বইমেলা কি শুধুই একটি ভিড়ের নাম?


প্রকাশিত: ০৪:১০ এএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ছোটবেলা পাঠ্যবইয়ে ‘আম আঁটির ভেঁপু’ নামক উদ্ধৃতাংশটুকু পড়ার পর দিনের পর দিন মাইলের পর মাইল হেঁটে, রিক্সাভাড়া জমিয়ে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী কেনার মাধ্যমে আমার পাঠযাত্রা শুরু। কষ্ট করে পয়সা জমিয়ে বইকেনা এবং পড়া ছিল অল্প বয়সের বিনোদন, একমাত্র প্রেম, প্রিয় ভালবাসা। কিন্তু সেইসময় বইমেলায় যাওয়া হয়নি কখনো। সিলেটের মফস্বল জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর জীবনের অঙ্গনে পা দেবার আগেই বিবাহ নামক বাণিজ্য-সূত্রে বিদেশ পাচার হয়ে যাওয়ায় এবং জীবন যুদ্ধের ময়দানে অবস্থান দীর্ঘায়িত হতে থাকায় বইমেলায় আর যাওয়া হয়ে উঠেনি।

জীবন-অপরাহ্নের প্রারম্ভে যখন অবশেষে একুশের বইমেলা নামক স্বপ্নের অঙ্গনে পা রাখার সুযোগ এল, তখন আমার হাতে মস্তিষ্ক প্রসূত প্রথম নবজাতক সন্তান ‘নিষিদ্ধ দিনলিপি।’ লেখক হিসেবে বইমেলায় পদার্পণ ও বিচরণের সুবাদে হল কিছু অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা যা প্রকাশের ভাষা নেই, বা যার সবটুকু প্রকাশ করা সমীচীনও নয় বোধ করি। প্রথম কয়েকদিনের প্রচণ্ড আবেগ আর উত্তেজনা কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসবার  পর বইমেলার পরিবেশ নিরীক্ষণ করবার মত মানসিক অবস্থা এবং সুযোগ সৃষ্টি হলো। অনেক কিছুই চোখে পড়ল তখন।  সারি সারি বইয়ের স্টল, বই হাতে নতুন ও পুরাতন লেখকেরা, উদ্বিগ্ন প্রকাশকগণ, ঝাঁকে ঝাঁকে নারী পুরুষ শিশু, গায়ে শাড়ি ও মাথায় পুষ্প-আংটি পরা সুন্দরীদের ভিড়, ক্যামেরা হাতে ব্যতিব্যস্ত মিডিয়ার লোকজন- এই নিয়ে আমাদের মহান একুশের বইমেলা।

বইমেলা কি এখন শুধুই একটা ভিড়ের নাম? অনেকেরই মনে এটা একটা প্রশ্ন, একটা ন্যায্য প্রশ্ন, কারণ ভিড় অনেক হলেও বইবিক্রি আশানুরূপ নয়, এই চিরাচরিত অভিযোগটা এখনো থেকে গেছে। নানান কারুকাজে সুন্দর করে সাজানো নয়নাভিরাম বইয়ের দোকানগুলোতে পাঠকের ভীড় যে একেবারেই নেই তা নয়, তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় পর্যটন কর্পোরেশনের দোকানে যেখানে কোনো খাদ্য খুঁজে পেলাম না, আমার দৃষ্টিতে সবই অখাদ্য। একজন বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের এই ঐতিহ্যবাহী বইমেলায় পিঠা, পিঁয়াজু, ঝালমুড়ি খাবার আশার গুড়ে বালি পড়ল প্রথম দিনেই। বার্গার, চিকেন রোল, নুডলসের বাহার দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তৃষ্ণা মেটাতে শুধু এক বোতল পানি কিনেই ফিরে এলাম। তবে মেলার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফুচকা বিক্রি হচ্ছে দেখে মনোকষ্ট একটু লাঘব হলো। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, ষাট টাকা দিয়ে অখাদ্য বার্গার কিনে খাচ্ছেন যারা, তাদের হাতে বই নেই কেন? বইগুলো কি তাদের কাছে আরো বেশি অখাদ্য?

খাবারের দোকানের চারপাশে পথশিশুদের ভিড়। এতো কড়া পুলিশ পাহারা এড়িয়ে এরা মেলায় ঢুকছে কীভাবে যে জায়গায় ছোটখাটো সিগারেটের প্যাকেটও ঢুকতে পারছে না? আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা কি মানবতার মহান ধর্মে এতোটাই দীক্ষিত? সে যা’ই হোক, বাচ্চাগুলোর ভিক্ষা করার ব্যাপারটা ভাল না লাগলেও বাচ্চাগুলোকে ভাল না লেগে উপায় নেই। একদিকে ছিমছাম কাপড় জুতা মাথায় ফুলের রিং লাগানো ফিটফাট শিশুরা মাবাবার হাত ধরে বই দেখছে, বার্গার খাচ্ছে আর অন্যদিকে একই বয়সের এই শিশুগুলো সামান্য কৃপার জন্য লোকজনের পেছনে পেছনে হাঁটছে। এদের সাথে একটু কথা বললেই দেখা যায় এরা চিন্তাভাবনায় কতটুকু চৌকশ, নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে কতটা পারঙ্গম। একটা ভিন্ন অবস্থানে জন্ম হলে হয়ত ওরাও...ভেবে কষ্ট বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। একটা সাত/আট বছরের মেয়ে আমাকে ফুসলে ফাসলে বাধ্য করল তাকে একটা বার্গার কিনে দিতে, কথা দিল কাউকে বলবে না। কিন্তু আরো অনেকের মত সেও কথা রাখেনি। একটু পরেই একঝাঁক শিশু এসে হাজির, ওদেরকেও খাবার কিনে দিতে হবে। কী যে বিপদে পড়লাম! বুঝিয়ে বললাম, আমার কাছে তো এতো টাকা নেই। একটা ছেলে বলল, সবাইকে দিতে হবেনা। কয়েকটা দিন, আমরা ভাগ করে খাব। কি বুদ্ধি! কী আর করা, কয়েকটা আইসক্রিম কিনে দিলাম।
 
আমার বইয়ের লাইভ কাভারেজের জন্য মিডিয়ার পেছনে ঘুরতে যেয়ে হলো আরেক অভিজ্ঞতা। অল্পবয়েসী অ-বিখ্যাত ছেলেমেয়েগুলো অনেক বেশি আন্তরিক। তারা আগ্রহ করেই আমার বই সম্পর্কে দু’চার লাইন বলতে দিলেন তাদের ক্যামেরার সামনে। দু’একজন সেলিব্রেটি গোছের সাংবাদিক আবার দীর্ঘসময় ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সাথে হাসিঠাট্টায় মশগুল হয়ে পড়লেন। শেখ সাদীর ‘পোশাকের গল্প’ মনে পড়ে গেল। জানিনা লেখক হিসেবে মণিমুক্তাখচিত আলখেল্লা পরার সুযোগ কখনো হবে কি’না, হলে সেদিন গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া পার্সোনালিটিদের মনোযোগ সেই আলখেল্লাকেই খাওয়াব বলে ঠিক করেছি। তবে আবৃত্তিকার শিমুল মোস্তফা যে একজন ব্যতিক্রম, এ কথা না বললেই নয়।

আমার প্রকাশকের স্টলটি মোড়ক উন্মোচন মঞ্চের ঠিক সামনেই। প্রতিদিন দেখছি কীভাবে বইয়ের পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে যাচ্ছে মোড়ক উন্মোচণকারীর পরিচয়, জনপ্রিয়তা, অটোগ্রাফ আর সেলফির জন্য কাড়াকাড়ি। কাজেই আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে না বলেই ঠিক করেছি।

তবে এতোকিছুর পরও সব মিলিয়ে বইমেলা নিয়ে আমার অনুভূতি খুবই ইতিবাচক। আমার ফেসবুক-ভিত্তিক পাঠকেরা এই সাধারণ মাপের নতুন লেখককে যে নিঃশর্ত সাপোর্ট এবং ভালবাসা দেখিয়েছেন, তা অকল্পনীয়। একজন দু’টো বাটার বন নিয়ে এসেছেন, ‘আপা এতো লম্বা সময় ধরে মেলায় বসে থাকেন, আপনার খিদা পায় নিশ্চয়ই’। অনেকে অটোগ্রাফের ছবি ফেসবুকে আপলোড করে অন্যদেরকে মেলায় বই কিনতে আসতে উৎসাহিত করে তুলছেন। অচেনা শত শত লোকের ভিড়ে হঠাৎ কেউ উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠছেন, ‘আপনি জেসমিন না?’ কেউ বা আবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মেলা শেষে আমাকে রিক্সা পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছেন। সেদিন মেলা গেট থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত হেঁটে যেতে যেতে এক মধ্য বয়সী ভদ্রলোকের সাথে দু’তিনবার চোখাচোখি, মুচকি হাসি বিনিময়ের পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি লেখালেখি করেন?’ দু’দিন পর বন্ধু নিয়ে স্টলে এসে হাজির বই কিনতে। তারপর প্রতিদিনই একবার উঁকি মেরে যাচ্ছেন, শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। এভাবে বইয়ের সুবাদে অপরিচিত জনেরা পরিচিত হয়ে উঠছেন, বন্ধু হয়ে উঠছেন।

সমস্ত অসঙ্গতি, অব্যবস্থা, অতৃপ্তি ছাপিয়ে যা মনকে ভরিয়ে দিয়েছে তা হলো লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মিলন মেলা, নতুন বইয়ের টাটকা গন্ধ, হাজার মুখের ভিড়ে উঁকি দেয়া প্রিয় লেখকদের মুখ। এইসব মিলিয়ে বইমেলা আমার কাছে একটা ভালবাসার নাম, একটা স্বপ্নময় জগতের নাম যেখানে জন্মেছে আমার প্রথম বুদ্ধি-শিশু। অমর একুশের বইমেলা অমর হোক, সব বাধাবিপত্তির ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তচিন্তার বিকাশে সহায়ক হোক- এই শুভকামনা নিরন্তর।

লেখকঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, অনুবাদক, ও নাট্যকর্মী।

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।