নিজের একটি ঘর, নারীর একলা আকাশ


প্রকাশিত: ০৪:০৮ এএম, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২০০৫ সাল। সবে চাকরিতে ঢুকেছি। ট্রেনিং এ যেতে হবে উগান্ডা। অফিস থেকে দ্রুত পাসপোর্ট জমা দিতে বললো। চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে গেলাম পাসপোর্ট করার জন্য। সেখানেই শুরু হলো আমার শিক্ষা সফর। প্রথমেই প্রশ্নের মুখোমুখি, কেন বিদেশে যাবেন? তারপরের প্রশ্ন, আপনি একা কেন যাবেন? আমি জানতে চাইলাম, সেটা দেখা কি আপনার কাজের মধ্যে পড়ে? এর পর প্রশ্ন করলেন, আপনি বিবাহিত? আমি খুব বিনীত ভাবে বললাম, হ্যাঁ আমার একটি স্বামী আছে। তিনি বললেন, কাবিননামা দেখান। আমি বললাম, কাবিননামা কেন লাগবে? উত্তরে বললেন, “বিয়ে প্রমাণের জন্য”!!

…কি অদ্ভুত কথা, আমার বিয়ে আপনি প্রমাণ করবেন কেন? আর সন্তান জন্ম দানের জন্য বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আমি স্বীকার করি, কিন্তু পাসপোর্টের জন্য বিয়ের প্রয়োজনীয়তা কোথায় আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তাছাড়া, আমার স্বামী যখন পাসপোর্ট করলেন তখন তাকে কিন্তু বিয়ে প্রমাণ করা লাগেনি। আমাকে কেন করতে হবে একটু বুঝিয়ে বলবেন দয়া করে? উনি বুঝিয়ে তো বলেনই নি, বরং এমন এক গ্যাড়াকলে ফেলে দিলেন যে, আমাকে কাবিননামা উদ্ধার করার জন্য ঢাকা আসতে হলো। ঢাকা থেকে কাবিননামা নিয়ে ছুটে গেলাম চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে।

ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু এখান থেকে ঘটনা কেবল শুরু হলো। আমি স্থায়ী ঠিকানার ঘরে আমার বাবার বাড়ির ঠিকানা দিলাম। সে ঠিকানায় ভেরিফিকেশনে গিয়ে শুরু করলো নতুন ক্যাচাল
-আপনি বিবাহিত কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা কেন বাবার বাড়ির ঠিকানা দিলেন?
-এটাই তো আমার স্থায়ী ঠিকানা।
-না, আপনার স্থায়ী ঠিকানা হলো আপনার স্বামীর বাড়ির ঠিকানা। অথবা শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা
-সে ঠিকানা কেন আমার স্থায়ী ঠিকানা হবে? বড়জোর বর্তমান হতে পারে। আর আমার ঠিকানা আপনি ঠিক করে দিবেন?
-না, আইন দিবে।
-ঠিক আছে, আইন দেখান।
তিনি বাঙালকে আইন দেখিয়ে ভেরিফিকেশন পাঠিয়ে দিলেন আমার শ্বশুরবাড়ি। আমি আবার ছুটে গেলাম ওখানে। এখানেও সেই একই ক্যাচাল। বললেন ঠিকানা চেঞ্জ করতে হবে। আমি ঘাড়ের রগ যে কয়টা আছে সব কয়টা ফুলিয়ে বললাম, আমি যেখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি সেটিই আমার স্থায়ী ঠিকানা। আজকে একজন একটা কাগজের চুক্তি নিয়ে আমার জীবনে যুক্ত হলো বলে আমাকে আমার ঠিকানা পাল্টে ফেলতে হবে? অসম্ভব। দরকার হলে পাসপোর্ট হবে না, চাকরি করবো না। আমার ত্যাড়া ঘাড় সোজা করার চেষ্টা করতে আমার শ্বশুর আসলেন আমাকে বোঝাতে। আমি আগেই তাঁকে প্রশ্ন করলাম, “বাবা, আপনি কি বিশ্বাস করেন, এই ঠিকানা আমার স্থায়ী ঠিকানা ?
-মারে, সমাজ তো তাই বলে।
-তাহলে কাল যদি আপনার ছেলের সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়?
-তাহলে যাকে আবার বিয়ে করবে তার ঠিকানা হবে তোমার স্থায়ী ঠিকানা।
-আর যদি কাউকে বিয়ে না করি?
-তোমার বাবার ঠিকানা, অথবা ভাইয়ের ঠিকানা
-মানে, আমার নিজের কোন ঠিকানা নেই?

...তিনি অসহায় হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন।
ওদিকে বসার ঘরে পুলিশ সাহেব মনের সুখে সেমাই খাচ্ছেন। আমি নির্বিকার। আমি ঠিকানা চেঞ্জ করবো না। অবশেষে ছেলের সাহায্য চাইলেন শ্বশুর। সে কিছু বলতে আসার আগেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- তুমি কি বিশ্বাস করো তোমার ঠিকানা আমার স্থায়ী ঠিকানা?
-না আমি বিশ্বাস করিনা। আমি এটা বিশ্বাস করি যে, আমরা সঙ্গী হিসেবে স্থায়ী হবো। তার মানে এই না যে আমার ঠিকানা তোমার স্থায়ী ঠিকানা হবে। কিন্তু এটা তো একটা সামাজিক লড়াই, এবং সময়সাপেক্ষও। তাই আপাতত কি পাসপোর্টের ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলা যায়?
-না, যেহেতু একটা পাসপোর্ট মানে আমার ন্যাশনাল আইডেন্টিটি। সেখানে আমি কোন ফাঁক রাখবো না। আমি স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে আমার জন্মস্থানের ঠিকানা ব্যবহার করতে চাই।

তারপর দুজনে মিলে পুলিশ অফিসারকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হয়ে বললাম, আপনার যা খুশি রিপোর্ট করেন, কিন্তু আমি ঠিকানা পরিবর্তন করবো না। এবং শেষ পর্যন্ত আমার “বাবার” বাড়ির ঠিকানাতেই আমার পাসপোর্ট ইস্যু হলো। কীভাবে, সে গল্প বিশাল। অন্য একদিন হবে।

এই ব্যক্তিগত ঘটনা আমাকে যে সত্যের সামনে এনে দাঁড় করলো তা হলো, পুরুষের এই পৃথিবীতে নারীর জন্য কিছুই নেই। এক জীবনে নারীকে বারবার বাবার বাড়ি, স্বামীর বাড়ি, ভাইয়ের বাড়ি, মামার বাড়ি, ছেলের বাড়ি, ইত্যাদি নানা পুরুষের ঠিকানা বদল করতে হয়। নারী জীবনের অমোঘ নিয়তি হলো কোন না কোন পুরুষের কেয়ার অফ এ থাকা। যে বাড়ি নিজের বলে জেনে বড় হয়েছে এতোগুলো বছর, এক সুন্দর সকালে সে বাড়ি ছেড়ে তাকে উঠতে হয় শ্বশুরের বাড়িতে। নিজের নামটুকুও পাল্টে ফেলে স্বামীর নাম জুড়ে দিতে হয়। এর পর থেকেই নারী আর নিজের জন্য বাঁচেনা। অন্যের আশ্রয়ে, অন্যের দেয়া ভাত কাপড়ে, অন্যের পরিচয়ে, অন্যের ঠিকানাকে ব্যবহার করে বেঁচে থাকে। যেহেতু নারী অন্যের করুণাতেই জীবন ধারণ করে, সেহেতু নারীকে তার মূল্যও দিতে হয়, এবং নারী সে মূল্য ষোলগণ্ডায়ই আদায় করে।  

এদেশের মেয়েদের নিজের ঘর নেই, ঠিকানা নেই। আছে শুধু একটা সত্য । তা হলো “বের হয়ে যাও”। “আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও” আমাদের পুরুষ প্রভুদের বড়ো প্রিয় শব্দ। এদেশের বেশিরভাগ নারী এক জীবনে  স্বামী বা বাবার মুখে অসংখ্যবার এই “বেরিয়ে যাও” কথাটা শুনে। স্বামীর ঘর কে নিজের মনে করে শহীদ হয়ে যাচ্ছে নারীরা, স্বামীকে রাগালেই সে ঘর থেকে হুংকার উঠে, “বের হয়ে যাও”। কেউ ভদ্রভাবে বলে, ‘না পোষালে চলে যাও’...কেউ বলে ‘এক্ষুণি বের হ’...ভাষা যাই হোক না কেন, জাত এদের একটাই, পুরুষ। এদের ভেতরের মসলাটা এক ও অভিন্ন স্বাদের।

এদেশে পুরুষের ইশারায় গাছের পাতা নড়ে, পাখিরা গান গায়, আকাশে চাঁদ উঠে। সুতরাং যা খুশি তা করতেই পারেন এরা। ইচ্ছে হলেই মাঝরাতে ঘর থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিতে পারে, যে ঘর মেয়েরা নিজের মনে করে ফুলতোলা পর্দা-বালিশ-চাদর, হাঁড়ি পাতিল, মসলা, মেজবানে ডুবে থাকে। আমারই এক আত্মীয়কে আমি দেখেছি মাঝরাতে তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিতে, যে ঘরকে মেয়েটি নিজের মনে করে সাজাতো। তার চেয়েও নির্মম ঘটনা হলো, মেয়েটি যখন তাঁর বাবার কাছে আশ্রয় চাইতে গেলো, বাবা নিজে এসে আবার সেই ঘরেই ফিরিয়ে দিয়ে গেলো, যে ঘর থেকে মাঝরাতে সন্তানসহ ঘর থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল সে।  

ভাবছেন আপনাকে তো কখনো বলেনি? এখনো হয়তো বলেনি, তার মানে কিন্তু এই নয়, কখনো বলবে না। যখন সংসারটা একটু গুছিয়ে বসবেন, বয়সটা একটু হেলতে শুরু করবে, যখন আর কিছু করে খাওয়ার মতো সময়, শক্তি, সামর্থ কোনটাই থাকবে না, তখন বের হয়ে আসবে সেই মহান পুরুষকণ্ঠের অমোঘ বাণী, “বেরিয়ে যাও”। যতোই স্বামীর গায়ে ভ্যাসলিন আর বডিলোশন ঘষুণ না কেন, রোজগার করে তার পাশে দাঁড়ান না কেন, এক জীবনে এই বাক্য আপনাকে শুনতে হবেই কোন না কোন মহেন্দ্রক্ষণে। আর যদি আপনি সেই কথা শুনে আবার ত্যাজ দেখিয়ে সত্যি সত্যি বের হয়ে যান, তবে তো ঘরও গেল, জাতও গেল, চরিত্রও গেল। তবে চুপি চুপি বলি, বের হতে পারলে কিন্তু বেঁচে যাবেন। একদিন যখন এই ‘বের হয়ে যাও’ শুনে সত্যি সত্যিই এদেশের মেয়েরা রাস্তায় বের হয়ে আসতে পারবে, সেদিন হবে মেয়েদের মুক্তির দিন।

আর যদি ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বামীকে বলতে পারেন ‘তুমি বের হয়ে যাও’ তবে দেখতে পাবেন জম্বি কাকে বলে!! কিন্তু তার জন্য কোমড়ের জোর চাই যে!! সেই জোর হলো নিজের মানিব্যাগ আর নিজের ঘর। বাবার নয়, স্বামীর নয়, ছেলের নয়, একান্ত নিজের একটি ঘর। যে ঘরের কথা ভার্জিনিয়া উলফ বলেছেন বারবার। তিনি বলেছেন, নারীকে স্বীকৃতি পেতে হলে অবশ্যই পুরুষশাসিত সমাজের শক্তিশালী শোষণ অর্থনৈতিক স্বার্থপরতা ও নিয়ন্ত্রণের মতো দুর্বার বাঁধাগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। ন্যূনতম পক্ষে নিজস্ব একটা ঘর শুধু এই অবস্থা থেকে নারীকে মুক্ত করতে হবে। তাই সব কিছুর আগে একটি ঘরের ঠিকানা তৈরি করতে হবে মেয়েদেরকে। এই ঘরের চাবিটা তার নিজের হাতেই থাকবে এবং এই ঘরে নারী থাকবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ( A room of one’s own)।

সেই ঘরে স্বামীসহ সন্তান বাস করাতে কোনো আপত্তি নেই, তবে ঘরটাকে নিজের বলার মত জোরটুকু ধরে রাখতে হবে, মেয়ে। নিজের সব প্রিয় জিনিস দিয়ে স্বামীর বাড়ি সাজাবার চিন্তা অথবা স্বামী-সন্তানের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে বাবার বাড়ি গিয়ে ওঠার চিন্তা বাদ দিয়ে, নিজের একটা ঘরের কথা ভাবতে হবে ছোটবেলা থেকেই। তার জন্য সবার আগে যে নিয়মটার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে তা হলো বিয়ের পর  শ্বশুরবাড়ি বা স্বামীর বাড়ি না গিয়ে, মেয়েদের নিজের বাড়ি অথবা স্বামীর সাথে যৌথ বাড়িতে যাওয়া। সে বাড়ির নাম হবে নিজের বাড়ি, যেখান থেকে বের হয়ে যাও বলার দুঃসাহস করবে না কেউ।

না হলে নারী তোমার মুক্তি নেই। যেদিন নিজের একটি নিজস্ব ঘরের মূল্য বুঝতে পারবে,  নিজস্ব আকাশে একলা ওড়তে পারবে, সেদিনই স্বাধীন হবে তুমি। তাই মাঝে মাঝে একা থাকাটাও শিখতে হয়। একা থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, নিজের উপর শ্রদ্ধা বাড়ে। একা থাকলে জীবনের আগাগোড়া পড়া যায়, স্বাধীনতাকে উপভোগ করা যায়। জীবনকে একলা যাপন করার ক্ষমতার নামই স্বাধীনতা।

এই ঘর, সংসার, দায়িত্ব, কোলাহল, সব কিছুর শেষে তো মানুষ আসলে একাই।

লেখক : প্রধান নির্বাহী সংযোগ বাংলাদেশ; কলামিস্ট ।

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।