যুদ্ধ করি সময়ের সাথে
মৃত্তিকা গুণতে থাকে প্রতীক্ষার প্রহর। মনের মাঝে বাজতে থাকে দুশ্চিন্তার ঘন্টা। না জানি নতুন মাসের কাজের সিডিউলটা কেমন হবে। কতগুলো নাইট ডিউটি দিবে কে জানে! নাইট ডিউটি শুনলেই রেগে যায় মৃত্তিকার শ্বশুর বাড়ির মানুষ। বাড়ির বউ রাতের বেলা কেন বাসার বাইরে থাকবে? না জানি কি ধরনের মানুষের সাথে ওঠা বসা করে, রাতে পুরুষ মানুষদের সাথে বোধ হয় অপারেশন থিয়েটারে যায়, না জানি সারা রাত বাসার বাইরে হাসপাতালে কাটায়, কিভাবে কাটায়!
এই ধরনের বাজে মন্তব্য আমাদের অনেক নারী চিকিৎসককে শুনতে হয়। হয়তো কণ্ঠ দিয়ে অনেকেই বলেন না, মনে মনে চিন্তা করেন। ব্যাধিগুলো দূর হয়নি। যেই নারী কর্মীরা রাতের বেলা ডিউটি করে, অনেক পরিবারেই তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। আমাদের নারী সমাজে এখনো পুরুষদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। একজন পুরুষ বা স্বামী অথবা বাবার নাইট ডিউটি থাকলে এতোটা ভোগান্তির শিকার হতে হয় না। কিন্তু বাসার নারী সদস্যটাকে পড়তে হয় বিভিন্ন রকম ভোগান্তিতে। আমাদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট নারী পুরুষের বৈষম্যের জন্য এই সমস্যাগুলো হয়। যা কখনোই কাম্য নয়।
বাসাতে নারী ও পুরুষ বা স্বামী-স্ত্রী সমানভাবে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারলে, সংসারে সহজেই সচ্ছলতা আসবে। নারী-পুরুষ উভয়েই বুঝতে পারবেন, যে আমাদের সমাজে যে একচেটিয়া, পুরুষেরা টাকা অর্জন করেন, তা ভীষণ কঠিন। স্ত্রী আয় করতে পারলে, তখন তিনিও স্বামীর উপার্জনকে শ্রদ্ধা করতে শেখেন। যারা আয় করতে পারেন না, তারা স্বামীর উপার্জনের কষ্ট বোঝেনা, তা নয়। তবে যে, স্ত্রীরা অর্জন করতে পারেন, তারা একই সাথে স্বাবলম্বী ও দূরদর্শী হয়ে ওঠেন।
চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্স বা সেবিকা কার্যে নিয়োজিত নারীরাও নিয়মিত রাতে ডিউটি করেন। কারণ এটা তাদের পেশার একটি বড় অংশ। অনেক পরিবারে মেনে নিলেও বেশির ভাগ পরিবারেই মানতে চায় না। সংসারে টাকা দরকার দেখে হয়তো একজন স্বামী তার স্ত্রীকে মুখ ফুটে বলতে পারেন না, কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হন, যার প্রভাব পরে ব্যক্তিগত জীবনে। মনের মাঝে পুঞ্জীভূত হওয়া বিরক্তি বা ক্ষোভ থেকে সংসারে বাধে অশান্তি। যা কখনোই কাম্য নয়।
আমাদের সমাজে পাইলট, চিকিৎসক, সেবিকা, এই ধরনের পেশার মানুষদের নিয়মিত রাতে ডিউটি করতে হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই নাইট-ডিউটিতে সমস্যা হয় না অথচ নারীদের ক্ষেত্রে চিত্রটা প্রায় ক্ষেত্রেই বিপরীত। নারী চিকিৎসক বা সেবিকাদের রাতের বেলা ডিউটি থাকে অন্য পেশার নারীদের তুলনায় অনেক বেশি। পাশ্চাত্য দেশগুলোকে নারীরা যেভাবে এগিয়ে গেছে পুরুষদের মতো, আমাদের দেশের নারী সমাজ এখনো পেছনে পড়ে রয়েছে বহুগুণে।
এই অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ-
(১) পরিবারের ছেলে সন্তানদের সব রকম সুযোগ সুবিধা মেয়ে সন্তানদের তুলনায় বেশি দেয়া।
(২) এখনো সন্তান জন্মের সময় মেয়ের পরিবর্তে ছেলে সন্তান কামনা করা। মেয়ে সন্তান হলে অনেক পরিবারের সদস্যরা এখনো মন খারাপ করে। কারণ সুযোগ সুবিধা বেশি দেয়ার জন্য পুরুষরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় টিকে যায়। ফলে সবার বদ্ধমূল ধারণা, যে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি বুদ্ধিমান। তাই সন্তান জন্ম হবার সময় সবাই মেয়ের পরিবর্তে ছেলেকে এখনো আশা করে থাকে।
(৩) সঠিকভাবে মেয়েদের নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। এই জন্য রাতে ডিউটি হলে নিরাপত্তাহীনতার কারণে পরিবারের সদস্যদের মাঝে নানান রকম দুশ্চিন্তা কাজ করে। আর এই দুশ্চিন্তার জন্য বাসার বউ বা মেয়ে সদস্যটির রাতে ডিউটির কথা শুনলে অন্যরা খুশি হতে পারেন না। সব চিকিৎসক বা সেবিকারা পরিবার থেকে বঞ্চিত হয়, এমনটি নয়, তবে বেশির ভাগ নারী চিকিৎসকেরা এই পরিস্থিতির শিকার হন। কারণ, রোগীর প্রয়োজনে চিকিৎসকেরা নিয়মিত রাতে ছুটে যান হাসপাতালে।
নাইট ডিউটিকে কেন্দ্র করে মানুষ জনের মাঝে থেকে দূর হোক নেতিবাচক ভাবনা, এই জন্য আমাদের করণীয়-
(১) আমাদের ভেতর থেকে নেতিবাচক ধারণাগুলো দূর করে, নারী জাগরণে শামিল হতে হবে।
(২) পরিবারের সবাইকে অনুভব করতে হবে, যে, নারী পুরুষ দুজনেই পরিবারে সমান গুরুত্বপূর্ণ। একজন মেয়ে যদি ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তবে একজন পুরুষের মতোই দায়িত্ব পালন করতে পারবে। নিজের বাবা মা ও শ্বশুর বাড়িতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
(৩) গণমাধ্যমগুলোকে নারী সমাজের উন্নতি ও জাগরণের জন্য আরো বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
(৪) সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো বেশি কর্মতৎপর হতে হবে।
(৫) যে কোন সমস্যা পরিবারের সবার সাথে আলোচনা করলে, সবার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বাড়বে। এতে বাবা-মা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী সবার মধ্যে বিশ্বাস বোধ বাড়বে। ফলে ভুল বোঝার সম্ভাবনা কমে আসবে।
(৬) স্বামী, স্ত্রীকে হতে হবে পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু। দলিলে স্বাক্ষর দিলেই স্বামী বা স্ত্রী হওয়া যায়। কিন্তু সুখি হবার জন্য স্বামী স্ত্রীকে খুব ভালো বন্ধু হতে হয়। সবাই ভালো বন্ধু হতে পারেনা। যারা যতো ভালো বন্ধু তারা ততো বেশি সুখী হয় পারিবারিক ও কর্মজীবনে। পরস্পরের মধ্যে কোন সন্দেহ হলে মান অভিমান না করে, বুদ্ধিমানের কাজ হলো সরাসরি প্রশ্ন করা। এতে অনেক সন্দেহ দূর হবে। বাসার সবাইকে বুঝতে হবে যে, বাড়ির পুরুষ মানুষটির যেমন কর্মক্ষেত্র আছে, বাসার নারীটিরও তেমন কর্মক্ষেত্র রয়েছে। এই সত্যটাকে উপলব্ধি ও শ্রদ্ধা করতে হবে।
(৭) ছেলেমেয়েদেরও বোঝাতে হবে যে, মা চাকরি করেন। কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনে তাকে রাতে ডিউটি করতে হয়। সম্ভব হলে স্বামী বা ছেলে মেয়েদেরকে নিজের কর্মক্ষেত্রে সুযোগ বুঝে নিয়ে যান। এতে তারা বুঝতে পারবে, যে আপনাকে কতোটা কঠিন সময় পার করতে হয়। আপনি কষ্ট করে যে টাকা উপার্জন করেন, তা আপনার পরিবারের জন্যই, অন্য কারো জন্য নয়, বা শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য নয়। এই সত্যটি পরিবারের সবাইকে অনুভব করতে হবে।
(৮) চিকিৎসক, পাইলট, প্রহরী (যদিও আমাদের দেশে নারী প্রহরী সংখ্যাতে একেবারেই নগণ্য, বিশেষত রাতের বেলা ডিউটি করার জন্য), সেবিকা এই ধরনের পেশাজীবীদের রাতের বেলা ডিউটি করতে হয়। অবস্থার প্রয়োজনে প্রায়ই সারারাত জাগতে হয়। তাই ডিউটি শেষ হবার পরে বাসায় এসেই অনেকে ঘুমিয়ে পড়েন। এতে অনেক পরিবারের সন্দেহ আরো প্রকট হয়ে ওঠে। পরিবার ও অন্যান্য সবাইকে বুঝতে হবে যে, দিনের সব কাজ শেষে, সারারাত জেগে কাজ করাটা অনেক কষ্টের কাজ। প্রতিটি মানুষেরই ৬-৭ ঘন্টা নিয়মিত ঘুমানো উচিৎ, মানুষতো যন্ত্র নয়। তাই নাইট ডিউটি শেষে বাসায় এসে ঘুম পাবে, মেজাজ খারাপ লাগাটাও স্বাভাবিক।
(৯) প্রতিটি মা ও মেয়েকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে যে, মেয়ে মানেই ঘরের সৌন্দর্য নয়, একজন মেয়ে একই সাথে ঘর ও বাহিরের কর্মজগতের যোগ্য হতে পারে। এতে পরিবার ও পরিণামে একটি জাতির জন্য মঙ্গল।
(১০) এখনো প্রায় সব পরিবারে সম্পত্তি ভাগের ক্ষেত্রে ছেলেদের সিংহ ভাগ দেয়া হয়। ছেলেমেয়েকে সব কিছুতে সমান গুরুত্ব দিলে, একজন মেয়ে হয়ে উঠবে একজন পুরুষের মতো শক্তিশালী। যা শুধু একটি পরিবার নয়, একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভীষণ জরুরি।
পারস্পরিক বিশ্বাসবোধ, বন্ধুত্ব আর নারীকে পুরুষের মতো মূল্যায়নে সম্মানিত হোক সাদা এপ্রন। নারী পুরুষের সম পরিমাণ সাফল্যে ধন্য হোক পরিবার।
লেখক : এমবিবিএস (ডি.ইউ), পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন (পাবলিক হেল্থ), পিজিটি (গাইনী এন্ড অবস্), রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার (গাইনি এন্ড অবস্), স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ। ডায়াবেটোলোজি, বারডেম হসপিটাল।
এইচআর/পিআর