খেয়াং, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কোচ, খুমি, মান্দাই, খাসিয়াসহ অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আমাদের দেশে আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি বাংলাদেশে রয়েছে।  

এই হিসাবে অবশ্য কিছুটা গরমিলও রয়েছে। তবু যদি এই হিসাবকে মেনে নেই তাহলেও বলা যায় ২৭টি গোষ্ঠীর পৃথক ভাষাও কিন্তু রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষরা বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর ১ বা ২ শতাংশ। বাঙালি হিসেবে, বাংলাভাষী হিসেবে আমরা যখন একুশ নিয়ে গর্বিত যখন বইমেলা নিয়ে উৎসব মুখর তখনও কিন্তু ভুলে যাওয়া উচিত নয় এদেশে আরও অনেক মানুষ আছেন যারা অন্যভাষায় কথা বলেন। তাদের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য আমরা কতটুকু কী করছি সেটা কিন্তু আমাদের চিন্তা করা দরকার।

মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করা প্রতিটি শিশুরই অধিকার। এর মধ্যে এ  বছর সরকারি ভাবে প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় প্রণীত বই বিতরণ করা হয়েছে। চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে এই বই বিতরণ করা হয় বান্দরবানে। এটা ভালো উদ্যোগ। তবে এদের ছাড়া আরও যে নৃগোষ্ঠীর শিশুরা রয়েছে তাদের জন্যও এই পদক্ষেপ প্রয়োজন। এ বছর বইমেলায় বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষায় কতগুলো বই প্রকাশ হলো সে খবর কি অধিকাংশ বাঙালি রেখেছে? বাঙালিদের মধ্যে কয়জন অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় কথা বলতে পারেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল ইত্যাদি ভাষা শেখার কি কোনো ব্যবস্থা রয়েছে? ঢাকাবাসী বা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাসকারী ক’জন বাঙালি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারেন? চাকমা কিংবা অন্য নৃগোষ্ঠীর ভাষা পড়তে পারেন ক’জন (যাদের নিজস্ব লিপি রয়েছে)?

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তাদের গান, ছড়া, কবিতা, উপকথা, রূপকথা, মিথোলজি, এগুলো কিন্তু বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর শিল্পীদের তৈরি শিল্পসামগ্রী বিক্রির জন্য ক’টি দোকান রয়েছে?

আমি যদি চাকমা ভাষার গান শুনতে চাই তাহলে ঢাকায় বসে কোথায় পাব? যদি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিশেষ খাবার খেতে চাই সেটাই বা ঢাকায় কোথায় পাওয়া যাবে? পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রতি এমনিতেই বাঙালিরা সীমাহীন অবিচার করেছে, এখনও করছে। একজন বাঙালি হিসেবে আমি এই ভূমিকার জন্য দারুণ লজ্জিত। আমি যখন কোনো চাকমা বা সাঁওতাল, মং বা মারমা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলি আমি অপরাধবোধে আক্রান্ত হই। বাঙালি হিসেবে নিজেকে আমার অপরাধী মনে হয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমি বাঙালিরা দখল করেছে। তাদের বাড়িঘর ক্ষেত খামার বিনষ্ট করেছে। তাদের উপর শারীরিক মানসিক নির্যাতন চালিয়েছে। এই নির্যাতন ও দখলদারি এখনও থামেনি বরং বাড়ছে।

এই তো সেদিন গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি, স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা একসময় বাংলা, বাঙালি ও বাঙালির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। এখন আমরা বাঙালিরা যদি আবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বৈষম্য করি তাহলে আমরা নিজেদেরকে খুব বেশি উন্নত ভাবার দাবি করতে পারি কি? আজ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা, শিশুরা বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তরুণরা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কোনো নারীর উপর যখন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তখন তাদের গোষ্ঠীর মানুষকেই প্রতিবাদ করতে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। সে সময় দেশের সর্বস্তরের মানুষের কণ্ঠে কেন প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় না?

বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক সম্পদকে রক্ষা করার প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে। প্রয়োজন তাদের ভাষাগুলোকে রক্ষা করা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, অভিনয় শিল্পীদের প্রতিভা যেন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে, কারুশিল্পীদের পণ্যসামগ্রী যেন ঠিকমতো বিপণন হয় সেদিকে জরুরিভাবে মনোযোগ দিতে হবে। গণমাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বিশেষভাবে প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে।
 
লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।