২০১৭ হোক জঙ্গিমুক্ত


প্রকাশিত: ০৪:০৯ এএম, ০১ জানুয়ারি ২০১৭

আরব্য রজনীর গল্পে পড়েছিলাম এক জেলে সমুদ্রে জাল ফেলে তুলে আনে একটি পুরনো বোতল। মুখ খুলে দিতেই বোতল থেকে বেরিয়ে আসে বিশাল এক দৈত্য। সে দৈত্য হত্যা করতে চায় তার উদ্ধারকর্তাকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনেক কৌশলে তাকে আবার বোতল-বন্দী করা সম্ভব হয়। ২০১৬ সালে এমনি যে দৈত্যের চেহারা চমকে উঠে আমরা দেখেছি তার নাম জঙ্গিবাদ।

গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গিহামলায় আমরা শোকে স্তব্ধ হয়ে দেখলাম আমাদেরই অনেকের ঘরের ভিতর, মনের ভিতর, কোথায় যেন বাসা বেঁধে আছে সেই পুরনো দৈত্য। জঙ্গিবাদের ছোবলে ঘরের কিশোর তরুণ ছেলেরা এমনই পিশাচে পরিণত হয়েছে যে অন্তঃস্বত্ত্বা নারীদেরও নির্মমভাবে কুপিয়ে মারতে, জবাই করতে তাদের মোটেই বাঁধছে না। হলি আর্টিজানের ট্র্যাজিডির পর অনেক বাবা মায়ের নজরে পড়ে কিভাবে তাদের আদরের সন্তান অন্য কোন জাদুগরের ইশারায় ঘর ছাড়ছে, ভয়াবহ সর্বনাশ বয়ে আনছে দেশের ও পরিবারের জন্য। এর পর ধীরে ধীরে পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে নানা ভয়াবহ তথ্য। কত মেধাবী তরুণ ঘর ছেড়ে জঙ্গি আস্তানায় চলে গেছে এবং কারা নিখোঁজ রয়েছে সেসব তথ্যও চমকে যাবার মতো।

জঙ্গিবাদে নারীর সম্পৃক্তির বিষয়টিও ছিল গত বছরের ভয়ানক এক তথ্য। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, স্বামী বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের প্রভাবে ও প্ররোচনায় ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে নারীরা। এইসব সংবাদে সৎসঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ  প্রবাদের সত্যতা আরও একবার প্রমাণিত হলো। জঙ্গিরা শুধু নিজেরাই সর্বনাশের পথে যাচ্ছে না, সেই সঙ্গে স্ত্রী ও সন্তানদেরও নিয়ে যাচ্ছে এই পথে। তাদের আত্মঘাতী হওয়ার প্ররোচনা দিচ্ছে।  এই জঙ্গিবাদের ভয়াবহ রূপ দেখে গেছে আরও কয়েকটি জঙ্গিদমন অভিযানেও।

বছর শেষে আমরা দেখলাম নিজের শরীরে বিস্ফোরণ বেঁধে নিজেকে শেষ করছে এক নারী জঙ্গি। সঙ্গে তার শিশুকন্যা। কি ভয়ংকর। মা সবসময় সন্তানকে আগলে রাখে। অথচ এখানে দেখলাম নিজের সন্তানকে বোমায় উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে মা। কি সর্বনাশা নেশা এই জঙ্গিবাদ। এই নেশায় পড়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে সুখি পরিবার। জঙ্গিবাদ দমনে সরকার বেশ কঠোর হয়েছে। এটা ভালো। কিন্তু সেই সঙ্গে দরকার জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন। ধর্মের অপব্যাখ্যায় আর পরকালে স্বর্গ পাবার আশায় পার্থিব জীবনের সুখশান্তি নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন জঙ্গিবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। পাড়ায়, মহল্লায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমেই জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

২০১৬ সালে নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলাও ছিল চরম দুঃখজনক ঘটনা। এটাও আরেক বোতলের দৈত্য। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামের এই দৈত্য ‘জঙ্গিবাদ’ নামের দৈত্যটির ভাই। সাম্প্রদায়িকতার এই দৈত্যও মানুষের মনের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তারপর সামান্য গুজবে তা বেরিয়ে আসে এবং তাণ্ডব চালায়। দীর্ঘ অনেক বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের ওয়াজের ক্যাসেট গ্রামে গঞ্জে অবাধে বেজেছে। ইসলামি ওয়াজ আর জলসার নামে নারীবিরোধী, মানবতাবিরোধী শিক্ষা প্রচার হয়েছে কৌশলে। প্রচার করা হয়েছে ভিন্ন ধর্মের কুৎসা এবং বিদ্বেষ। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ। ধর্মান্ধতার কথা ও অপব্যাখ্যা শুনে শুনে সাধারণ অশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত মানুষ মনে করেছে এটাই বুঝি ধর্ম। তাই ফেসবুকে সাধারণ একটি পোস্ট ও ফটোশপের কারসাজির গুজবেই ক্ষিপ্ত হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে ধর্মান্ধ জনতা। ভেঙেছে মন্দির ও প্রতিমা।

গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উপর হামলা ও তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, তাদের উচ্ছেদ সবকিছুই ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক।  সমতলে ও পাহাড়ে যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষ বসবাস করে তাদের অধিকার এদেশের কোনো নাগরিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাদের সরলতার ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি দখল করে নেওয়ার অর্থ হলো জোর যার মুল্লুক তার রীতি কায়েম করা। গৃহহীন এই দরিদ্র মানুষগুলো এখনও চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিন পার করছে। বড়দিনের উৎসবেও সাঁওতাল পল্লী আনন্দমুখর হতে পারেনি। নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জের মতো ঘটনা দেশের ভাবমূর্তিকে আঘাত করেছে ভীষণভাবে। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বর আক্রমণও ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় ঘটনা। যদিও তা ঘটেছে প্রতিবেশী দেশে কিন্তু বাংলাদেশেই তো আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। ফলে শরণার্থীদের চাপ পড়েছে বাংলাদেশের উপর।

সাম্প্রদায়িকতা  আর জঙ্গিদের অশুভ তৎপরতার ভিতর দিয়ে পার হয়ে গেল একটি বছর। ২০১৭ সাল শুরু হলো। এ বছর বাংলাদেশকে যেন সম্পূর্ণভাবে জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত করা যায় সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সেইসঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও জনমত গড়ে তুলতে হবে। এ দায়িত্ব সরকারের একার নয়। আমরা যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে মনে করি তাদের উপরেও এর দায়দায়িত্ব বর্তায়। একসময় গ্রামে গ্রামে পাঠাগার, গণনাট্য, সাংস্কৃতিক উৎসবের জোয়ার ছিল। সেই মরা নদীতে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে। যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম আমরা, সেই চেতনাকে আবার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। লোকজ সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে। এ কাজ সংস্কৃতিকর্মীদের। লেখক, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, শিল্পী এবং শিক্ষকদের। শিল্প, সাহিত্য, গান, নাটক, ছবি আঁকার চর্চা যদি গ্রামে গ্রামান্তরে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে আর জঙ্গিবাদ মানুষের মনকে দখল করতে পারবে না। ২০১৭ সালে এ কাজটিই আমাদের প্রত্যেকের কাজ হওয়া দরকার। নববর্ষ শুভ হোক, কল্যাণময় হোক। জয় অসাম্প্রদায়িক জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

[email protected]

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।