পথে যায় প্রাণ
সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের মামলার রায়ে বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত। সেই সঙ্গে আদালত তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। বাসচালক জামির হোসেন এখন জামিনে মুক্ত আছেন।
২০১১ সালের ১৩ই অগাস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জের জোকা এলাকায় বিপরীতগামী যাত্রীবাহী একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসে থাকা তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছিল। এই প্রথম সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কোন বড় সাজা হলো চালকের। তবে বিচারিক প্রক্রিয়ার নানা ধাপ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সত্যিকারের শাস্তি কতটুকু হবে এ নিয়ে সংশয় আছে। আর এর মধ্যেই আমরা দেখলাম আদালতের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দায়ী বাসচালক জামির হোসেনের সাজার প্রতিবাদে চুয়াডাঙ্গায় পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে পরিবহন শ্রমিরা।
যেদিন এই রায় হলো সেদিনও টেলিভিশনের স্ক্রল জুড়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া নানা সড়ক দুর্ঘটনার খবর ছিল। প্রতিদিনই কত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশনে, পত্রিকার পাতায় মানুষ নীরবে এসব মর্মান্তিক মৃত্যু দেখেছে। আরও দেখবে। সব দুর্ঘটনা বড় আলোচিত হয় না। কিছু কিছু হয়, যেমন হয়েছিল মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনা। বড় দুর্ঘটনা, একসাথে অনেক মানুষ মারা গেলে কিছু কিছু কথাবার্তা হয়। এরপর সব ভুলে যাওয়া হয়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে মানুষ মরছে, তা সাদামাটা বললে বলতে হয় ‘গণহত্যা’।
প্রতি হাজার নাগরিকের বিপরীতে গাড়ির সংখ্যা সবচেয়ে কম হওয়ার পরও সারাবিশ্বের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বাধিক মানুষ নিহত হচ্ছে বাংলাদেশে। ভয়ানক মহামারীর মতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে সড়ক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা সেন্টারের এক হিসাব অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে বাংলাদেশে বছরে মৃত্যু হয় ৮৫টি। পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় এ হার প্রায় ৫০ গুণ বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশের জিডিপির অন্তত দুই শতাংশ হারিয়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনা, নিত্য দিনের ঘটনা। প্রতিদিন ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ। থমকে যাচ্ছে বহু পরিবার। পঙ্গু হাসপাতালে গেলে এর ভয়াবহতা বোঝা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কে আছে এ সব দেখার?
এ দেশের সবচেয়ে উচ্ছৃঙ্খল খাত পরিবহন খাত। কিছুই বলা যায় না এদের। এরা মানুষ মারবে, পুলিশ ধরলে ধর্মঘট ডাকবে। এরা বিচারের ঊর্ধ্বে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকুক, এ খাতের শ্রমিক ইউনিয়ন বা মালিক সমিতির কর্তারা থাকেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। ক্ষমতায় এরা এমন অবস্থানে, যেকোনও দুর্ঘটনার এসব হত্যাকাণ্ডে শেষ পর্যন্ত ভিকটিমরাই আবারও ভিকটিম পরিণত হন। বেশিরভাগ দুর্ঘটনার পর এখন আর মামলা হয় না। কারণ, এসব মামলার কোনও সুরাহা হয় না, বিচার হয় না। বিচারহীনতার কোনও সংস্কৃতি যদি এদেশে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, তবে তা হবে এই পরিবহন খাত। এখানে আইন কখনোই তার নিজের গতিতে চলে না। সেই এরশাদ জামানায় মালিক শ্রমিকরা ধর্মঘট করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করার দাবি আদায়ের পর থেকে দেশের মানুষকে মেরে ফেলার লাইসেন্স নিয়েছে পরিবহন শ্রমিকরা। প্রায় সব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বেপরোয়া আচরণ। এই যে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নির্দিষ্ট গতিসীমা না মেনে গাড়ি চালানো, তার কারণ হলো, এই চালক মহাশয় জানেন তার কিছুই হবে না।
স্বার্থের দ্বান্দ্বিকতার চরম দৃষ্টান্ত দেশের পরিবহন খাত। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বরাবরই সব সরকারের আমলেই মন্ত্রী এমপি থাকেন। আর এ কারণেই এই চালকরা ভাবে, এদের বিরুদ্ধে নীতি নির্ধারণী জায়গা থেকে কোনও শাস্তির সুপারিশই আসবে না। কারণ আরও আছে। যেমন, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা; মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বা পণ্য পরিবহন; গাড়ি চালানোর আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা; বিপজ্জনকভাবে ওভারটেক করা; প্রতিযোগিতা করা, সামনের গাড়ির সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রাখা; ত্রুটিপূর্ণভাবে গাড়ি চালানো; চালকের বদলে সহকারী দিয়ে গাড়ি চালানো; ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে অসচেতনভাবে গাড়ি চালানো; যথাসময়ে যথোপযুক্ত সংকেত দিতে ব্যর্থতা; যথাযথ লেনে গাড়ি না চালানো; প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না নিয়ে অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় একটানা গাড়ি চালানো; নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো; মানসিক অস্থিরতা বা অতিরিক্ত চাপ ও শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে গাড়ি চালানো; দৈহিক অযোগ্যতা নিয়ে গাড়ি চালানো, শিক্ষার স্বল্পতা এবং পেশাগত জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা। আর আছে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তাঘাট।
মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ সড়কগুলো পরিকল্পনাহীনভাবে নির্মিত। এ সব কারণে সুনির্দিষ্ট করে শুধু এটুকু বলা যায়, সড়ক নির্মাণ, এর রক্ষণাবেক্ষণ, এর ব্যবস্থাপনা, গাড়ির রুট পারমিট, ফিটনেস, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং এ সংক্রান্ত আইন প্রয়োগকারী, প্রায় সবাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে এখানে বিচারে আশা করা বাতুলতা মাত্র। পুলিশের হিসাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত: তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্র বলছে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী এই সংখ্যাটি ১২ হাজার থেকে ২০ হাজারও হতে পারে। আর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া শতকরা ৫৪ ভাগই পথচারী। পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৪৬ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত। পুলিশের সঙ্গে কথা বলবেন, বলবে, দোষ সব পথচারীদের। কারণ, তারা রাস্তা পার হতে জানে না। যত সহজে পথচারীদের দোষ দেন তারা, তার সিকিভাগও চেষ্টা করেন না রাস্তায় গাড়িতে-গাড়িতে রেষারেষি বন্ধ করার দিকে।
দেশের চালক-পথচারী কেউই ঠিকমতো আইন মানেন না। অপরাধের কোনও শাস্তিও হয় না, তাই এমন মৃত্যু কমানো যাচ্ছে না। সরকার নানা সময় বলে নানা আইনের কথা। কিন্তু এখনও যেসব আইন আছে, সেগুলো প্রয়োগের দিকে কি নজর আছে? তা করলেও দুর্ঘটনা অনেক কমত। একটি কাজ যদি করা যায়, তাহলেও কিছুটা ফল পাওয়া যেত। প্রতিটা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রথমে দায়ী করতে হবে চালককে। ত্রুটিযুক্ত গাড়ির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও এর জন্য দায়ী চালক। কারণ, গাড়ির সবকিছু ঠিক না থাকলে একজন ড্রাইভার সড়কে গাড়ি বের করেন কেন?
বেশি বেপরোয়া দূর পাল্লার বাসের চালকেরা, তেমনি ট্রাকগুলোও। এসব চালক কখনও ভাবেন না যে তাদের ওপর নির্ভর করছে সমস্ত যাত্রীর জীবন, যাত্রীদের পরিবারের সদস্যদের জীবন। বেশির ভাগ চালক লেখাপড়া জানেন না। তাদের রোড সাইন সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা নেই। গাড়ি চালনার সময় কোথায় ওভারটেক করা যাবে এবং কোথায় যাবে না সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণা নেই। অথচ এদেরই বাছবিচার না করে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে হাজার-হাজার। বড় দুর্ঘটনা ঘটলে মন্ত্রীরা ছুটে যান, সরকারি কর্মকর্তারা ছুটে যান। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। কারণ আইনের প্রয়োগ হয় না। প্রতিটি বাস এবং ট্রাকে বিআরটিএ কর্তৃক সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০-৭০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিয়ে গভর্নর সিল সংযুক্ত করে দেওয়া এখনই জরুরি। চালক এই সিল পরিবর্তন করার চেষ্টা করলে অবশ্যই গাড়ি আটকের মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে জেলা পুলিশ এবং হাইওয়ে পুলিশকে পর্যাপ্ত স্পিড ডিটেক্টর দেওয়া যেতে পারে। আর শাস্তি হতে হবে নগদ-নগদ, সড়কেই, যেন তারা তদবিরের সুযোগ না পায়।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেমন নৈরাজ্যপূর্ণ, গণস্বার্থবিরোধী, এই পরিবহন খাতও তেমনি। এখানে মানুষের জীবনের মূল্য কখনোই বিবেচনা করা হয়নি। বারবারই দেখা গেছে হত্যাকারীদের বাঁচানোর প্রচেষ্টা। যেদিন মানুষের জীবনের মূল্যায়ন করা হবে, সেদিনই হয়তো সম্ভব হবে এই মৃত্যুর মিছিল কমানোর। কোনও দুর্ঘটনা ঘটবার পরে বিলাপে, আক্ষেপে নীতি নির্ধারকরা যে পরিমাণ উদ্যম এবং সময় ব্যয় করে থাকেন, তার ভগ্নাংশও সময় মতো ব্যয় করলে এই ধরনের দুর্ঘটনা রুখবার একটা পথ বের হতে পারতো।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস