বনদেবীরা আজ কোথায়?


প্রকাশিত: ০৩:৫৯ এএম, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

গভীর অরণ্য। সেই অরণ্যকে রক্ষা করেন এক কুমারী দেবী। নাম তার আর্টেমিস। তিনি দেবরাজ জিউসের কন্যা হলেও দেবতাদের বাসস্থান অলিম্পাসে খুব একটা দেখা যায় না তাকে। বরং তিনি অরণ্যচারী। বনের সব পশুপাখি ও গাছপালাকে রক্ষা করেন এই চিরকুমারী দেবী।

পিঠে তার তীরধনুক। চিরসঙ্গী শিকারী কুকুর।কেউ অরণ্য ধ্বংস করতে গেলে কিংবা বনের পশুপাখিকে আঘাত করলে আর্টেমিস তার প্রতিশোধ নেন। গ্রিক পুরাণে এভাবেই চিত্রিত করা হয়েছে অরণ্যদেবী আর্টেমিসকে। আরও আছেন ড্রায়াড নামে অরণ্যপরীরা। ড্রায়াডরা বনপরী। বন ধ্বংস হলে ড্রায়াডদের মৃত্যু ঘটে। গ্রেকো-রোমান পুরাণে ফুল, ফল বৃক্ষেরও রয়েছে আলাদা আলাদা বনপরী।

ঋগ্বেদে অরণ্যের দেবী হিসেবে অরণ্যানীর কথা উল্লেখ রযেছে। ঋগ্বেদে তার বর্ণনায় রয়েচে তিনি অরণ্যের দেবী। পায়ে তার নূপুর। তিনি একাকী ঘুরে বেড়ান বনে বনান্তরে। অরণ্যের পশুপাখি সবাইকে রক্ষা করাই তার কাজ।তৈত্তরীয় ব্রাক্ষণেও অরণ্যানীর উল্লেখ রয়েছে। বৈদিক পুরাণে শিব হলেন পশুপতি। আর বিষ্ণু হলেন সকল জীবের পালক। তাছাড়াও প্রত্যেক অরণ্যের পৃথক দেবদেবী রয়েছেন। ঊনিশ শতকে ঢাকার সিভিল সার্জেন ওয়াইজ তার বইতে পূর্ববঙ্গের বনদেবতা ও জলমাটির দেবতাদের কথা উল্লেখ করেছেন। এই অরণ্য, পাহাড়, নদনদীর ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবীরা ছিলেন স্থানীয় এবং লোকজ সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত। এরা ছিলেন প্রধানত অনার্য দেবদেবী।

বিশ্বের অনেক পুরাণ, রূপকথা, উপকথায় রয়েছে অরণ্যপরী ও বনদেবীর উপাখ্যান। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের লোকজপুরাণ অনুযায়ী অজা, ইয়োরবা ওরিশা হলেন অরণ্যের গাছপালা ও জীবজন্তুর দেবতা। ইথোপিয়া ও ইয়েমেনের লোককাহিনীতে ধাট-বাদান নামে মরুদ্যানের দেবতার কথা বলা হয়েছে।লিথুনিয়ার লোকপুরাণ অনুযায়ী মেডেইনা হলেন অরণ্য, গাছপালা, পশুপাখিসহ সকলের রক্ষাকারী প্রকৃতিদেবী। সেল্টিক, ফিনিশীয়, চীনা, জাপানি পুরাণেও প্রকৃতিদেবীর উল্লেখ রয়েছে। চীনা মিথোলজি অনুযায়ী পিওনিসহ প্রতিটি ফুলের রয়েছে আলাদা আলাদা দেবদেবী।
 
লোকজ সাহিত্যে এইসব বনদেবদেবীদের উল্লেখ থাকার কারণ হলো প্রাচীন বিশ্বের প্রতিটি সভ্যতাতেই মানুষ অরণ্য এবং তার জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিল। প্রাচীন বিশ্বের মানুষ জানতো মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে অরণ্যকে রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে বনের জীববৈচিত্র্যকে, বৃক্ষলতাগুল্মকে। কিন্তু প্রাচীন মানুষের যা জানা ছিল আধুনিক মানুষের সে বিষয়ে চেতনা নেই। তাই বিশ্বজুড়ে ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে বন। হারিয়ে যাচ্ছে জীব প্রজাতি। অনেক পশুপাখি গাছপালার প্রজাতি আজ লুপ্ত। অনেকগুলোই বিলুপ্তির পথে।

আমাদের একান্ত আপন সুন্দরবনেরও বনদেবী ও দেবতা এবং পীরের উল্লেখ রয়েছে লোকজসাহিত্যে। লোকজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এই অতিপ্রাকৃত সত্তায় বিশ্বাস করেন ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে স্থানীয় জনগণ।

সুন্দরবনের এই উপকথার নায়করা হলেন বনবিবি, দক্ষিণ রায়, গাজী, কালু, চম্পাবতী, দুখাই ও আরও অনেকে। সুন্দরবনের মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে বনবিবি হলেন পিরানি। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে তিনি বনদেবী। কোনো কোনো অঞ্চলে তিনি বনদুর্গা হিসেবে পূজিত। দক্ষিণ রায় ছিলেন অত্যাচারী দেবতা বা রাজা যিনি বাঘের রূপ ধরে ঝাঁপিয়ে পড়তেন মৌয়ালদের উপর। বনবিবি যুদ্ধ করে দক্ষিণ রায়কে পরাজিত করেন। পরে অবশ্য দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে তার সন্ধি হয়। তারা দুজন আপোসে বন ভাগ করে নিয়েছেন। তাদের মূল দায়িত্ব সুন্দরবন এবং অরণ্যের পশুপাখি ও অরণ্যচারী মানুষকে রক্ষা করা।

বিভূতি ভূষণের আরণ্যক এ পড়েছিলাম সাঁওতালদের বনদেবতা টাঁড়বারোর কথা। এই দেবতা বুনোমহিষদের রক্ষা করতেন। আমাদের সুন্দরবনের বাঘের দেবতা হলেন দক্ষিণ রায়। জেলে ও বনজীবীদের দেবতা(মতান্তরে পীর) হলেন গাজী। তার মুখে দাড়ি।পরনে লুঙ্গি, ঘাড়ে গামছা। বনজীবীদের রক্ষা করেন গাজী।

বনবিবির আশ্রিত একটি বালকের নাম দুখাই। সুন্দরবনের অনেক জায়গায় বনবিবির মূর্তির সঙ্গে দুখাইকে দেখা যায়। অরণ্যের এক নারীর কোলে বসা এক শিশু। এই হলো বনবিবি ও তার আশ্রিত দুখাইয়ের প্রতিমা। দুখাইকে দক্ষিণ রায়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন বনবিবি।

সুন্দরবন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, জাতীয় সম্পদই শুধু নয়, এ অরণ্য আমাদের একান্ত আপন। এই অরণ্য ধ্বংস হওয়ার সামান্য আশংকাও আছে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। ওই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য শিল্প কারখানার প্রয়োজন নেই। বরং সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হলেই ওই অঞ্চলের মানুষ যথেষ্ট কাজ পাবে। পর্যটক যত বেশি আসবেন ততো স্থানীয় অর্থনীতি বিকশিত হবে। সুন্দরবন আমাদের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদকে রক্ষা করেই তাকে ব্যবহার করতে হবে ওই অঞ্চলের মানুষের স্বার্থে। বিদ্যুৎকেন্দ্র তো দেশের অন্য অঞ্চলেও গড়ে তোলা সম্ভব। একটি সুন্দরবন গড়ে উঠতে প্রকৃতির ব্যয় হয় হাজার হাজার বছর। কিন্তু ধ্বংস করতে মানুষের প্রয়োজন হয় একটি ভুল সিদ্ধান্ত।

সুন্দরবন রক্ষা নিয়ে আন্দোলন চলছে।আর এই আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশী বর্বরতার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিবাদের ঝড়। আহা, সুন্দরবনকে রক্ষা করতে এখন যদি এগিয়ে আসতেন বনবিবি, দক্ষিণ রায়, গাজী, কালু, চম্পাবতী! সুন্দরবন শুধু আমাদের নয়, বিশ্ববাসীর সম্পদ। বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতীক। বনদেবী আর্টেমিসকে এখন বড় প্রয়োজন। প্রয়োজন সকল পুরাণের সকল অরণ্যদেবদেবীকে।হে অরণ্যদেবীরা, দেবতারা তোমরা আজ কোথায়?

লেখক : কবি, সাংবাদিক।
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।