নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা হোক সহিংসতাকে না বলা


প্রকাশিত: ০৬:২৯ এএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

New year’s resolution বলে একটা কথার প্রচলন আছে পশ্চিমা দেশগুলোয়। ইদানীং এই শব্দ জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্রাচ্যেও, এমনকি আমাদের মতো দেশের নাগরিক জীবনেও। নতুন বছরে নানা কিছুর প্রতিজ্ঞা করা। বাংলাদেশের জন্য নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা কি হবে কেউ তা জানে না। আগামীকাল রোববার থেকে যে বছর শুরু হচ্ছে তার জন্য নতুন কিছু প্রতিজ্ঞাতো লাগবে। কিন্তু তার আগে ফিরে যেতে হয় পেছনে। বিগত বছর কেমন গেল, দেশ কী পেল, কী হারাল? হিসাব নিকেষ করলে প্রথমেই চোখের সামনে ওঠে আসে গুলশান হামলার প্রসঙ্গ।

অতিথি প্রিয় জাতিকে বিশ্বের সামনে হেয় করে একদল জঙ্গি জুলাই মাসের প্রথম দিন, রমজান মাসের সন্ধ্যায়, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে বিদেশি নাগরিকসহ বাংলাদেশের বেশ ক’জন নারী ও পুরুষকে। আইএস জঙ্গিদের মতো পোশাক পরে ইন্টারনেটে ছবি দিয়ে, রাতভার এমনসব কাজ করেছে যা নিষ্ঠুরতার সবধরনের ধারণাকে মুছে দিয়েছে বাঙালির মন থেকে। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলার চেষ্টা, শান্তিপ্রিয় বাঙালিকে ধারণা দিতে শুরু করেছিল যে, হয়তো ইরাক বা সিরিয়া পরিস্থিতি আমাদের সামনে। অবশ্য এর আগেই দু’দুজন নিরপরাধ বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে ঢাকা ও রংপুরে।

ধন্যবাদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যে, তারা পরিস্থিতি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি গুণগতভাবে সামলেছেন। তবুও এদেশের ইতিহাসে হলি আর্টিজান হামলা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
 
এই সহিংসতা বেশ কয়েক বছরের রাজনৈতিক সহিংসতারই ধারাবাহিকতা। পেট্রল বোমায় পুড়িয়ে মানুষ মারা, নির্বাচনী বিরোধিতার নামে স্কুল পুড়িয়ে দেয়া, রেললাইন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করে দেয়া, হেফাজত নামের এক দানবের পক্ষে রাজনীতির প্রতিটি পদক্ষেপ শুধু রাষ্ট্রবিরোধী ছিল না, ছিল বাংলাদেশকে অন্ধকারের শক্তির স্বর্গ বানানোর প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন অনেকদিনের। কিন্তু রাজনীতি কখনোই এমন সহিংসাশ্রয়ী ছিল না যতটা দেখতে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকে। যে বাঙালি পাকিস্তানের মতো নিষ্ঠুরতম অন্ধকারের শক্তিকে পরাজিত করেছিল ১৯৭১-এ সেই দেশে কেন এত সহিংসতা? কেন আবারো এমন পাকিস্তানি ধরনের রাজনৈতিক উন্মত্ততা?

আমরা দেখলাম সরকার বিরোধী লড়াই ক্রমেই পরিণত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ উদারনীতি বিরোধী লড়াইয়ে। একের পর এক লেখক, প্রকাশক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামনের কাতারের মানুষ হত্যা, গীর্জা, প্যাগোডা ও মন্দিরে হামলা, সিয়া, সুন্নি, আহমদিয়া নামক গোষ্ঠিগত সংঘাত লাগানোর প্রচেষ্টা এবং বিদেশী সবকিছুর নীট ফলাফল ছিল হলি আর্টিজান হামলা। সহিংসতার মাধ্যমেই রাজনৈতিক সাফল্যে পৌঁছানোর লক্ষ্য। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিস্তারের এই সহিংসতাই আসলে ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অবশ্যই হবে বহুত্ববাদী। কিন্তু নিশ্চয়ই একাত্তর ভুলে গিয়ে নয়। জীবনের প্রতিটি স্তরে আত্মস্বার্থরক্ষা বাঙালির কাছে বড় এবং সেই বিচারে আমাদের সবচেয়ে বড় স্বার্থ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমাদের আত্মপরিচয়ের আধিপত্য কায়েম করতে চাইলে বারবার ফিরে যেতে হবে একাত্তরে যার মূল দর্শন ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ ফিরে পাবার স্বপ্নে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করলে দেশকে যদি এমন মূল্য দিতে হয় তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশ এখন আরেক মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে। এবং সে কারণেই দেশের বিরুদ্ধে এমন হিংসাশ্রয়ী লড়াই একটি গোষ্ঠির। সাম্প্রদায়িক সহিংস রাজনৈতিক গোষ্ঠি যে জাল বিস্তার করেছে তার জের চলবে বহুদিন। বাংলাদেশে শাসক দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন মুখর থাকে সবসময়। এটাই রীতি। অতীতে দেখেছি সে আন্দোলনে হিংসা ছিল, ছিল পুলিশের দমননীতিও। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে পর দেখা গেল এক ধরনের জঙ্গি আন্দোলন। এবং তা দু’একবার নয়, বারবার। এরা নিরীহ দেশি বিদেশি মানুষকে মারছে, আবার সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করছে। দুঃখজনক বিষয় হলো এরা সরকারি দলেও অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে নানা কাণ্ড করছে।
 
ধারাবাহিক এই জঙ্গি আন্দোলন দেশের পরিস্থিতিকে জটিল করে তুললেও দেশের মানুষের উন্নয়নের স্বপ্নকে দমাতে পারেনি। ভরসার জায়গা এখানেই। কোন বিশেষ রাজনৈতিক সম্প্রদায় সহিংসতাকে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুললেও, মানুষকে পুড়িয়ে মারলেও মানুষ নিজেরা এগিয়েছে দৃঢ়তার সাথে। ফলে নিম্ন মধ্যম আয়ের স্বীকৃতি এসেছে, মাথাপিছু আয় ও গড় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।
 
হোলি আর্টিজান হামলাকারীরা যতই আইএস উর্দি গায়ে চাপিয়ে ছবি দিকনা কেন, তারা সিরিয়া বা ইরাক থেকে নিয়ন্ত্রিত ছিল না। এদের আসল ভিত্তিটা দেশের ভেতরে। এখানকার রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন আর শক্তিতেই তারা বলীয়ান হয়েছে। সাথে আঞ্চলিক সন্ত্রাসী শক্তি হিসেবে পাকিস্তানি আইএসআই-এর কাছ থেকে অর্থ ও ট্রেনিং পেয়েছে। কারণ পাকিস্তান বারবার বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করে বাংলাদেশ বিরোধী শক্তিকে উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করেছে। সরকার এ কারণেই বলছে- এরা আইএস নয়, হোম গ্রোন টেররিস্ট। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একের পর এক অভিযানে সফলভাবে খতম করে চলেছে জঙ্গিদের। তারপরও ২০১৬ এর শেষ প্রান্তে এসে নারী ও শিশুদের ভেতর জঙ্গিবাদের বিস্তার দেখে শঙ্কা জাগে। বুঝতে পারি অন্ধকারের এই শক্তি  ২০১৭ সালেও শান্তিতে থাকতে দিবেনা উন্নয়ন প্রয়াসী জাতিকে।  

তাই সময় এখন প্রতিজ্ঞার। দলমত নির্বিশেষে সবার উচিত মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সাম্পদায়িকতা বিরোধী আওয়াজ তোলা। একমাত্র মৌলবাদ থেকে মানুষকে দূরে রাখতে পারাটাই নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা। তবেই আমরা পারবো সহিংসতার সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।