ভয়ংকর অভিমান


প্রকাশিত: ০৪:০৮ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

রাজধানীর দারুস সালামে মর্মান্তিক ঘটনাটির খবর হয়তো অচিরেই ভুলে যাব আমরা। যেমন ভুলে গেছি এর আগের অনেক মর্মান্তিক ঘটনা। দারুস সালামে নিম্নবিত্ত পরিবারের এক তরুণী মা তার দুই শিশুসন্তানকে হত্যা করার পর আত্মহত্যা করেন। খবরটি চোখে না পড়ার উপায় ছিল না। কারণ সবগুলো মিডিয়া বেশ গুরুত্ব দিয়েছে খবরটিকে। এর আগে বনশ্রীতে আরেক ঘটনায় এক মা হত্যা করেছিলেন তার দুই সন্তানকে। এরও অনেক বছর আগে মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মা স্বামীর ওপর অভিমান করে তার দুই শিশুকে বিষ খাইয়ে নিজেও বিষ খান। তিনজনেরই মৃত্যু ঘটে। ওই ঘটনাটি এক সাংবাদিকের পরিবারের ঘটনা বলে সেটির কথা মনে আছে আজও। এমন আরও অনেক ঘটনার উল্লেখ করা যায় যেখানে মা তার শিশুসন্তানসহ আত্মহত্যা করেছেন। আবার শুধু মা নন। অনেক ক্ষেত্রে বাবাও এমন করুণ ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করা বাবার সংখ্যাও কম নয়। গত কয়েক বছরের পত্রিকার পাতা উল্টালেই এমন নজির অনেক চোখে পড়বে। প্রায় সবগুলো ঘটনাই ঘটেছে পারিবারিক কলহ অথবা মানসিক অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে।

পারিবারিক অশান্তি, কলহ, সহিংসতা, শারীরিক, মানসিক নির্যাতন এসব কিছুই এমন সমস্যা, যা আইসবার্গের মতো। আইসবার্গ যখন সাগরে ভেসে থাকে তখন তার অল্প একটু অংশ পানির উপরে ভাসমান দেখা যায়। দশ ভাগের নয় ভাগ অংশই থাকে দৃষ্টির আড়ালে। কিন্তু যখন তা ধাক্কা দেয় তখন টাইটানিকের মতো জাহাজও ডুবে যায় তার আঘাতে। পারিবারিক এই সমস্যাগুলোও ডুবে থাকে চোখের জলের সাগরে। পাড়া প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের চোখে পড়ে ক্ষুদ্র একটি অংশ। কিন্তু একসময় তা সংসারে নিয়ে আসে মর্মান্তিক মৃত্যু। এজন্য সময় থাকতেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

পারিবারিক কলহ বা সমস্যাগুলোতে দেখা যায় দীর্ঘদিন ধরে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বা ছোট ছোট অনেক বিষয়ে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা পুরুষশাসিত বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর ওপরই চাপটা বেশি থাকে। মানসিক ক্ষোভ বা মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীই বেশি হন। তবে পুরুষের মনেও দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমা হতে পারে এবং পুরুষও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। যেই এই পরিস্থিতিতে পড়ুন না কেন দরকার এর দ্রুত ও কার্যকর সমাধান। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস এবং পাড়া-মহল্লার কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে মানসিক সমস্যা বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য কাউন্সিলার থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশের প্রচুর মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা কমবেশি আকারে রয়েছে বা ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা চিন্তাই করি না। অথচ মানসিক অসুস্থতা কোনো অংশে শারীরিক অসুস্থতার চেয়ে কম ভয়ংকর নয়। এজন্য নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য চেকআপের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন কমিউনিটি হাসপাতালগুলোতে। আরেকটি বিষয় সমাজের বুঝতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা পারিবারিক কলহ, সম্পর্কের মধ্যে অসন্তোষ, ক্ষোভ ইত্যাদির চেয়ে অনেক ভালো বিবাহবিচ্ছেদ। দুজন মানুষের মধ্যে বনিবনা না হতেই পারে। হতে পারে একপক্ষ অন্য পক্ষের নির্যাতনের শিকার। এসব ক্ষেত্রে ডিভোর্স জরুরি।

আমাদের সমাজে ডিভোর্স সম্পর্কে ভয়ানক আপত্তি রয়েছে। অনেক ঝগড়াঝাটির পরও পরিবারের মুরুব্বিরা ডিভোর্সের পরিবর্তে দম্পতিদের কোনোভাবে মিটমাট করিয়ে দিয়ে বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে চান। কিন্তু এভাবে ঝালাই দেয়া বিয়ে বেশিদিন টেকে না। একটা সময় ঠিকই ঝালাইয়ের জায়গায় আবারও ছিদ্র দেখা যায় এবং এবার আরও বড় আকারে। এসব জোড়াতালি দিয়ে বিয়ে কোনোরকমে টিকে থাকার ফলে ভিতরে ভিতরে কিন্তু ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমা হতেই থাকে। একপর্যায়ে তার বিস্ফোরণ ঘটে। কখনও কখনও সেটা ঘটে মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়েই। এইভাবে বিয়ে টিকিয়ে রাখার চেয়ে বরং যদি সম্মানজনকভাবে মুরুব্বিদের মধ্যস্থতাতেই ডিভোর্স হয়ে যায় তাহলে দুজনই সুস্থভাবে বাঁচার অবকাশ পায়। সন্তানরাও রেহাই পায় নিত্য অশান্তির হাত থেকে। একটা ফোঁড়া অপারেশন করে ফেললে ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেলেও ক্ষতস্থান ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় ঠিকই। আর যদি নিত্য সেখানে পুঁজ, যন্ত্রণা চলে তাহলে একসময় সেটা প্রাণঘাতী ক্যান্সারেও রূপ নিতে পারে।

আরেকটি বিষয়। আমরা মনে করি অভিমান হলো ভালোবাসার অবিচ্ছেদ্য অংশ। অল্পস্বল্প অভিমান হয়তো প্রেম বা দাম্পত্যকে প্রাণবন্ত করে তোলে। কিন্তু আত্মধ্বংসী ভয়ংকর অভিমান কখনও কাম্য হতে পারে না। আত্মধ্বংসী অভিমান এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। অভিমানের কারণে অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন। অনেক সম্ভাবনাময় জীবন ঝরে গেছে অকালে। আমাদের সমাজে নারীরাই বেশি অভিমানী হয়ে থাকে। আবার অনেক পুরুষও অভিমানে কম যায় না। নারী-পুরুষ যেই হোক অভিমান করে নিজের জীবন ধ্বংস করা এক অনর্থক বোকামি। আর শুধু তো নিজের জীবন নয় দারুস সালামের মতো ঘটনায় তো দেখা যাচ্ছে অভিমানের কারণে সন্তানকেও হত্যা করা হচ্ছে।  শৈশব বা টিনএজ থেকেই অনেকের মধ্যে এমন জেদ, রাগ অভিমানের বাড়াবাড়ি দেখা যায়। শিশু কিশোরদের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা গেলে অভিভাবক ও শিক্ষকদের উচিত অবিলম্বে তার জন্য মানসিক কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা।

অভিমান করে দুই কিশোর বয়সী ভাইবোনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা এখনও স্মৃতিতে রয়েছে। সহকর্মীর দুই সন্তানের সেই ভয়ংকর মৃত্যুর ঘটনাটির কথা ভাবলে আজও আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার কেবলই মনে হয় যদি তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এমন অকালে দুটি তাজা প্রাণ আত্মহত্যায় ঝরে যেত না। এসব অভিমানে আত্মহত্যা ও সন্তান হত্যার ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে না দেখে বরং এসব প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষায় দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।