ভিড়ের মধ্যে চেনা মুখ


প্রকাশিত: ০৩:৫৭ এএম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আমার মা ছিলেন কার্জন হলের ছাত্রী, বাবা কলা ভবনের। মা থাকতেন রোকেয়া হলে, বাবা নাকি ঢাকায় এসে প্রথমে উঠেছিলেন এস এম হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বাংলা একাডেমি, রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- এই এলাকাগুলোর সাথে মিশে আছে আমাদের তিন ভাই বোনের শৈশব, কৈশোর। বড় হয়েছি আজিমপুর কলোনিতে। বাবা, মা সময় পেলেই আমাদেরকে নিয়ে কখনো পায়ে হেঁটে  কখনো এক রিকশায় তিন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এই সব এলাকা চষে বেড়াতেন। ছুটির দিনে সকালে কিংবা কোন পড়ন্ত বিকেলে।

সে সময় প্রতিটি দিনই ছিল রঙিন। শৈশবের অনাবিল আনন্দে ঘেরা দিন। কিন্তু তার মাঝেও বিশেষ কিছু দিন, বিশেষ কিছু সময় ছিল অন্য ধরনের আকর্ষণে ঘেরা। যেই দিন গুলোর, যেই সময়গুলোর জন্য সাড়া বছর অপেক্ষা করতাম। পহেলা বৈশাখ আর একুশের বইমেলা তার মধ্যে অন্যতম।

বই পড়তে খুব ভালবাসতাম ছোটবেলা থেকেই। মা যে কলেজে পড়াতেন তার লাইব্রেরিটা ছিল বড্ড পুরনো। সেই পুরনো লাইব্রেরির জরাজীর্ণ, সেলাই ছুটে যাওয়া সব বই নিয়েই মেতে ছিলাম আশৈশব। ছোটদের বিশ্বকোষ, রুশ দেশের উপকথা, ঠাকুমার ঝুলি সবই শেষ হয়ে গেল একসময়। কিন্তু আমার পড়ার তৃষ্ণা মেটে  না। পাড়ার ছোট্ট লাইব্রেরি থেকেও বই কিনতাম, বই বিনিময় করতাম বন্ধুদের সাথেও।

সহজ বাংলায় যা পেতাম, তাই পড়তাম। তারপর একদিন একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। ক্লাস ফোরে বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য সকুল থেকে পেলাম সত্যজিৎ রায়ের `ফটিক চাঁদ`। হলুদ মলাটে নীল রঙের কিশোর ফটিকের ছবি, স্মৃতি মুছে যাওয়া ফটিক। সেদিনের সেই ভালোলাগা আজও আমার বুকের গভীরে কোথাও লুকানো আছে। বইয়ের প্রতিটা বাক্য পড়ছি গোগ্রাসে, নিজেকে ফটিক ভেবে নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে। কার উপরে যেন অভিমান হচ্ছে। নতুন বইয়ের সেই অসম্ভব ভালোলাগা গন্ধের সাথে মিলে মিশে যাচ্ছে সেই কষ্ট। আস্তে আস্তে পরিচয় হতে থাকলো বিশ্বের নাম করা সব লেখকদের সাথে। আমার চোখের সামনে একটা একটা করে বন্ধ দরজা খুলতে লাগলো।

প্রথম কবে বই মেলায় গিয়েছি মনে নাই। বাবা, মায়ের সাথেই গিয়েছি। ছোট ছোট তিন ভাই বোন, আমি আর আমার পিঠাপিঠি দুই ভাই। তখন এতো বেশি ভিড় হতো না। অনেক বেশি স্টলও হতো না। তবে আমাদের কাছে ছিল এক সোনার খনি। পুরো বছরে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল, জন্মদিন বা যে কোন ভালো কাজের পুরস্কার হিসেবে যে বই পাওনা হতো বাবা মায়ের কাছে সেগুলো কেনা হতো বই মেলায়।

শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত হতো জীবনী, অনুবাদ, বিজ্ঞানের উপরে বই। দুহাত ভরে বই কিনতাম। আসলে দুহাত ভরে কিনতাম সাড়া বছরের আনন্দ। বই কেনায় বাবা, মায়ের কাছে কখনো কোন বাধা পাই নি। বরং অনেক বেশি উৎসাহ দিতেন। সেদিন আর পায়ে হেঁটে  বাড়ি ফিরতে পারতাম না বইয়ের বোঝা নিয়ে। কখনো গোধূলি বেলায়, কখনো বা সন্ধ্যা পেরিয়ে  বাড়ি ফিরতাম। এক অসম্ভব তৃপ্তি বুকে নিয়ে। বাসায় এসে ছটফট করতাম সেই বইগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত। ঝকঝকে নতুন বই, কতো রঙ বেরঙের মলাট।

বই মেলায় একবার  যেয়ে মন ভরত না। তাই মেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বায়না চলতো ঘুরে ফিরে যাওয়ার। বাবা, মায়ের সাথে অনেক বড় হওয়া পর্যন্তই বই মেলায় গেছি। এ যেন ছিল এক পারিবারিক উৎসব, অলিখিত এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তার পর কিছুটা বড় হয়ে কৈশোর পেরিয়ে  যেতাম ছোট ভাইদের সাথে। ওরাও খুব বই পড়তো, বিশেষ করে একদম ছোটটা। বইয়ের রুচিও ছিল অনেকটা একই ধাঁচের। তাই নতুন বই নিয়ে কতদিন কাড়াকাড়ি করেছি। যখনই যার সুযোগ হতো, সময় হতো চলে যেতাম বই মেলায়। সাড়া বছর ধরে তাই ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য প্রতীক্ষা।

ইউনিভার্সিটি শুরুর পরে যেতাম বন্ধুবান্ধবের সাথে। ততদিনে বইমেলার পরিসর অনেক বেড়েছে। স্টল বেড়েছে। বইয়ের আমদানি বেড়েছে। ভিড়ও বেড়েছে। লেখকরা এসে বসতেন বইয়ের স্টলে। যেসব স্টলে লেখকরা থাকতেন, সেখানে লম্বা লাইন দেখা যেত। উঁকি ঝুঁকি মারতাম, মনের মতো লেখক হলে সেই লম্বা লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে যেতাম। লাইনে দাঁড়িয়ে চলতো আড্ডা।

ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই যাওয়া শুরু করতাম অধীর  আগ্রহে, কতদিনে মেলা জমে উঠবে সেই আশায়। কখনো সখ করে শাড়ি পরেও গেছি। বই মেলার আড্ডা, ভিড়, নতুন বই, হইচই, ভিড়ের মধ্যে চেনা মুখ সব কিছুই বড্ড আপন, নিজের অংশ হয়ে গিয়েছিল। বিদেশে এসে দেশের যেসব জিনিস খুব মিস করি, তার মধ্যে বইমেলা অন্যতম। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই তাই মন খারাপ  হয়ে যায়। মন চলে যায় একুশের বই মেলায়।

কোন দিন কল্পনা করিনি যে আমার প্রিয় বই মেলায় একদিন আমার নিজের কোন বই প্রকাশিত হবে, লেখক হিসেবে পাঠকের সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হবে। গত বছর বই মেলায় সেই অকল্পনীয় ঘটনাটা ঘটে গেলো। আমার প্রথম দুটো বই প্রকাশ হল, বই দুটোর নাম `পলাতক স্মৃতি` আর `প্রবাসিনীর আনন্দ বেদনা`। প্রকাশ করেছিল `সমগ্র প্রকাশনী`। নাহ, আমি দেশে যেতে পারি নি। পুরোটা ফেব্রুয়ারি মাস আমার মন পড়ে ছিল বই মেলায়। এবারও প্রকাশিত হচ্ছে একটি বই  `ভালোবাসা অধরা`, প্রকাশ করছে `ঐতিহ্য` ।  এবারও যাওয়া হল না। তবে আমি আশা ছাড়ি নি। আমি জানি একদিন আমি নিশ্চয়ই বই মেলায় থাকবো, আমার পাঠকদের সাথে। আমি সেইদিনের অপেক্ষায় আছি।   

লেখক : ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী, লেখক।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।