১৯৭১ এবং তিন লাখ নারীর ‘সম্ভ্রম’


প্রকাশিত: ০৫:৪৯ এএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

১৯৭১। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের কাল। একই সঙ্গে সবচেয়ে ভয়ংকর গণহত্যা ও নিপীড়নের কাল। মুক্তিযুদ্ধ বললেই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং তিন লাখ নিপীড়িত নারীর কথা মনে ভেসে ওঠে। ১৯৭১ সালে এথনিক ক্লিনজিংয়ের নামে মানব ইতিহাসের বীভৎসতম ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল বাঙালি নারী।

পাকিস্তানি নরপিশাচদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি পুরুষদের হত্যা করা এবং বাঙালি নারীদের গর্ভে তাদের সন্তান উৎপাদনের নামে এমন এক গোষ্ঠি সৃষ্টি করা যারা হবে মনে প্রাণে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অনুগত ও গোলাম। অ্যাটিলা দ্য হুনের বর্বর বাহিনী দ্বারা রোমে, চেঙ্গিস খানের সময়ে সমরখন্দ, বুখারায়, তৈমুর লংগের সময় দিল্লিতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর বন্দী শিবিরে, জাপানি হামলায় চীনের নানকিংয়ে(নানচিং)এবং নব্বই দশকে বসনিয়ায় যে গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালানো হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর নির্যাতন ছিল তারচেয়েও বেশি।  

বিজয়ের পর আমরা নারীর উপর সংঘটিত পাকিবাহিনীর বর্বরতম ধর্ষণকে ‘সম্ভ্রম হারানো’,‘ইজ্জত’ ইত্যাদি বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত করা শুরু করলাম। যদিও ধর্ষণের শিকার হওয়া মানে কোনোভাবেই ‘সম্ভ্রম হারানো’ নয়। সম্ভ্রম, ইজ্জত, সম্মান কোনোটাই নারীর প্রজনন অঙ্গে অবস্থান করে না। ৭১ এ প্রকৃতপক্ষে সম্ভ্রম হারিয়েছে, বেইজ্জত হয়েছে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী। পুরো বিশ্বের সামনে তারা যুদ্ধাপরাধী, ধর্ষক, বর্বর হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যে নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তারা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তারা যে নির্মম গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন সে কথাটি স্পষ্টভাষায় সঠিক শব্দে বলতে হবে। ‘সম্ভ্রম হারানো’ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে পাকিস্তানি ও রাজাকারদের অপরাধকে নরম ও লঘু করার কোনো প্রয়োজন নেই। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের প্রায় তিন লাখ নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন একথা স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করে এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সম্মান দিতে হবে। সেই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের উচিত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

এদেশে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই নারীদের হেয় করার এবং রাজাকারদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যে বীরাঙ্গনাদের বঙ্গবন্ধু কন্যার মর্যাদা দিয়েছিলেন তাদের মাথার উপর সামাজিক অগৌরবের বোঝা চাপিয়ে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকাও দেখা যায়।

রাজাকার আলবদর আলশামসের ঘাতক, ধর্ষক, লুটেরাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার মাধ্যমে ত্রিশ লাখ শহীদ ও তিন লাখ নিপীড়িত নারীর প্রতি ঋণ শোধের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়াতেই প্রয়োজন সকল রাজাকার, ঘাতক দালালের নাম সংগ্রহ, লিপিবদ্ধ এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার কাজ সুসম্পন্ন করা। সেই সঙ্গে সকল শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা করা প্রয়োজন। সেই তালিকায় পাকিস্তানি নরপিশাচদের ধর্ষণের শিকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নারীদের নামের তালিকাও করতে হবে। তাদের আর মুখ লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। কারণ তারা ভিকটিম, নিপীড়িত এবং যুদ্ধাহত। এটি তাদের লজ্জা নয় বরং গৌরবের ইতিহাস। এই নারীদেরসহ সকল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের প্রাপ্য ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। এই যুদ্ধাহত নারীদের সন্তানরাও যেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে প্রাপ্য সকল সুযোগ সুবিধা পান সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাতকদেরও আন্তর্জাতিক বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন কূটনৈতিক তৎপরতা। নাৎসি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্ধশতক পরও খুঁজে বের করে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালের অধীনে আনা হয়েছে। তাদের বিচার ও শাস্তি হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপরাধীদেরও সাক্ষ্যপ্রমাণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করতে হবে। অন্ততপক্ষে দাবি জানাতে হবে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়ায় গণহত্যা এবং কোরীয় নারীদের ধর্ষণ করার অপরাধ স্বীকার করে জাপান ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। তাহলে পাকিস্তানকেও ক্ষমা চাইতে হবে বাংলাদেশের কাছে। আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতার উপর এর সাফল্য নির্ভর করবে।

একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। যুদ্ধের সময় এই রাজাকার আলবদররা দেশের মানুষের সঙ্গে চরম বেইমানি করেছে। পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এরা লুটতরাজ করেছে, হত্যা চালিয়েছে,  নারীদের ধর্ষণ করেছে, মুক্তিকামী মানুষকে তুলে দিয়েছে মিলিটারির হাতে। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থে উল্লিখিত বীরাঙ্গনাদের জবানবন্দিতে দেখা যায় তাদের প্রত্যেককেই পাকিসেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিল রাজাকাররা। এবং তারা ধর্ষণও চালিয়েছে। এই রাজাকাররাই বাঙালি নারীদের ‘গনিমতের মাল’ আখ্যা দিয়ে গণধর্ষণকে বৈধতা দিতে চেয়েছে।

স্বাধীনতার পরও এই পরাজিত শক্তি যখনই সুযোগ পেয়েছে দেশের উপর, মুক্তচিন্তার উপর আঘাত হেনেছে। ২০০০ সালে নির্বাচনের পর এরাই আবারও ৭১ এর স্টাইলে সংখ্যালঘুদের উপর গণহারে ধর্ষণ, লুট ও নিপীড়ন চালিয়েছে।

যুদ্ধের সময় দেশের মানুষকে লুট করা টাকায় রাজাকাররা সম্পদের পাহাড় গড়ে। এই সম্পদেরও হিসাব দাবি করা প্রয়োজন। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যদি সকল যুদ্ধাপরাধী রাজাকার দালালের বিচার সম্পন্ন করতে পারি তবেই ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে পারবো। তবেই তিন লাখ নারীর উপর সংঘটিত বর্বরতম নিপীড়নের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব হবে। একমাত্র সেদিনই আমাদের পরিপূর্ণ বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে আমরা মনে করবো।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।