পরশ্রীকাতর সাংবাদিকতা!


প্রকাশিত: ০২:১২ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

সাংবাদিকরা আসলেই হিংসুটে। কারো ভালো কিছু বা আনন্দ-উল্লাস তাদের সহ্য হয় না। কবে যে কোথায় শিখেছে, ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ, ব্যস সারাক্ষণ লেগে থেকে মানুষের পিছে। খালি গন্ধ শুকে। কে কোথায় গেল, কে আনন্দ করলো; হাতে কলম আছে, লিখে দিলো পত্রিকায়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সাংবাদিকদের ভয়ে মানুষ আর ঘর থেকেই বেরুতে পারবে না।

আচ্ছা বলুন তো, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ হেলিকপ্টারে চড়ে ঈশ্বরদী গেছেন, এটা নিউজ করার কী আছে? যারা এই নিউজ করেছেন, তারা নিশ্চয়ই এখনও ষাটের দশকের মানসিকতা আকড়ে পড়ে আছেন। ছাত্রনেতারা হবে গরিব, তারা হেঁটে হেঁটে রাজনীতি করবেন বা বঙ্গবন্ধুর মত ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণিতে চড়ে বা বিনা টিকিটে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেবে- এসবই ষাটের দশকের ধারণা। দেশ এগিয়েছে, কিন্তু সাংবাদিকতা এখনও ষাটের দশকে পড়ে আছে। এই যে বিশ্বে তাক লাগানো উন্নয়ন হচ্ছে বাংলাদেশে, তো এই উন্নয়ন কারা করছে? ছাত্রলীগের মাতৃ সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই তো হচ্ছে এই উন্নয়ন। তো উন্নয়নের সুফল সারা বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেই তো তারা কাজ করছেন। সাইফুর রহমান সোহাগও তো বাংলাদেশেরই মানুষ। তাই উন্নয়নের সুফল ভোগ করার অধিকার তো তারও আছে। আমাদের দেশের ছাত্রনেতারা হেলিকপ্টারে চড়ে সাংগঠনিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে যান- এটা আমাদের গর্বিত করে, বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। শুধু কিছু ব্যাকডেটেড সাংবাদিক, দেশের উন্নয়ন যাদের গায়ে জ্বালা ধরায়; তারাই এ নিয়ে লেখালেখি করে।

আগে বাংলাদেশে ছাত্র-ছাত্রীদের বাবারা ছাত্র সংগঠনের নেতা হতেন। অন্য সংগঠন যাই হোক, ছাত্রলীগে এখন আর সেই সুযোগ নেই। নিয়মিত ছাত্র এবং বয়স অনূর্ধ্ব ২৯ হলেই কেবল ছাত্রলীগের নেতা হবার যোগ্য হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা এখনও বাবার পাঠানো টাকায় মাস চালান। অন্তত নব্বই দশক পর্যন্ত আমরা তাই চালাতাম। খুব দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা টিউশনি করে মাসের খরচ জোগান। কেউ কেউ পার্টটাইম চাকরিও করেন। ছাত্রলীগ সভাপতি চাকরি করেন বলে শুনিনি, টিউশনি করার তো প্রশ্নই ওঠে না। আর চাকরি করলে তো তার সাংগঠনিক পদ থাকবে না। তাই ছাত্রলীগ সভাপতি একজন নিয়মিত ছাত্র এবং অবশ্যই বেকার। এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে তিনি হেলিকপ্টার চড়ে ঈশ্বরদী যান কী করে? এই প্রশ্ন যে আমার মনেও জাগেনি, তা নয়। তবে আমি বাস্তবতা বুঝি। টিউশনি, পার্টটাইম চাকরি- এসব আমাদের মত সাধারণদের জন্য প্রযোজ্য। ছাত্রলীগের সভাপতি সাধারণ কেউ নন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি তো অনেক বড় পদ। বাংলাদেশের যে কোনো কোনায় ছাত্রলীগের যে কোনো ইউনিটের পদধারীদেরও নাকি অনেক দাপট। ছাত্রলীগ নেতা- এটাই অনেক বড় অর্জন। ছাত্রলীগ নেতাদের নাকি চাকরি-বাকরি না করলেও চলে। কীভাবে চলে, আমি জানি না। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ব্যবসার অংশীদার- এমন অনেক অলিখিত আয়ের উৎসের কথা শুনি। কিছু বিশ্বাস করি, কিছু করি না। আর আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বা দুর্নীতি দমন কমিশনের সার্টিফিকেট পাওয়ার আগ পর্যন্ত তো আমি আপনি কাউকে চাঁদাবাজ বা টেন্ডারবাজ বলতে পারবো না। তবে আমি বলি, সাইফুর রহমান সোহাগ একটু বোকা। টাকা থাকলেই লোকজনকে তা দেখিয়ে বেড়াতে হবে কেন। এসব উন্নতি দেখে লোকজনের তো চোখ টাটায়। আমি এক এমপিকে চিনি, তিনি বছর বছর মোবাইলের মডেল পাল্টান। বাজারের সবচেয়ে দামি ও লেটেস্ট মডেলের একাধিক মোবাইল থাকে তার হাতে। কিন্তু যখন এলাকায় যান, পুরনো একটি ভাঙাচোরা নকিয়া ফোন নিয়ে যান। এলাকার মানুষকে দেখাতে চান, তার টাকা-পয়সার খুব টানাটানি। সোহাগ তার দলের সেই এমপির কাছ থেকে সেই কৌশলটা শিখে নিতে পারতেন, নেয়া উচিত ছিল। রাজনীতি অত সহজ কাজ নয়।

বলছিলাম সাংবাদিকদের ব্যাকডেটেড মানসিকতার কথা। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভার মেয়র ও উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলামের বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে সবাই খুব মজা করছিলেন। মেয়র বা নেতা হয়েছেন বলে কি তার সাধ-আহ্লাদ নেই। তারও ইচ্ছা হলো সেই উৎসবে অংশ নেয়ার। তিনি একটি পিস্তল আর একটি শটগান নিয়ে উৎসবে যোগ দেন। একপর্যায়ে ‘দিলাম’ বলে শটগান থেকে আকাশের দিকে গুলি ছোড়েন। এমনিতে সাধারণ কারো বিয়েতে পটকা ফুটিয়ে উল্লাস করা হয়। কিন্তু মেয়রের ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। সেটা আর সবার মত সাধারণ হলে কি আর মান থাকে? অপরের আনন্দে যাদের গায়ে জ্বালা ধরে সেই সাংবাদিকরা মেয়রের কাছে শটগানের গুলি ছোড়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে মেয়র বলেছেন, ‘এটা তো বাইরের কোথাও না, আমার বাড়ির প্রাচীরের ভেতর। তাছাড়া এটা লাইসেন্স করা অস্ত্র। আমি দু-দুবারের মেয়র। আবার আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। আমি কি বেআইনি কিছু করতে পারি?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মেয়রের ভাইয়ের ছেলে সাদমান আল সাকিব, যিনি বিয়ের উৎসবটি ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। সেখানে একজন আমজনতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এটা কোন আইনের মধ্যে পড়ে?’ মেয়রের ভাতিজা উত্তর দিয়েছেন, ‘এখানে আমরাই আইন।’ মেয়রের ভাতিজা বাঘের বাচ্চা। আসল কথাটি বলে দিয়েছেন। ভেড়ামারার দুবারের মেয়র, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকই তো সেখানে আইন। এ নিয়ে এত কথা বলার কী আছে? বরং মেয়র যে দয়া করে আকাশের দিকে তাক করে গুলি ছুড়েছেন, এ জন্য কি তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত নয়?

সাংবাদিক ভাইয়েরা গোটা দেশটাই তো এখন আওয়ামী লীগের আর ছাত্রলীগের। সেখানে আওয়ামী লীগের মেয়র কোথায় তার ভাতিজির মেয়ের বিয়েতে শটগান দিয়ে গুলি করেছে, ছাত্রলীগ সভাপতি কোথায় হেলিকপ্টারে চড়ে গিয়েছেন; এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছেপে পত্রিকার স্পেস নষ্ট করা বন্ধ করুন। এ দুটি সংবাদের কারণে নিশ্চয়ই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দুটি নিউজ বাদ পড়েছে। পরশ্রীকাতর সাংবাদিকতা ছেড়ে; যুগোপযোগী, আধুনিক, ডিজিটাল, উন্নয়ন সাংবাদিকতা করুন।

১৫ জানুয়ারি, ২০১৭

inner

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।