এই মৃত্যুফাঁদ থেকে কি রেহাই নেই আমাদের?


প্রকাশিত: ০৪:২২ এএম, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

কিশোর বয়সে হুমায়ূন আহমেদের যে উপন্যাসটি আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে তার নাম ‘কৃষ্ণপক্ষ’। অরু আর মুহিবের সেই ট্র্যাজিডি।  গল্পটা মনে আছে তো? গল্পের নায়িকা অরুণা এবং নায়ক মুহিব। ভালোবেসে বিয়ের পরদিনই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় মুহিবের। মুহিবের গাড়িচালকের ভাবনাগুলো কি দুর্দান্তভাবে তুলে ধরেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেই যে ওভারটেকের সময়কার ভাবনাগুলো। চালকের একটু বেপরোয়া আচরণেই নেমে এলো মৃত্যু। আর মুহিবের মৃত্যু হয়ে রইল অরুর সারাজীবনের মর্মান্তিক দুঃখভার। সাম্প্রতিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহারানো ফারজাত ও গুরুতর আহত শামীমার মধ্যে আমি যেন দেখতে পেলাম মুহিব ও অরুকে। শুধু ওরা কেন? আমরা সকলেই কি এমন ট্র্যাজিডির শিকার হতে পারি না যেকোনো সময়?

আমাদের তো হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে চলাচল। সকালে বের হচ্ছি ঘর থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে। আমি জানি না ঘরে ঠিকমতো ফিরবো কিনা। জানি না আমার রিকশাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিবে কি না কোনো বাস ট্রাক বা অন্য কোনো দানব। জানি না রাতে কোনো মাতাল চালক আমার মোটর সাইকেলকে আঘাত করবে কিনা। জানি না আমি যে বাসের যাত্রী, সেই বাসের চালক মাতাল গতিতে অসাবধানে গাড়ি চালিয়ে আমার মৃত্যুদূতের ভূমিকা পালন করবে কি না। আমি জানি না যে প্রাইভেট কারটিতে বসে আছি সেটির চালক ধৈর্য্য হারিয়ে হঠাৎ রেললাইনে চলন্ত ট্রেনের সামনে উঠে পড়বে কিনা। আলমগীর কবির, টিনা খান, জাহানারা কাঞ্চন, বাপী শাহরিয়ার, নাফিয়া গাজী, সাইফুর রহমান, মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদ, আহীর আলম, জগলুল আহমেদ চৌধূরী, ইউসুফ পাশা, সাবিহা সিদ্দিকী কত নাম, কত মুখ, কত স্বজন, কত বন্ধু। মাতাল চালকের গাড়ির ধাক্কায় এখন সিংগাপুরের হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক জিয়াউল ইসলাম।  আরও কত নাম ভুলে যাওয়া সংবাদের শিরোনাম। কখনও দুই ইঞ্চি এক কলাম আবার কখনও প্রথম পাতার লিডনিউজ। সড়ক দুর্ঘটনা যেন আমাদের নিয়তি। বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে।

এইসব সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলো কী কী? মূল কারণ হলো চালকের অসাবধানতা। বাস, ট্রাক, অটোরিকশা, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল যেটাই হোক গাড়ি চালানোর সময় সাবধানতার কথা কেন যেন ভুলে যায় অধিকাংশ চালক। বেপরোয়া চালনার কারণেই ঘটে অধিকাংশ দুর্ঘটনা। এর পাশাপাশি খারাপ রাস্তা, বিপদজনক বাঁক তো রয়েছেই। আরও আছে যানবাহনের ফিটনেস ঘাটতি আর ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতি। লাইসেন্সবিহীন চালক ও অদক্ষ চালকও একটা বড় কারণ। সড়ক দুর্ঘটনাসংশ্লিষ্ট আইনগুলোও আমাদের দেশে অতি দুর্বল। ফলে মানুষ খুন করেও দিব্যি বেরিয়ে যায় যায় স্বল্প শাস্তি বা বিনা শাস্তিতে।

আরও একটা বিষয়। এই দেশে ভালো কাজে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা কঠিন হলেও গোষ্ঠি স্বার্থে খুব দ্রুত প্রতিবাদে মেতে ওঠে কিছু অসচেতন মানুষ। যদি ট্রাক চালক, বাস চালকের বেপরোয়া চালনা ও মানুষ খুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় সরকার তাহলে শুরু হয় পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট। যদি কোনো পেশাজীবী বেপরোয়া চালনায় কোনো মানুষের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয় তাহলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কারণ তাহলে ওই পেশাজীবীরা এক হয়ে একজন খুনির জীবন বাঁচাতে সোচ্চার হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক প্রভাবের বলয়ও কাজ করে খুনির সুরক্ষায়। পরিবহন শ্রমিকদের অন্যায় ধর্মঘটে পেছন থেকে সাহস জোগান কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি। কোনো নেতার মালিকাধীন পরিবহনের চালক ধরাকে সরা জ্ঞান করে অনায়াসে। কারণ সে জানে যতই দুর্ঘটনা ঘটাক না কেন তার বেঁচে যাওয়া সুনিশ্চিত। ফটো সাংবাদিক জিয়ার দুর্ঘটনাটিকে উদাহরণ হিসেবে নিলে দেখা যাবে একজন মাতাল চালকের কারণে আজ তার এই অবস্থা। সেই চালক হলেন অভিনেতা কল্যাণ কোড়াইয়া। তাকে প্রাপ্য শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্যও কতিপয় শিল্পী দাঁড়িয়ে গেছেন।

একটা বিষয় আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। বিশ্বের সেরা শিল্পী কিংবা সেরা গুণী মানুষটিও যদি কাউকে মাতাল হয়ে গাড়িচাপা দেয় কিংবা অন্য কোনো আইন ভাঙ্গে তাহলেও সেটা কিন্তু অপরাধই হয়। বিশ্বের সেরা অভিনেতাও যদি কোনো মানুষকে খুন করে তাহলেও সেটা খুনই থাকে। আইনকে নিজের গতিতে চলতে দেওয়া উচিত। সেটাই সভ্যতা। আমার নিজের ভাইও যদি অপরাধ করে তাহলে তাকে প্রাপ্য শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য আরেকজন মানুষের উপর জুলুম করতে আমি পারি না। নেতাই হোন আর অভিনেতাই হোন আইন ভাঙার অধিকার কারও নেই।

আরেকটা বিষয় মনে হচ্ছে, প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক জিয়ার পরিবর্তে যদি ওই গাড়ির চাপায় আহত বা নিহত হতেন কোনো শ্রমজীবী মানুষ কিংবা নাম না জানা কেউ, তাহলে আজ হয়তো কোনো হদিসই পাওয়া যেত না অপরাধীর। প্রতিদিন সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই মৃত্যুর কি কোনো বিচার হচ্ছে? অথচ আইনের চোখে সবারই সমান হওয়ার কথা। কোটিপতির পুত্রও যদি ভিক্ষাজীবীকে গাড়িচাপা দিয়ে মেরে ফেলে তাহলে আইনের চোখে সে অপরাধীই থাকে। আইন সকলের জন্য সমান হবে এটাই সভ্যতা। এটাই মানবিকতা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে সেলিব্রেটিদের বেলায় ছাড় দেওয়ার একটা অসুস্থ মানসিকতা দেখা যায়। এই মানসিকতার কারণেই কোনো সেলিব্রেটির বাড়ির গৃহকর্মী আত্মহত্যা করলে, খুন হলে বা নির্যাতিত হলে তার কোনো বিচার পেতে দেখা যায় না। আর ধনী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক প্রভাবশালী কেউ হলে তো এসব কোনো ব্যাপারই না। অথচ সকলেরই জীবনের দাম তো আইনের চোখে সমানই হওয়া উচিত।

দুর্ঘটনায় মৃত্যু কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে যত লোক মারা যায় আমাদের দেশে একটা লঞ্চ দুর্ঘটনা কিংবা বাস দুর্ঘটনাতেই তত লোকের মৃত্যু হয়। রেল ক্রসিংও মৃত্যুর একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কেন মানুষ অতটা অসাবধান হয় যে ট্রেন আসার জন্য সামান্য সময়টুকুও ধৈর্য্য রাখতে পারে না? রেললাইন ধরে হাঁটা, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপার ইত্যাদি অসাবধান কাজের কারণে চলে যায় অমূল্য জীবন।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণে শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়, মৃত্যু ঘটে পুরো পরিবারটির। যারা বেঁচে থাকে তারা আজন্ম বয়ে বেড়ায় অপরিসীম দুঃখভার। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে ধ্বংস হয়ে যায় পুরো পরিবার। আদরের শিশুটির মৃত্যুতে মানসিকভাবে শেষ হয়ে যায় বাবা-মা ও অন্য স্বজনরা।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু রোধ করতেই হবে। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি আইন প্রয়োগের বেলায় কঠোর হতে হবে সরকারকে। বাস ট্রাক প্রাইভেট কারের বেপরোয়া চালকদের বিরুদ্ধে আইন আরও কঠোর করতে হবে। এভাবে সম্ভাবনাময় জীবন একে একে ঝরে যাবে আর আমরা সবাই সড়কে প্রাণ হাতে নিয়ে চলতে থাকব এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে অবিলম্বে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।