এই দায় কার?
এক. সদ্য এসএসসি পাশ করা কয়েকজন ছাত্র প্রধান শিক্ষকের কাছে গেল প্রশংসাপত্র আনার জন্য। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে হলে পূর্বের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের প্রশংসাপত্র অত্যাবশ্যক। জিপিএ’র রমরমা বাজারে ভালো জিপিএ পাওয়া সদ্য প্রাক্তন হওয়া ছাত্রদের দেখে প্রধান শিক্ষক অত্যন্ত খুশি হলেন এবং দ্রুততার সাথে তাদের প্রত্যেককে প্রশংসাপত্র দিলেন। প্রায় ঘন্টা খানেক পর সেই প্রধান শিক্ষক ব্যক্তিগত কাজে স্কুলের বাইরে যাচ্ছিলেন। স্কুলের মূল ফটকের ঠিক পাশেই একটি চা-সিগারেটের দোকান ছিল। প্রধান শিক্ষক খেয়াল করলেন একটু আগে যারা প্রশংসাপত্র নিয়ে গেল, তারাই স্কুলের সামনে ধূমপান করছে। তিনি যখন তাদের পাশ দিয়ে চলে গেলেন, তারা সিগারেট পর্যন্ত মুখ থেকে সরালো না। বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তিনি ভাবতে লাগলেন, ত্রিশ বছর পূর্বে যারা এসএসসি পাশ করেছে তারা এখনও কত সম্মান করে, খোঁজ খবর নেয় আর এখন একি অবস্থা?
দুই. ক্লাস টু’তে নতুন ভর্তি হওয়া এক ছাত্রকে শিক্ষক প্রশ্ন করলেন-
শিক্ষক : তোমার নাম কি?
নতুন ছাত্র : মেরা নাম হে সাল্লু ( পুরো নাম মো. সালমান হোসেন)।
শিক্ষক : তুমি বাংলা বলতে পারো না?
নতুন ছাত্র : থোরা থোরা।
শিক্ষক : জাতীয় সংগীত বলতে পারবা?
নতুন ছাত্র : হা, কিউ নেহি।
শিক্ষক : বলো?
নতুন ছাত্র : জন গণ মন ...ভাগ্য বিধাতা।
শিক্ষক : থামো থামো। কোন দেশের জাতীয় সংগীত গাইছো তুমি?
নতুন ছাত্র : কিউ স্যার, হামারা।
শিক্ষক : বসো।
নতুন ছাত্র : বহত শুকরিয়া । (সংগৃহীত)
তিন. রফিক হোসেন (ছদ্মনাম) একটি এমপিও ভুক্ত স্কুলের ক্লার্ক। দুই সন্তানের মধ্যে বড় জন আগামী জানুয়ারি মাসে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হবে। এখনই মোবাইল ফোন কেনার আবদার শুরু করেছে। ছেলের অভিযোগ ক্লাসের সবারই মোবাইল ফোন আছে কিন্তু তার নেই। সবাই ভিডিও গেমস খেলে, ভিডিওতে কথা বলে, সে কিছুই করতে পারছে না। এখন তাকে মোবাইল কিনে দিতেই হবে। যেকোন মোবাইল হলে চলবে না, অবশ্যই স্মার্টফোন হতে হবে। তা না হলে, সে নতুন ক্লাসে ভর্তি হবে না। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রের মোবাইল ফোনের প্রয়োজনীয়তা কেন, রফিক হোসেন কিছুই বুঝতে পারেন না।
চার. আজকের স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেট, মোবাইল, স্যাটেলাইট চ্যানেল নিয়ে পড়ে রয়েছে। কি নেই সেখানে? এগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক, মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য কোন জিনিসের ব্যবহার কতটুকু হওয়া উচিত, সেটা অবশ্যই বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। ইন্টারনেটে কোমলমতি ছেলেমেয়েরা কি করছে সারাদিন, সেই বিষয়ে সার্বক্ষণিক তদারকি প্রয়োজন। কারণ ভালো খারাপ সবকিছু একটা ক্লিকের উপর নির্ভর করছে ( সেটা মাউস, স্মার্টফোন কিংবা রিমোর্ট যাই হোক)।
বর্তমানে আমাদের সমাজ জীবনে নৈতিক অধঃপতনের চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এ অবক্ষয় কোমলমতি শিশু-কিশোরদের প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতাকে। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার কথা আশা করা যায় না। বড়রা শিক্ষা বলতে বোঝেন পরীক্ষা ও ডিগ্রি এবং জীবনে উন্নতি বলতে বোঝেন টাকা ও প্রতিপত্তি। ফলে শিক্ষার মধ্যে শিক্ষার্থীরা সমাজে খুঁজে পায় না মহত্তর কোনো জীবন-বোধ বা নৈতিক মূল্যবোধ। কিশোর সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো পরিকল্পনা নেই, ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। আজকের আধুনিক বাবা-মায়েরা চাকরি, মিটিং, পার্টি নিয়ে অনেক ব্যস্ত। সন্তানের জন্য তারা অনেক টাকা রোজগার করতে রাজি কিন্তু সময় দিতেই যেন বিপত্তি। সন্তান কি করে, কোথায় যায়, কিভাবে সময় কাটায় এসব তো অন্য মানুষ এসে তদারকি করবে না। বাবা-মায়েদেরই করতে হবে।
পাঁচ. একদিন এক ইঁদুর খাদে পড়ে গেল। এটা দেখে এক শিয়ালের অনেক মায়া লেগে গেল। শিয়ালটা ইঁদুরটাকে উদ্ধার করল। বেশ কিছুদিন পর, শিয়ালটি এক শিকারির জালে ধরা পরল। ইঁদুরটি দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি জালটি তার দাঁত দিয়ে কেটে ফেলল এবং শিয়ালটি মুক্ত হল। এটাই হচ্ছে কর্মফল।
আমাদের শিশু-কিশোরদের সামনে আজ অনেক ধরনের আগ্রাসনের হাতছানি। তথ্য-প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার রোধ করতে হবে। তামিল সিনেমার নায়ক হওয়া বাস্তবে সম্ভব নয়, এই ধারণা অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীর নেই। তারা ভাল মন্দ সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাদের পরিষ্কার করে বুঝাতে হবে। এই আগ্রাসনের কড়াল গ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য প্রত্যেক পরিবারের অভিভাবক, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদসহ সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ আজ যদি বিষয়টি আমরা আমলে না নেই, তবে আগামীতে এই সমস্যা মহামারী আকার ধারণ করবে, যা আমাদের জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। আর দেশকে সেই বোঝা বহন করতে হবে। অথচ সকল দায় কিন্তু আমাদের।
লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
[email protected]
এইচআর/পিআর