ক্রিকেটারের হাতে হাতকড়া মানায় না

ইমাম হোসাইন সোহেল
ইমাম হোসাইন সোহেল ইমাম হোসাইন সোহেল
প্রকাশিত: ০৬:১০ এএম, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

যার হাতে থাকবে ব্যাট। যার হাতে থাকবে বল কিংবা গ্লাভস, যার সমস্ত চিন্তাজুড়ে বিরাজ করবে শুধুই ক্রিকেট, তার হাতে কি না উঠছে হাতকড়া। তিনি অভিযুক্ত, পুলিশের খাতায় নাম উঠে গেছে অপরাধী হিসেবে। সুতরাং পুলিশ অপরাধীকে তার বাড়ি থেকে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে এসেছে। আইনি ভাষায় নাম দেয়া হয়েছে ‘গ্রেফতার।’

জাতীয় দলের স্পিনার আরাফাত সানির গ্রেফতারের ঘটনায় এখন তোলপাড় পুরো দেশ। পুরো ক্রিকেটবিশ্ব। খেলাধুলার খবর যারা ছাপে, বিশেষ করে ক্রিকেটের খবর- সবাই গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে আরাফাত সানির গ্রেফতারের এই ঘটনা। সংবাদ প্রকাশের ভাষা যার যেমনই হোক, সংবাদটা বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। প্রকাশ ভঙ্গির কথা বলছি এ কারণে, কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা মাধ্যম সংবাদপত্রগুলো যে ভাষা ব্যবহার করেছে, তার অনেকগুলোই ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। প্রকাশযোগ্য-অপ্রকাশযোগ্য সব সংবাদের শিরোনামের শুরুতেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা সাড়ম্বরে জুড়ে দেয়া হয়েছে।

ক্রিকেটাররাই আমাদের মাথা উঁচু করেছে বহির্বিশ্বে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিতে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত খেলার যোগ্যতা অর্জন, কেনিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারের মত ট্রফি জয় আমাদের আগমনধ্বনি অনুরণিত হয়েছিল ক্রিকেটবিশ্বে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ওয়াসিম আকরামের নেতৃত্বাধীন প্রবল প্রতাপশালী এবং সেই বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন করে বাংলাদেশের পরিচিতি এনে দিয়েছিলেন ক্রিকেটাররাই।

এরপর একে একে ক্রিকেটাররাই বিশ্বমঞ্চে আমাদের পরিচিতির পরিধি বাড়িয়ে গেছেন নিরন্তর। ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তি, ভারতের বিপক্ষে উদ্বোধনী টেস্টেই ৪০০, আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানের ইনিংস, ২০০১ সালে মুত্তিয়া মুরালিধরন, চামিন্দা ভাসের মত বোলারদের বিপক্ষে ১৭ বছরের সদ্য কৈশোর পেরুনো আশরাফুলের সেঞ্চুরি (সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান), কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো, ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো, সুপার সিক্সে খেলা থেকে শুরু করে সাফল্যের মহিমায় একের পর এক নিজেদের যখন ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবং ক্রিকেটাররা, তখন এই দেশেরই মুখ উজ্জ্বল হয়েছে বহির্বিশ্বে। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যখন মাথায় লাল-সবুজ পতাকা বেঁধে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার জ্যাসন গিলেস্পির মত পেস বোলারকে ছক্কা মেরে দুরন্ত জয় এনে দেন, তখন এ দেশের কোটি মানুষের বুক গর্বে ফুলে ওঠে।

ব্যক্তিগত সাফল্যেও দেশকে উজ্জ্বল এবং বিশ্ব দরবারে সেরার আসনে নিতে পারেন ক্রিকেটাররা। সাকিব আল হাসান সেটাই দেখিয়ে দিলেন। তামিম ইকবাল ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে সেঞ্চুরি করে যখন অনার্স বোর্ডে নাম লেখান, এরপর তামিম-সাকিবরা যখন নাম তোলেন ক্রিকেটের বাইবেলখ্যাত উইজডেন অ্যালমানাকে, সোহাগ গাজী যখন ক্রিকেট ইতিহাসে বিরল সেঞ্চুরি এবং হ্যাটট্রিকের কীর্তি গড়েন, তখন এই দেশেরই মুখই উজ্জ্বল হয় বহির্বিশ্বে। যারা কখনো বাংলাদেশ নাম শোনেননি কিংবা হাজার কিলোমিটার দুরের কোনো মানুষ যখন বাংলাদেশ বলতে মানচিত্র ঘেঁটে ভারতের পাশের দেশটি খুঁজে বের করতো, তারাই এখন এক নামে বাংলাদেশকে চেনে।

এই বাংলাদেশই পারে শচীনের শততম সেঞ্চুরির দিনে ভারতকে হারিয়ে দিতে। শ্রীলংকা-ভারতকে পেছনে ফেলে এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলতে। তারাই পারে নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে বাংলাদেশকে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে দিতে। পারে পরপর দুই বলের ইয়র্কারে ইংল্যান্ডের মত দলকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দিতে। পারে বিশ্বকাপে টানা দুটি সেঞ্চুরি করতে।

এরাই পারে পাকিস্তানের মত দলকে হোয়াইটওয়াশ করতে। ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মত দলকে সিরিজে পরাজিত করে সারা বিশ্বের সমীহ কুড়াতে। এরাই পারে মোস্তাফিজুর রহমানের মত বিরল প্রতিভাধর কাটার মাস্টারের জন্ম দিতে কিংবা মেহেদী হাসান মিরাজের মত তরুণের হাতে ঘূর্ণির ফাঁদ তৈরি করে টেস্ট পরাশক্তি ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিতে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাই পারেন বাংলা ভাষাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে। মোস্তাফিজ যখন আইপিএল খেলতে ভারতের হায়দারাবাদে, তখন সানরাইজার্স হাদারাবাদে তার অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার থেকে শুরু করে ভারতীয় কিংবা বিদেশি সব ক্রিকেটার, কোচ এবং কর্মকর্তা সবাই বাধ্য হয়েছেন বাংলা শিখতে। গুগল ট্রান্সলেটের সহযোগিতা নিয়ে তারা মোস্তাফিজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলায়। টুইটার কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বাংলায়। লন্ডনে কাউন্টিতে খেলতে যাওয়ার পর মোস্তাফিজের ক্লাব সাসেক্স তাদের ফেসবুক পেজে বাংলায় স্ট্যাটাস দিতে বাধ্য হয়েছে।

ক্রিকেটারদের হাসি-আনন্দেই অনেকাংশে মিশে থাকেন এ দেশের কোটি মানুষ। ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে যখন পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানে আশাভঙ্গের বেদনায় নীল হয়েছেন সাকিব-মুশফিকরা, তখন মুশফিকের চোখের পানিতে ভেসেছেন দেশের কোটি সমর্থক। এই একটি খেলাই পারে বাংলাদেশকে এক কাতারে সামিল করে দিতে। ক্রিকেটারদের সাফল্যে এই দেশের মানুষ রাজনীতি, ধর্ম-বর্ণ ভুলে গিয়ে মিশে যেতে পারে একটি মিছিলে। ক্রিকেটের সাফল্যেই একে অপরের গায়ে রঙ ছিটিয়ে তারা বিজয় উদযাপন করে। তখন কে আওয়ামীলীগ, কে বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি, কে মুসলমান, কে হিন্দু- এসব বাছ-বিচার করে না কেউ। ক্রিকেটের এমনই এক অপার শক্তি!

মোট কথা ক্রিকেটাররা আমাদের হাসাতে পারেন, ক্রিকেটাররা আমাদের কাঁদাতে পারেন। ক্রিকেটাররা আমাদের পতাকাকে সমুন্নত করে দিতে পারেন সারা বিশ্বে। আজ এ দেশের ক্রিকেটের কোচ হওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতায় নামে বিশ্বের নামকরা ক্রিকেটার থেকে শুরু করে কোচরা। আমাদের ক্রিকেটই এ দেশের ক্রিকেট সংগঠককে বসিয়ে দিতে পারে আইসিসির শীর্ষস্থান, প্রেসিডেন্ট পদে।

ক্রিকেট নিয়ে এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখে। ক্রিকেটারদের নিয়ে স্বপ্ন দেখে। একদিন বাংলাদেশ বিশ্বজয় করবে, এ আশার সঙ্গে নিয়ত বসতি এখন এ দেশের ক্রিকেট পাগল মানুষের। বিশ্বও দারুণ সমীহ করছে বাংলাদেশকে। কোনো একদিন হয়তো বিশ্বমঞ্চে এই ক্রিকেটই পারবে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাকে পতপত করে ওড়াতে।

সেই ক্রিকেটাররাই যখন নিজেদের ভুলে বাংলাদেশের সম্মান ধুলোয় লুটান, তখন এ দেশের কোটি ভক্তের হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়। ক্রিকেটাররা শুধু ক্রিকেটেরই নয়, এ দেশের আইকন। শুভেচ্ছা দূত। তাদের দেখেই এ দেশ সম্পর্কে কোনো ধারণা জন্মাবে ভিনদেশি অন্য কোনো মানুষের হৃদয়ে। কিন্তু তারা যখন কোনো ভুল করে, তখনই লজ্জ্বার কালিমাটা বড় সাদা দেয়ালে এক পোছ কালো কালির মত বসে যায়। ক্রিকেটার রুবেল হোসেন গত বিশ্বকাপের আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করার দায়ে। মামলা করেছিলেন এক উঠতি নায়িকা। তখনও সারা ক্রিকেট বিশ্বে ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতি যারা চায় না, তারা রসদ পেয়ে গিয়েছিল সমালোচনা করার। সারা বিশ্বের সব মূল ধারার মিডিয়াতেই ফলাও করে প্রকাশ হয়েছিল হাতকড়া পরিহিত পেসার রুবেল হোসেনের ছবি।

ঘটনা যাই হোক, নারী নির্যাতনের ঘটনায় একজন ক্রিকেটার গ্রেফতার, পুলিশি হাতকড়া তার হাতে, এমন সংবাদ এবং ছবিতে বিব্রত এ দেশের ক্রিকেট, এ দেশের ক্রিকেট জনতা, সর্বোপরি এই দেশ। রুবেল এরপর খেলেছিলেন বিশ্বকাপ। দুর্দান্ত এক স্পেলে বিদায় করে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে। রুবেলের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে পুলিশি হাতকড়া পরলো ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীবের হাতে। অবশেষে আরেক নারীর করা মামলায় হাতকড়া পরলো আরাফাত সানির হাতে।

সাবেক ক্রিকেটার এবং জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল খুবই ক্ষিপ্ত ক্রিকেটারদের এ ঘটনায়। তিনি সরাসরি বললেন, ‘তারা এসব করে কেন? তারা কী জানে না, তারা কে? তারা তো এ দেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। তাদের এমন নির্লজ্জ ঘটনায় পুরো দেশই বিব্রত হয়। যখন ঘটনা ঘটায়, তখন তারা কী মনে রাখে না, এ দেশের মান-সম্মান, ইজ্জত অনেক কিছুই জড়িত তাদের সাথে!’

সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান বিস্মিত আরাফাত সানির গ্রেফতারের ঘটনায়। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনাগুলো যখন ঘটায়, তখন কী মাথায় থাকে না, তারা এ দেশের আইকন! তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের মান-সম্মান, সব কিছু!’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে কঠোর বাণীও উচ্চারণ করেছেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় বিসিবিও কখনও তাদের পাশে থাকবে না। বরং, দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।’ বিসিবির প্রধান নির্বাহী তো সরাসরিই বলে দিয়েছেন, সানির এ ঘটনায় বিসিবি বিব্রত। সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছেন, ক্রিকেটারদের একের পর এক ঘটনায় চিন্তিত বিসিবি।

আমিনুল ইসলাম বুলবুলের আরেকটি কথা দিয়েই ইতি টানতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘বিসিবি একাডেমির কাজ কী? সেখানে ক্রিকেটারদের কী শেখানো হয়? তারা কী সেখানে নৈতিকতার কোনো কিছুই শেখে না! বিসিবিরও উচিত, একাডেমিতে ক্রিকেটারদের নৈতিকতার বিষয়টি শেখানো। কারণ, ক্রিকেটারদের হাতে ব্যাট-বলই শোভা পায়, হাতকড়া নয়।’

লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।