অবশেষে আলোর পথে দেশ?


প্রকাশিত: ০৪:১১ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

এই স্বাধীনতা দিবসে প্রথমে মনে হচ্ছে আমরা কি এতদিনে পঁচাত্তর-পরবর্তী ভ্রান্তি-বিভ্রান্তির নিরসন করতে সক্ষম হয়েছি? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং শাস্তিসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অনেক কাজ হচ্ছে। কিন্তু তবুও শংকা কাটে নি। সত্যিই জাতির ভ্রান্তি কেটেছে কিনা তার একটি জবাব হয়ত নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে মিলবে।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও এ যুদ্ধে বিজয় বাঙালি সম্পর্কে প্রচলিত নিন্দার ভালো জবাব হয়েছিল। আমরা বীরত্ব ও ত্যাগের মন্ত্রে সেদিন সত্যিই জেগে উঠেছিলাম। কিন্তু তারপর যেন গোটা জাতিই খেই হারিয়ে ফেললাম। দুটি সামরিক শাসন আমাদের কেবল পিছনের দিকে নিয়ে গেছে। একই ধারা বজায় রাখলেন বেগম জিয়া। বাঙালি হয়ত ফিরল না পুরোনো অভ্যাসে, কিন্তু এ সময়ে ব্যাপক মানুষের ইতিহাস জ্ঞান, জাতীয় চেতনার গোলমাল হয়ে গেল। আমরা হয়ে পড়েছিলাম বিভ্রান্ত দিগভ্রান্ত জাতি।

আমরা জানি, বাঙালি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হল- জাতটা হুজুগে, আবেগপ্রবণ এবং কোমল স্বভাবের। এছাড়াও তার অনেক নিন্দা আছে, তা রবীন্দ্রনাথ সবিস্তারে বলেছেন বিদ্যাসাগর চরিত্রের বিপরীতে বাঙালির বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে। তাঁর মতে বাঙালি প্রচুর কথা বলে কিন্তু সে তুলনায় কাজ করে না, পরের নিন্দায় তুখোড় কিন্তু নিজের ভুল দেখতে পায় না, কোনো কাজ সাড়ম্বরে শুরু করলেও শেষ করে না। অর্থাৎ বাঙালি বাগাড়ম্বরপ্রিয়, অলস, পরশ্রীকাতর, অধৈর্য। প্রথম যে তিনটি ধারণার কথা বলা হল তার শেষেরটি অর্থাৎ কোমল স্বভাব এখন বোধহয় বাঙালিতে দুর্লভ। এমনকি বাঙালি মা সম্পর্কেও এ বিশেষণ প্রয়োগ করতে আজ কুণ্ঠা হবে।

শেষের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সবই রয়েছে কেবল আলস্য কেটেছে বলে মনে হয়। কিন্তু ধৈর্যহীন আবেগপ্রবণ মানুষ গুছিয়ে পরিকল্পনা করে কি কাজ করছে? বরং বাঙালির মধ্যে ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটানোর আবেগে বাঁধভাঙা জোয়ার আসায় সমাজজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তার বহর ও গভীরতা কতটা তা বোঝার যায় সাম্প্রতিক বীভৎস সব খুনের ঘটনায়। এখানে মায়ের হাতে আপন সন্তান খুন হয় তো আবার সন্তানের হাতে আপন বাবা-মা খুন হন। শিশুহত্যা, শিশু ধর্ষণ ও হত্যা, নারী নির্যাতনের নানা পৈশাচিকতা চলছেই। এসব দেখে শুনেও আমরা সময় মতো গা করি না, ঠিক মতো ব্যবস্থা নিতে পারি না। ব্যাংক লুটপাট, রাজউকের দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি এসব চলছে কোটি টাকার দাগে। জঙ্গিবাদ এক অশনি সংকেত হয়ে আছে।

আজ তুচ্ছ কারণে, প্রায় অকারণে, খুনোখুনির ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব মারাত্মক অপরাধ জঙ্গিরা ঘটাচ্ছে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেশাগ্রস্তরাও নয়। ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্ষা এবং ইন্দ্রিয়জ কামনা চরিতার্থ করার লোভ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। ছোটবেলায় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের একটি লেখা আমাদের পাঠ্য ছিল- তাতে আছে মানুষের ভিতরের সু ও কু প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বের কথা। কোন প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হব তা বিচার করার ক্ষমতা মানুষকে অর্জন করতে হয়। কেননা মানুষমাত্রেরই লোভ, হিংসা, কাম, ক্রোধ এমন সব নেতিবাচক প্রবণতা থাকে। তাকে শিক্ষার মাধ্যমে, চর্চার ভিতর দিয়ে প্রশমিত রাখতে হয়, যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, অন্যের ক্ষতির কারণ না হই আমরা। কিন্তু আজকের পরীক্ষানির্ভর মুখস্থবিদ্যার শিক্ষায় চর্চার সুযোগ কোথায়, প্রয়োজনই বা বোঝে কে? জীবনের শুরুতে চরিত্র গঠনের সময়ে যদি চারিত্রিক গুণের বীজ না পড়ে তা হলে সে গুণগুলো কী করে একজন মানুষের মধ্যে বিকশিত হবে?

তাই আমরা একদিকে ফলাফলের ভিত্তিতে মেধায় ও উচ্চশিক্ষায় সফল মানুষে দেশ ছেয়ে যেতে দেখছি আর অন্যদিকে সেই সাথে নৈতিক বলে উন্নত চরিত্রের মানুষের আকালও দেখছি সর্বত্র। ঘুষের প্রলোভন জয় করা, অবৈধ উপার্জনের লোভ সামলানো, ফটকা বাজারে মুনাফা করে লাল হওয়ার খায়েশ রোধ করার ইচ্ছা এবং সাধ্য কারুর নেই। ফলে এ সমাজ নৈতিকতার কোনো ভিত দাঁড় করাতে পারছে না।
ক্রমেই পরিস্থিতি এমন হচ্ছে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না, একটা অবিশ্বাস ও ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে। নারীর পক্ষে পুরুষকে, শিশুর পক্ষে বড়দের, সংখ্যালঘুর পক্ষে সংখ্যাগুরুর, সাধারণের পক্ষে পুলিশকে, রোগির পক্ষে ডাক্তারকে এবং সর্বশেষ সন্তানের পক্ষে আপন মাকে, মা-বাবার পক্ষে আপন সন্তানকে বিশ্বাস করার মত বাস্তবতা থাকছে না। একি ভাবা যায়?

আমরা সব ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটাতে চাই। উদাহরণ টানি উন্নত দেশের। আমি কেবল অপরাধের কথা বলছি না। মানসিকতার সংকটের কথা বলছি। পরিবারের অভ্যন্তরে পারস্পরিক বিশ্বাসের সংকট থেকে সৃষ্ট দু’তিনটি ঘটনাকে সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলব না। কিন্তু সন্তানের সাথে বাবা-মার সম্পর্ক কি চর্চার মাধ্যমে গভীরতা পাচ্ছে, অর্থপূর্ণ হয়ে উঠছে? নিতান্ত শিশুবয়সে কিছু সময় দিলেও, একটু বড় হওয়ার পর তো কেউ আর সন্তানকে সময় দিতে চান না। অসহায় গিনিপিগ শিশুরা কেবল স্কুল-কোচিং, পড়া-পরীক্ষার বৃত্তের মধ্যে জীবন কাটাতে থাকে। তা বলে অধিকাংশ খুনি হবে না নিশ্চয়, কিন্তু অধিকাংশের শৈশবকে খুন করা হচ্ছে বলে কেউই সুস্থ স্বাভাবিক মানবিক সত্ত্বা নিয়ে বিকশিত হতে পারবে না। এ পরিণতির অনেকটা দায় বাবা-মা এড়াতে পারবেন না।

বড়দের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক না হওয়ায় বয়ঃসন্ধিকালে শিশুরা যেসব  সমস্যায় ভোগে এবং যেসব আকাক্ষা তার মধ্যে জাগে সেসবের কোনো সঠিক ব্যাখ্যা কিংবা সমাধান তাদের জানা হয় না। এ সময় তারা থাকে খুবই নাজুক, তাদের মনোজগৎ যথার্থ যত্ন ও সময়োচিত সাহচর্যের, পরামর্শ-উপদেশের অভাবে ভেঙে পড়তে পারে, আর নয়তো তারা মেজাজী, অসহিষ্ণু অধৈর্য এবং মারমুখি হয়ে উঠতে পারে। এরই প্রতিফলন দেখি বড় হওয়ার পরে তাদের জীবনে, নিত্যদিনের সামাজিক অভিজ্ঞতায়। তরুণদের একটি অংশ নেশায় জড়াচ্ছে, একটি অংশ জঙ্গিবাদে ঝুঁকছে, আর বড় অংশটি দুর্বল প্রস্তুতি আর লক্ষ্যাদর্শের বিভ্রান্তিতে সামাজিক সমস্যাই বাড়াচ্ছে।

এমন সমাজে যারা দুর্বল তারা সকলের হাতে অত্যাচারিত হয়। আর সবল অর্থাৎ ক্ষমতাবান উত্তরোত্তর তার প্রতিপত্তি একচেটিয়া করে নিতে থাকে। এভাবে সমাজে অপরাধ বাড়তে থাকে।

আমাদের সমাজ নারীবান্ধব নয়, শিশুবান্ধব নয়, সংখ্যালঘুদের প্রতি সদয় নয়, এমনকি নয় পরিবেশবান্ধব। সমাজে ভোগ ও দখলদারির মনোবৃত্তি বেড়েই চলেছে- সম্পত্তি দখল ও ভোগে মানুষের বাসনা কোনো বাঁধ মানছে না। আমরা লক্ষ্য  করি বেপরোয়া এই মনোভাব বাড়বাড়ন্ত বলে ক্ষমতাবানের বা ক্ষমতাসীন পরিচয়ে অত্যাচারের মাত্রা সমাজের সহ্য করার বা শুষে নেওয়ার ক্ষমতা অতিক্রম করে গেছে। সমাজ নিজেও নানান অন্যায় ও অপরাধের সাথে আপোস করে এর প্রতিকারে আর সক্ষম নয়। তাই মোটামুটি দুদকসহ সকল প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ একযোগে পতনের গভীর খাদের দিকে চলেছে। ব্যক্তির বিবেক বা নীতিবোধ খড়কুটোর মত উড়ে যাচ্ছে সম্মিলিত অপরাধশক্তির কাছে।

উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে মানুষ ও সমাজের এই ডুবে মরার বাস্তবতা যদি দেখতে না পাই আমরা তাহলে সে হবে মস্ত আফসোসের ব্যাপার। কারণ এমন বাস্তবতায় কোনোভাবেই আমরা আর টিকতে পারব না। বরং এই বাস্তবতায় নতুন নতুন ঝকঝকে ফ্লাইওভার, সেতু, সড়ক, ভবনগুলো আমাদের উপহাস করবে। বিজয়ের বাগাড়ম্বর দিয়ে আত্মঘাতী সর্বনাশা পথে চলার পরিণতি ঠেকানো যাবে না। বরং এ অভ্যাস না ছাড়লে দেশের স্বাধীনতা থাকলেও মানুষের মুক্তি অধরাই থেকে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ঘোষণায় তো স্বাধীনতার পাশাপাশি মুক্তির কথাও ছিল। বিজয়ের মাসে এ ভাবনা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা এক মর্মান্তিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়।

এই প্রেক্ষাপটেও বলব আজ এত বছর পরে আমরা কিন্তু সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলোর দেখা পাচ্ছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গুণে অন্তত এখন পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন সত্যিই এক পরিণত রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁর আমলে দেশ সকল সামাজিক সূচকে এগিয়ে চলছে, ইতিহাসের অনেক বকেয়া দায় মিটিয়েছে, আধুনিক উন্নত দেশ গড়ার সূচনা হয়েছে, দেশ আত্মবিশ্বাসী ও আত্মসম্মানের সাথে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

সমাজকে এবার রাষ্ট্রনেতার সাথে দক্ষতা ও সততার পরিচয় দিয়ে দেশগড়ার কাজে শামিল হতে হবে। তাঁকেও পিতার মত বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠন করার লক্ষ্যে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। এবারের বিজয় দিবস যেন বাংলাদেশের জন্যে কালান্তরের বিজয় দিবস। আমরা আশা করব, এবারে বিজয়ী জাতি নবযুগের পথে পা বাড়াবে। এই বিজয় দিবসের প্রভাতসূর্য সেই প্রত্যাশার আলো নিয়েই হাজির হবে- এই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, সমাজচিন্তক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।