আত্মীয় সে তো আত্মার, আসলে কি তাই?

প্রীতি ওয়ারেছা প্রীতি ওয়ারেছা
প্রকাশিত: ০৪:০৪ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

কয়েকদিনের হাসপাতালজনিত অভিজ্ঞতা কপালে জুটলে প্রচুর আত্মীয়ের মুখ দেখার সৌভাগ্য ঘটে। দীর্ঘদিনের অদেখা ও পরিচর্যাহীন আত্মীয়তার সম্পর্ক নতুন করে ঝালাই হয়। আত্মীয়তার মাঝে মায়ার বন্ধন, আত্মীয়তার মাঝে হিংসা ও বিদ্বেষের দহন খুব সহজেই টের পাওয়া যায়। বিষয়টা একপ্রকার শাপে বর। শুধু আত্মীয়-স্বজনদের কারণেই কোন কোন সময় চারপাশটাকে আপনার কাছে মনে হতে পারে সাপে ভরপুর। বিচিত্র এই সম্পর্ক! অভিঙ্গতালব্ধ আমরা কম বেশি সবাই। ২৩-২৭ ডিসেম্বর এই কয়দিনে আমি প্রচুর আত্মীয়ের মুখ দেখেছি; নিজের এবং হাসপাতালে আসা অন্য রোগীদের।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন। হাসপাতালের এনজিওগ্রাম বিভাগের বাইরে রোগীর সঙ্গে আসা অপেক্ষমানদের ভীড়। মুখমণ্ডলে তীব্র শঙ্কা নিয়ে প্রত্যেকেই টানটান সময় পার করছে। রোগীর ভালো রিপোর্ট শুনে কেউ হাসছে আবার কেউ কাঁদছে, সবমিলিয়ে মিশ্রিত একটি পরিবেশ। সেখানে অপেক্ষমানদের জন্য বসার যা ব্যবস্থা তাতে একেবারেই সঙ্কুলান হচ্ছে না। বেশির ভাগই দাঁড়িয়ে আছে, আমিও। এনজিওগ্রাম করা শেষে রোগী নিয়ে চলে যাওয়া অপেক্ষমান একজনের জায়গায় আমি বসলাম। ভেতরে ঢোকার সময় আব্বুর খুলে রাখা জুতা ব্যাগে ভরে সেটা কোলের ওপর নিয়ে আমি বসে আছি। বিষাদময় মিহি আওয়াজ থেমে থেমে কানে ভেসে আসছে। আমার ঠিক পেছনের সারিতে বসা কেউ একজন ফোনে কথা বলছে আর কাঁদছে। পেছন ফিরে দেখি পঞ্চাশোর্ধ বয়সী একজন মহিলা। কারো কাছে আকুতি মিনতি করছেন- তোর দুলাভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ অন্তত একলাখ টাকা জোগাড় করে দে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। মোবাইলের দিকে তার দৃষ্টি। আবার মিহি আওয়াজে কান্নার শব্দ- বাবা, তোর এই খালার প্রতি একটু দয়া কর, পঞ্চাশ হাজার টাকা যদি ব্যবস্থা করে দিতে পারিস তাহলে খুব উপকার হয়। দুইমাসের মধ্যেই শোধ করে দেব। কান থেকে ফোন সরিয়ে এবার সাথে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললেন তবে স্পষ্ট বোঝা গেল মহিলার সঙ্গে তাদের বনছে না। মহিলা অসহায়ের মতো চেষ্টা করছেন তাদেরকে বোঝানোর। আমি একসময় চোখ ফিরিয়ে নিলাম কারণ কান্না ভীষণ সংক্রামক। মহিলা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। আমি সোজা হয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম।  

অনেকক্ষণ হলো সেই মিহি আওয়াজটি নেই। পেছনে তাকিয়ে দেখি মহিলা দূরে মুখ শক্ত করে একা একা দাঁড়িয়ে আছেন। তার সঙ্গে থাকা আগের সেই মানুষগুলো এখন আর নেই। আমি উঠে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই, রোগীর স্বাস্থ্যের অবস্থা জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন, রোগী তার স্বামী। হার্টে তিনটা ব্লক ধরা পড়েছে। আত্মীয়-স্বজনের অমতে তিনি কিছুক্ষণ আগে ডাক্তারকে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এনজিওগ্রাম করার সময়েই রিং পরিয়ে দিতে। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, স্বামীর অসুস্থতার খবর কাকে দিয়েছি আর কাকে দেইনি সেই প্রসঙ্গটি সবাই ব্যবচ্ছেদ করতে ব্যস্ত। স্বামীর গুরুতর অসুস্থতার সময় যখন মাথা কিছুতেই কাজ করছিল না, শুধু একটাই ভাবনা কাকে ফোন দিলে ততক্ষণাৎ সঠিক সাহায্যটি পাওয়া যাবে।

মোবাইল কললিস্ট চেক করে এক ভাগ্নীকে ফোন করেছিলাম। সেটাই ছিল আমার চূড়ান্ত ভুল। এখন অন্যান্য ভাগ্নী আর জামাইরা আমার ফোন ধরছে না কারণ আমি কেন নিজে থেকে তাদের ফোন করে ঘটনাটি জানালাম না! আমার ছেলের ফেসবুক থেকে তারা খবরটি জেনেছে আর এতে নাকি তারা প্রচণ্ড অসম্মানিত হয়েছে। তাই তারাও আমার খোঁজ নেয়ার তাগিদ একেবারেই অনুভব করছে না। আমার ভাগ্নি, আমার ভাই-বোন যাদের আমি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, তারা আমার পরম আত্মীয়! শুধু রিং পরাতেই চার লাখ টাকা খরচ হবে সঙ্গে অন্যান্য খরচতো আছেই। আমার স্বামী একজন চাকরিজীবী মানুষ কোথায় এতো টাকা পাবে! একবারের জন্যেও কেউ জানতে চায়নি এতোগুলো টাকা আমার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব কীনা। একজনও বুঝতে চায়নি অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা করতে গিয়ে একা আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছি কীনা, হিমশিম খাচ্ছি কীনা। দুই-একজনের কাছে আর্থিক সাহায্য চাওয়ায় তারা পরিবারের অন্যান্যদের নিয়ে মিটিং করে তারপর তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে চেয়েছে। তারা কবে একত্রিত হবে, কবে মিটিং করবে আর কবে তার রেজাল্ট আমাকে জানাবে!

ধরুন, আমি তাদের সময় দিলাম কিন্তু আমার স্বামীর হার্ট সেই সময়টুকু আমাদের নাও দিতে পারে। নিরীহ মানুষটাকে অপমান করতে আর ইচ্ছে হলোনা। আমাদের একটা ওষুধের দোকান আছে। ছেলেকে বলেছি সেটা বিক্রি করে দিতে। এতো উচ্চ মার্গের সব আত্মীয়-স্বজন দিয়ে আমি কী করবো! আত্মীয়-স্বজনের একমাত্র কাজ পরিবারের কারো বিপদ দেখে আহা উহু করা। শেষবেলায় আমি সেই সুযোগটা তাদের দেইনি। আহা উহু করে বিনোদন নিতে থাকা আত্মীয়-স্বজন আমার দরকার নাই। ভদ্রমহিলা এক নাগাড়ে বলে চলেছেন। ‘যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান! ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান।’ যেন অনেকদিনের জমে থাকা দুঃখবোধ তিনি মন থেকে নামিয়ে ভারমুক্ত হচ্ছেন। আমি চুপচাপ শুনছি। একসময় তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন- আমি কাজটা ঠিক করেছি কি না বলেন? উত্তরে জানালাম, আপনি সঠিক সময়ে খুব উপযোগী ও সাহসী একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না আমি নিশ্চিত।

আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রকৃতপক্ষেই কখনো কখনো জুজুর মতো ভীতিকর। বোঝা যায় পরিবারে কারো বিয়েজনিত আনুষ্ঠানিকতার সময়। বিয়ের দাওয়াত প্রসঙ্গ এবং আত্মীয়-স্বজন ব্যবস্থাপনা এই দুইয়ের মধ্যকার সমন্বয় রীতিমত একটি দুরুহ ব্যাপার। বিয়েবাড়ির আনুষ্ঠানিকতার সবকিছু একা সামলানো ভীষণ কঠিন কিন্তু তারচেয়েও কঠিন এই সমস্যাটি কাউকে ব’লে মানানো। ভাই-ভাই, বোন-বোন কিংবা ভাই-বোন এবং এই সম্পর্ককে ঘিরে বর্ধিত লেজুড়ে আত্মীয়বর্গও এসময় বিরাট মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।  ঠিকমত দাওয়াত পৌঁছাতে না পারলে আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো পাকাপাকিভাবে বৈরি হয়ে যায় বিশেষ করে যদি না বিয়ের পাত্র কিংবা পাত্রীর বাবা-মা নিজে গিয়ে দাওয়াত দেন। মাঝে মাঝে জীবন ভীষণরকম কঠিন হয়ে ওঠে শুধু আমাদের অসহিষ্ণু ও স্বার্থান্বেষী জীবনাচরণের জন্য। আমরা প্রতিদিনকার জীবণাচরণকে স্বাভাবিক গতি দেইনা। একারণেই কখনো স্বাচ্ছন্দ্যময়  হয়ে ওঠেনা আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো।

বহুত কিছিমের আত্মীয় আছে- রক্তের সম্পর্কের, রক্তের সম্পর্কের বাইরে কখনো শুধুই আত্মার সম্পর্কের আত্মীয়। আমরা যখন পাঠক; আমাদের একটি নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে। এমনই আত্মীয়তার সম্পর্ক যে দিনকে দিন একে অপরের বৈরিতা বেড়েই চলেছে। আক্ষরিক অর্থেই হয়তো যেখানেই আত্মীয়তার সম্পর্ক সেখানেই অযাচিত কিংবা আরোপিত রক্তক্ষরণের সম্পর্ক থাকে, সেটা কখনো হৃদয়ে কখনোবা শরীরে। বাংলা একাডেমি কর্তৃক শ্রাবণ প্রকাশনী নিষিদ্ধ এবং সেই প্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকারী সৃজনশীল লেখক ও পাঠকগোষ্ঠীর তীব্র প্রতিবাদ গত কয়েকদিনের চর্বিত চর্বন একটি খবর। বইমেলার আয়োজক হিসেবে বাংলা একাডেমির কাছে প্রকাশকগণ খুবই গরীব আত্মীয়। গরীবের গলার জোর কম থাকে। তার চিৎকার পৃথিবীর কারো কানে পৌঁছায় না। পরিবারে কোন ধনী আত্মীয় থাকলে জীবনে একবার না একবার নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন- কত বড় পাপ আপনি করেছে সেই ধনী ব্যক্তিটির আত্মীয় হয়ে! অমর একুশে বইমেলার প্রকাশকগণও কি এখন সেটাই ভাবছেন! আফসোস হলো; গরীব গরীবে একাত্ম হয়ে সমগোত্রীয় কাউকে সমবেদনা জানানোর মনোবলও কারো মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এতো দীনতা যে আত্মীয়তায় মাঝে তাদের সঙ্গে পাঠকদের আত্মীয়তা কেমনে ঘটবে! আশার কথা হচ্ছে যুগে যুগে ভিন্নস্বর ভিন্নচিন্তার ধারক ছিল- থাকবে। দমিয়ে রাখতে চাইলেও সেই ভিন্নস্বর লাখ প্রাণে অনুরণন তুলবেই। অনেক অনেক অভিমান থাকবে তারপরেও আত্মীয়তার বন্ধনের সুখ প্রায়শঃই প্রাণে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়, অজান্তেই মনের গভীর ক্ষত সারিয়ে তোলে।  

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।