ও তে ওড়না, হ তে হিজাব আসছে না তো!


প্রকাশিত: ০৬:১১ এএম, ০৭ জানুয়ারি ২০১৭

একবার নিজেই ভেবেছিলাম বোরকা পরবো ক’দিন। একেবারে পা থেকে মাথা অবধি সব ঢাকা। সঙ্গে হাত মোজা, পা মোজা। শুধু চোখ দুটো খোলা, ঢাকা বাকি সব। নারীরা যেমন পরে। পরে চলাফেরা করে। আমিও ঠিক তেমনি; চেয়েছিলাম বোরকা পরে অফিসে যাব, শপিংয়ে যাব, ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নেয়া, বন্ধুদের আড্ডা, প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরব তাও ঐ বোরকা পরেই। লোকে বিস্মিত হবে? বলব, মেয়েদের জন্য যদি বোরকা ভাল হয়, পুরুষের জন্য তা নয় কেন? ছদ্মবেশি বলবে? তবে মেয়েদের কেন ছদ্মবেশি বলে না লোকে? নিজেকে অমনভাবে আড়াল করার, লুকোবার কী আছে?

নোরা ভিনসেন্ট, পশ্চিমা সাংবাদিক। নারী, পুরুষের ছদ্মবেশে ছিলেন প্রায় ১৪ মাস। এ ১৪ মাস নোরা পুরুষের সঙ্গে দিব্বি ঘুরেছেন, আড্ডা দিয়েছেন। ক্লাব, বার, রেস্তোরাঁ, শপিংমল, ন্যুড ক্লাব, জিম, রেলস্টেশন, পুলিশ স্টেশন- কোন জায়গা বাকি রাখেননি। পুরুষের সঙ্গ লাভ করেছেন, পুরুষ হিসেবেই। সেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘সেলফ মেইড ম্যান’। দুর্দান্ত বই। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। নোরা দেখতে চেয়েছেন পুরুষতন্ত্রের ভেতর বাহির। আমি নিজেও তাই। বোরকা পরা নারী হিসেবে দেখতে চেয়েছি পুরুষতন্ত্র আর ধর্মীয় মৌলবাদের একেবারে ভেতরঘর। আমরা দুজনই লেখক-সাংবাদিক। পার্থক্য শুধু একজন পুরুষ, অন্যজন নারী। কিন্তু ইচ্ছে আদর্শের ঐক্যে আমরা একই।

আমি বোরকা পরতে চাওয়ার অবশ্যই আরও একটি কারণ রয়েছে। আমি বাঙালি। বাঙালি মুসলমান। সৌদি আরবের নই। আমার ভূগোল, আবহাওয়ার সঙ্গে বোরকা কতটা যায়? পরে কেমন লাগে, কতটুকু স্বস্তি, অস্বস্তি সেটাও বুঝতে চেয়েছি। হাত মোজা, পা মোজা পরতে চাওয়ার কারণও একই।

অনেকেই বলেন, মেয়েরা যদি স্বেচ্ছায় হিজাব, বোরকা পরে তাহলে অসুবিধে কোথায়? অসুবিধে আমিও দেখি না কোথাও। কিন্তু মেয়েরা কি আসলেই ‘সেচ্ছায়’ হিজাব, বোরকা পরে, পরতে চায়? না কি ধর্মীয় মৌলবাদ, পুরুষতন্ত্র তার গায়ে হিজাব বোরকা চাপায়। চায় শিকল পরাতে, শৃঙ্খলিত করতে। সেচ্ছায় শিকল পরে কে? কে চায় বন্দি জীবন? নিজেকে লুকিয়ে রাখতে কার ভাল লাগে? হাওয়াজলে না উড়ে, না ভিজে, না ভেসে কে চায় নিজেকে অদৃশ্য করতে?

যে কথা বলে মেয়েদের হিজাব বোরকায় আড়াল করা হয়, তা বড় যুক্তিহীন। অবোরকা নারী দেখলে পুরুষের কাম ইচ্ছা জাগ্রত হবে, পুরুষ যৌন উত্তেজনা বোধ করবে, নারী হবে যৌন আক্রামণের শিকার। ফলে নারীর নিজেকে নিরাপদ রাখতে সর্বাঙ্গ ঢেকে থাকা মঙ্গলজনক। পুরুষ যদি নারীকে দেখা মাত্র, যেখানে সেখানে, যখন তখন উত্তেজিত হয়ে পড়ে, এতে সমস্যা তো নারীর নয়, পুরুষের। পুরুষ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোক। বলুক, আমার যেখানে সেখানে যখন তখন ‘হয়ে যায়’। তার মানসিক ও শারীরিক চিকিৎসা প্রয়োজন। তা না করে নারীকে আপাদমস্তক ঢেকে, মুড়িয়ে, আড়ালে রাখলে লাভ কী? পুরুষের দুশ্চরিত্রতার সমস্যা তো তার একান্ত নিজস্ব, ব্যক্তিগত। এর সঙ্গে আসলে বোরকা, অবোরকার সম্পর্ক নেই কোনও।

অনেকেই হয়তো ভুল ব্যাখ্যা করবেন আমাকে। বলবেন, আমি ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করছি। পর্দার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি। তা কিন্তু নয় মোটেও। আমি পর্দার পক্ষে, অশালীনতার বিপক্ষে। তবে তা নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই। বেআবব্রু হতে, অশালীন পোশাক পরতে ধর্ম নারী পুরুষ কাউকে বলেনি। শুধু ইসলাম কেন, কোন ধর্মই অনুমোদন করেনি, অশালীনতা, অশ্লীলতা। মনে রাখতে হবে, হিজাব বোরকা ইসলামেরও নয়, মৌলিকভাবে তা সিমেটিকদের। অর্থাৎ গোড়া ইহুদিবাদিদের কাছ থেকেই এসেছে সেটা, যা পরে যুক্ত হয়েছে আরবীয় সংস্কৃতির সঙ্গে। পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে আমরা ভুলে যাই পুরুষের কথা, কেবল শিকলে, শৃঙ্খলে চাই আটকাতে, কেবল নারীকে।

গত ক’দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড়, রীতিমত ঝড় উঠেছে। ছিঃ ছিঃ করছে সবাই এনসিটিবিকে। প্রথম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের পাঠ্য ১২ তে ‘ও’ অক্ষরটি চেনাতে, মেয়ে শিশুর ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে‘ওড়না চাই’। অনেকে বিস্মিত হলেও আমি মোটেও বিস্মিত নই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে মিছে দোষ দিয়ে লাভ কী? পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তো আর মঙ্গলগ্রহ থেকে আসেনি। তারা তো এ সমাজেরই। সমাজ যেমন, সামাজিক শিক্ষা যেমন, এনসিটিবিও তেমনি। সমাজে মেয়েদের যেভাবে দেখা হয়, মেয়েরা নিজেরাও যেভাবে দেখে নিজেদের এনসিটিবি তার বাইরে যায়নি। বরং আমি বলব, এনসিটিবি অসামাজিক কিছু করেনি। সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি তারা যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীলই থেকেছে। এখনও সমাজে পুরুষ মালিক, মেয়েরা তার অধীনস্ত কর্মচারীর মত। ঘরে যৌনদাসী, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। এখনও এসিড সন্ত্রাস, যৌন হয়রানি, স্ত্রীকেহত্যা, আগুনে  পোড়ানো, নারী পাচার, পতিতাবৃত্তি- খুব আরামসে চলছে সমাজে। মেয়েদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কী আমূল বদলেছে?  তা মনে হয় না আমার। এখানে একা মেয়ে মানে মন্দ মেয়ে, রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরা মেয়ে নষ্ট, স্বামী মরলে সে অপয়া, কালো মেয়েদের এখনও অপেক্ষা করতে হয় যেকোনও বর পেতে।

পুরুষতন্ত্রের শিক্ষাইতো পাচ্ছে একজন শিশু, তার চারপাশ থেকে। তার ঘরে পুরুষতান্ত্রিকতা, বাইরে পুরুষতান্ত্রিকতা। পুরুষতান্ত্রিকতা সবসময়ই  ধর্ম নয়, ধর্মীয় বন্ধুত্ব করে মৌলবাদের সঙ্গে, যাতে নারীকে অধীনস্ত রাখতে পারে সে। গত একদশকে কি পরিমাণ মহিলা মাদ্রাসা বেড়েছে সে খবর রেখেছে কেউ? সেখানে কি পড়ানো হয়, শেখানো হয়- কেউ নিয়েছি সে খোঁজ? একসময় ধারণা করা হতো দরিদ্র লোকের সন্তান পড়ে মাদ্রাসায়। চিত্রটি বদলে গেছে। এখন মহিলা মাদ্রাসার সামনে সারি সারি গাড়ির লাইন। সেখানে ছোট্ট মেয়ে শিশু, তাদের গায়েও বোরকা। শিশুদের পরনেও হাত মোজা, পা মোজা। হঠাৎ করে ছবি তুললে কেউ আলাদা করতে পারবে না, এটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান না আফগানিস্তান।

শহরের সব শপিংমল ছেয়ে গেছে বেবি বোরকার দোকানে। শিশুদের গায়ে হিজাব, বোরকা জোববা- প্রতিবাদের কেউও নেই। নেই দেখার কেউও । কোন ধর্মও বলেনি, শিশুদের এমন পোশাক পরতে, পরাতে। ইসলাম তো নয়ই। এনসিটিবি ‘ও’ তে ওড়না চাই শেখাছে, মন্দ কী! হয়তো আগামীতে ‘হ’ তে শিশুদের হিজাব পরতে শেখাবে!  

লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
[email protected]

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।