সৌরশক্তির ‘বাংলাদেশ মডেল’


প্রকাশিত: ০৪:২৫ এএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

ন্যুয়র্ক টাইমস পত্রিকায় সাবেক মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি আল গোরের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জন সুয়ার্টয-এর লেখা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল গত বছরের মার্চ মাসে, যেখানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় রোধ করতে আল গোরের ‘যুদ্ধ’-কে তুলে ধরা হয়েছিল। পৃথিবীর মানুষ আকাশের সত্যিকারের রং খুব বেশি দিন দেখতে পাবে না, এ আশংকায় উচ্চকিত তার কণ্ঠ। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘এ্যান ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ’, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। বাণিজ্য হিসেবে বায়ু-সূর্যালোকের মতো নবায়নযোগ্য জালানি উৎসকে বেছে নেওয়ার জন্য এই বাণিজ্যের বিনিয়োগ খরচের তুলনায় মুনাফা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে, এই খতিয়ান তুলে ধরে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছেন বিশ্বময়। আর এ কাজের সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হিসেবে তিনি তুলে ধরছেন বাংলাদেশের নাম। বিশ্বাস করতে হবে, যখন তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতে নবায়নযোগ্য জালানি শক্তিকে কাজে লাগানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে, আর বাংলাদেশ হচ্ছে সেই দেশ, যে দেশে প্রতি মিনিটে দু’টির বেশি বাড়ির ছাদে সৌরপ্যানেল  বসানো হচ্ছে!


সূর্যের আলোর শক্তিতে বাংলাদেশের যে সবুজ ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছে, তা এ দেশের মানুষের টিকে থাকার শক্তি। বিশাল জনগোষ্ঠীর বিপুল চাপ সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নানান ধারা থেকে উৎসারিত হয়ে প্রচলিত প্রাকৃতিক গ্যাস-কয়লা-পানিবিদ্যুৎ-আমদানিকৃত জালানির সনাতনী ব্যবহারের মাঝে আটকে আছে। প্রাকৃতিক তেল আর গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে, এই দুই উৎসের তথাকথিত ব্যবহারে আগ্রহী আন্তর্জাতিক নানান প্যানেলের দৌড়ঝাঁপের ফলে ক্রমবর্ধমান দুঃশ্চিন্তা বাংলাদেশকে বাস্তবায়িত পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধ করে।

বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করি। পশ্চিমা দেশগুলোতে বাকি বিশ্বের তুলনায় জীবাশ্ম জালানির পরিমাণ অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও শক্তির ব্যবহারে লাগামহীন ভোগবাদীতা ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর সাথে চীন-ভারত-ব্রাজিলের মতো দেশগুলোর পেট্রোলিয়াম জালানি নির্ভরতার টানাপোড়েন মিশে জালানির বিশ্ববাজার সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের মতো ছোট খেলোয়াড়দের নাভিশ্বাস তুলে ফেলছে। বন্ধু দেশগুলো থেকে কম মূল্যে পেট্রোলিয়াম আমদানী, বাসাবাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাসের নবাবী ব্যবহার, পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরে ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানী সরবরাহ খুব বেশি দিন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়াটা যৌক্তিক নয়। ওদিকে জীবাশ্ম জালানির যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে জলবায়ু বিপর্যয়, সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাওয়াসহ প্রাকৃতিক হামলার আশংকায় আমাদের মতো থরথর কম্পমান দেশ আর কয়টা আছে! সব দিক বিবেচনা করে সৌরশক্তির প্রতি হাত বাড়িয়ে দেওয়া ছিল প্রকৃতির আশীর্বাদ হাত পেতে নেওয়ার মতই ঘটনা।

এ তো সুফল ফলবে কি, এ দুঃশ্চিন্তাও ছিল। সৌরশক্তির প্রাথমিক ব্যয় বলা যায় প্রচলিত বিদ্যুৎখাতের চেয়ে অনেক বেশি। জার্মানী-চীন-ভারতের মতো এ খাতে ভর্তুকি না দিয়ে জাতীয় গ্রিডে শক্তি যোগ করতে হবে। কিন্তু এই ভর্তুকি দেওয়ার যথাযোগ্য কারণটা বোধগম্য তো হতে হবে সবার কাছে। ভাগ্যক্রমে সৌরশক্তি নিয়ে কাজ করার মতো প্রযুক্তি স্থাপনে সক্ষম এমন প্রাইভেট সেক্টর বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। আবহাওয়া আর ভূতাত্ত্বিক অবস্থানও বাংলাদেশের পক্ষে। দরকার ছিল সত্যিকারের কর্মপরিকল্পনা, সরকার সেই দরকারি কাজটাতে এগিয়ে এসেছে সাহায্যকারীর ভূমিকা নিয়ে।

বাংলাদেশের উপর সূর্য কতখানি শক্তি উৎপাদনযোগ্য আলো বিচ্ছুরিত করে, তার পরিমাণ নিয়ে গবেষণা-উপাত্ত হাতে ছিল না। প্রতিবেশি ভারতের উপাত্তকে ভিত্তি করে কাজ শুরু হ’ল। উন্নত দেশগুলোর সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সাথে হিসাব করে এই সম্ভাবনা উৎসাহ জোগাল। বিনা মূল্যের জালানি  উৎস সূর্য যা ফুরিয়ে যাওয়ার আশংকামুক্ত, তা যেন আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের মানুষের জালানি ভবিষ্যৎকে আশা জাগাতে এগিয়ে এল। ফলশ্রুতিতে পরিবেশবাদী অনেকের মতোই  আল গোরের আশাবাদী কণ্ঠে বাংলাদেশ নামটি ধ্বণিত হতে পারল বাস্তবতার নিরিখেই।

দীর্ঘমেয়াদী সুফল লুকিয়ে আছে সৌরশক্তি ব্যবহারে। সৌরশক্তি কেন্দ্রিক জনবল তৈরির মাধ্যমে বেকারত্ব নিরসনের সুযোগ সৃষ্টিও কম আশাবাদ নয় এ দেশের জন্য। ২০২০ সাল নাগাদ ৭৫ মিলিয়ন বাংলাদেশি নবায়নযোগ্য শক্তির সহযোগী কর্মশক্তিতে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়। সৌরপ্ল্যান্ট নির্মাণ, সৌরপ্যানেল প্রতিস্থাপন, ব্যাটারি নির্মাণ, সুইচ-তারসহ নানা রকমের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি নিয়ে গড়ে উঠছে বিশাল কর্মক্ষেত্র, ফলে প্রযুক্তিবিদ আর মিস্ত্রির শতভাগ চাহিদা পূরণ হতে পারছে দেশেই। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিপিডিবি সারা দেশেই ছড়িয়ে দিচ্ছে স্থানীয়ভিত্তিক ১ থেকে ১০ মেগাওয়াট ক্যাপাসিটির বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, যা স্থানীয় চাহিদা মিটানোর জন্যই নিবেদিত। ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রাকৃতিক বা যে কোন ধরনের বিপর্যয়ে পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দুর্ভাবনা নেই। পুরো দেশ সৌরশক্তি উৎপাদনের গ্রিডে চলে এলে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরও জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়া বিদ্যুৎ তৈরি করবে আরো নতুন কোন সম্ভাবনার। কৃষি-মৎসচাষ-তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে কোন এজেন্ডা হয়তো তখন থাকবেই না। দেশজুড়ে নিত্য নতুন শিল্পস্থাপন প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের সাফল্য এনে দেবে। বিদ্যুৎ সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠছে নারীকেন্দ্রিক ক্ষুদ্রশিল্প, যা এক সময় নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গসমতার চ্যালেঞ্জে পুরোপুরিভাবে সফল করবে এ দেশকে। পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধ এবং পরিবেশের ভারসাম্য সম্ভব করবে সৌরশক্তির ব্যবহার যা প্রকারান্তরে টেকসই উন্নয়নের জাতিসংঘের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশকে সাহায্য করবে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের রোল মডেল।

২০২১ সাল নাগাদ লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনার জন্য বিদ্যুৎ ও জালানি মন্ত্রণালয় বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ চিহ্নিত হতে পেরেছে সম্ভাবনাময় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে। বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার চ্যালেঞ্জ উতরানো গেলে এই সাফল্য উদযাপন করা যাবে মন খুলে। ২০১১ সাল থেকে গ্রিড উন্নয়নের মেগা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। ডিজিটাল স্মার্ট মিটারিং সিস্টেম, নবায়নযোগ্য জালানি প্রযুক্তিতে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ ২০২০ সাল নাগাদ শতকরা ১০ ভাগ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, এমন আশাবাদ নিয়ে জাতীয় নবায়নযোগ্য শক্তি নীতি ২০০৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের প্রথম সৌরশক্তিসম্পন্ন দেশ।


সৌরশক্তির বাংলাদেশ মডেল আসলে এখন এরকম: চরাঞ্চলে মাছ ধরার নৌকার ছাউনিতে সৌরপ্যানেল বসিয়ে মাছ ধরতে ছুটছেন বাংলার জেলে। কৃষিজমিতে সেচ দিতে যে বিদ্যুৎ লাগছে, তা যোগাচ্ছে আকাশ ভরা সূর্যেরই আলো। প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দারা ঘুটঘুটে আঁধারে ঢেকে যাওয়া গ্রামের স্মৃতি ভুলতে বসেছেন, অথচ পনের মিলিয়ন মানুষের ঘরে ঘরে জ্বলে সৌরশক্তি চালিত বাল্ব, অথচ দেশের সব গ্রামে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি। এই মানুষগুলোর খুব একটা দরকারও নেই জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের।

জাতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছর নাগাদ সতের লাখ মানুষের ঘরে পৌঁছাবে সৌরবিদ্যুৎ, লোডশেডিং-এর যন্ত্রণা ছাড়াই, কেননা জাতীয় গ্রিডের মতো সৌরবিদ্যুতের অভিধানে লোডশেডিং বলে কোন দুর্ঘটনার শব্দ নেই। একটি ২৫০ ওয়াট প্যানেল এক দিনে নিরবচ্ছিন্নভাবে ১ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। ঘরের ছাদে ছাদে প্রতি মিনিটে এখন স্থাপিত হচ্ছে এরকম দু’টি প্যানেল, এ তথ্য আমরা  আল গোরের কাছ থেকেও শুনেছিলাম। ১৯৯৬ সালের দিকেও ব্যয়বহুল বলে সৌরপ্রযুক্তির বিরুদ্ধে অনেক কথা শুনতে পাওয়া গেলেও সরকারের দৃঢ় প্রচেষ্টায় শক্তির এই খাতটি গড়ে উঠেছে আর বছরে এ দেশ ২ লাখ টন কেরোসিন পোড়ানো বন্ধ করে ১৮০ মিলিয়ন ডলারের সাশ্রয় ঘটাতে পেরেছে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলো কম সুদে ঋণ সুবিধা পাচ্ছে সৌরপ্যানেল স্থাপনে।


একটি ১০০ ওয়াট প্যানেল তৈরিতে বাংলাদেশি ৫০,০০০ টাকা (৬৪০ ডলার) ব্যয় হয়। সরকার বাসাবাড়িতে এবং বিদেশি বিনিয়োগে সৌরপ্ল্যান্ট স্থাপনে গ্রান্ট এবং কম হারের ঋণসুবিধা দিচ্ছে। তেল নিয়ন্ত্রিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের চেয়ে দুই তৃতীয়াংশ কম শুল্কে সৌরপ্যানেল স্থাপনের খরচ তুলনামূলকভাবে লাভজনক চেহারায় হাজির হচ্ছে। সন্দ্বীপে ১০০ কিলোওয়াট সৌরপ্যানেল প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে, যা কাজ শুরু করেছে ২০১০ সাল থেকে। আগামী বছর নাগাদ এরকম আরো ৫০টি তথাকথিত মিনি সৌর-গ্রিড দেখ যাবে দেশজুড়ে। ২০১৫-এর নভেম্বরের দিকে বিরাট আকারে টেকনাফে সোলার পার্ক গড়ে তোলার অনুমোদনও দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার, ২০২০ সাল নাগাদ এই পার্ক আরো ২০০০ মেগাওয়াট বা সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের শতকরা ১০ ভাগ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে সক্ষম হবে। এই দশকের শেষে ২০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সোলার পার্ক থেকে তুলে আনার মহাপরিকল্পনা নিয়েছে দেশটি। বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে সোলার পার্ক গড়ে তোলার মতো খালি জমির অভাব আছে বলে থেমে নেই পরিকল্পনা। অকৃষিজমিতে গড়ে উঠবে পার্কগুলো, যাতে কৃষির কোন ক্ষতি না হয়। এছাড়া বাসাবাড়ি-বাণিজ্যিক ভবন-শিল্পকারখানার ছাদ তো রয়েছেই।

সৌরশক্তির বাংলাদেশ মডেল আসলে ‘গ্রিন বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার সোনালী স্বপ্ন। বাংলাদেশের প্রতিটি উলম্ব তল সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত হলে সেই সোনালী স্বপ্নের অসাধারণ বাস্তবায়ন ঘটবে, এ নিদ্বির্ধায় বলা যায়।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, কলামিস্ট।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।