এখনও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীরা এদেশে রাজনীতি করছে


প্রকাশিত: ০৩:৪৯ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধাটি এসেছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, যেদিন এদেশের বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য বাঙালিকে মেধাশূন্য করে দেয়া এবং এই জাতিকে কয়েক শত বছর পেছনে টেনে নামানো। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে এতে অত্যন্ত সফলকাম হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। একাত্তরের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ আসলে একটি মধ্য-মেধার দেশ হিসেবেই টিকে আছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, যদি এভাবে দেশকে মেধাশূন্য করা না হতো তাহলে আজকে পরিস্থিতি হয়তো অন্যরকম হলেও হতে পারতো।

আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, এদেশ মেধাশূন্য হতে শুরু করে উপমহাদেশে যখন ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি শুরু হয় এবং হিন্দু ও মুসলমান দু’টি পৃথক জাতিসত্ত্বার আবির্ভাব ঘটে। অভিন্ন ভারতীয় জাতিত্ত্বের ভাবনাটিকে পাশ কাটিয়ে যখন ধর্মকে আঁকড়ে ধরে এই বিভেদ তৈরি হয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই এদেশের মেধা ও মননেও এক ধরনের ফাটল সৃষ্টি হয়। যে কারণে আমরা দেখতে পাই যে, দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে এদেশ থেকে শিক্ষিত হিন্দু শ্রেণির একটি বড় অংশ ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে রাতারাতি এদেশে এক ধরনের মেধাশূন্যতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

এই শূন্যতার জায়গাটি দখল করে ধর্মের আফিম খাওয়া একদল মানুষ, যারা রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে, যারা আরবি ভাষা প্রচলনে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রচলন করার পাঁয়তারা করে। তারা বাংলা ভাষাটিকেও শত্রু জ্ঞান করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাতো তাদের কল্পনাতেও ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে স্বাধীনতা আন্দোলন এদেশে গড়ে উঠেছিল তা মূলতঃ ছিল এ মাটি থেকে উঠে আসা অসাম্প্রদায়িক তরুণ বাঙালির নতুন করে আত্মপ্রকাশের কাল। তারা পুরোনো ওই পাকিস্তান-মনা শ্রেণিটিকে কেবল অস্বীকারই করেনি, তারা তাদের অস্তিত্বকেই উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল। এবং তাতে সফলও হয়েছিল। ঠিক এ সময়ই এদেশে থেকে যাওয়া হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণিটি এই অসাম্প্রদায়িক তরুণ তুর্কিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শিক্ষিত মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের তরুণ অংশও। যে কারণে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধ আসলে একটি অসাম্প্রদায়িক চেহারা ও চরিত্র পেয়েছিল।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভয় ছিল এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই। ফলে তারা গোটা ১৯৭১ সাল জুড়ে এদেশে মূলতঃ বেছে বেছে হিন্দু বাঙালি ও মুসলমানদের সেই অংশকেই হত্যা করেছে যারা আসলে এ মাটিতে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বাঙালির কট্টর অংশটিকে পাকিস্তানিরা বরং কোলে বসিয়ে আদর করেছে, প্রতি ভোরে রাও ফরমান আলীর মতো বাঙালি নিধনের সামরিক নেতা এদেশের পাকিস্তান-মনা বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নাস্তা করেছে এবং বাঙালি হত্যার নীল নকশা চূড়ান্ত করেছে।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সেই সব বুদ্ধিজীবীকেই হত্যা করা হয়েছে যারা পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক হয়েও ষাটের দশকের শেষ ভাগে এসে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে শুরু করেছেন এবং মনে-প্রাণে একটি অসাম্প্রদায়িক ও স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পক্ষে কাজ করেছেন। তারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেননি ঠিকই কিন্তু তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। দখলদারদের চিরাচরিত ভয়ঙ্কর চরিত্র যা মূলতঃ দখলীকৃত ভূখণ্ড হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে করে থাকে বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা তাই-ই করেছে, এদেশের মাথাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, যাতে স্বাধীন হলেও এদেশ আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। হয়েছেও তাই, বাংলাদেশ এখনও মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে  হাঁটছে কেবল, কোমর সোজা করে এখনও ঠিক দাঁড়াতে পারেনি।

দেশের রাজনীতির দিকে যদি তাকাই আমরা তাহলে দেখতে পাই যে, দেশ এখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষে বিভক্ত, এখনও একটি পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা করতে মোটেও দ্বিধান্বিত নয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন এই বিরোধিতার পক্ষটির রাজনীতির সঙ্গে যারা যুক্ত তারা বাংলাদেশকে মনে করে লুটপাটের কেন্দ্র। এদেশ থেকে লুট করে নিয়ে গিয়ে অন্য দেশে তারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, বছরের পর বছর সেখানে রাজার হালে বাস করে এদেশ থেকে লুট করে নিয়ে যাওয়া টাকায়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, যে পাকিস্তানের সেনাতন্ত্র থেকে বেরুনোর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ বছরেরও বেশি সময় কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন সেই বাংলাদেশেই তাকে হত্যার ভেতর দিয়ে নতুন করে সেনাতন্ত্রই কায়েম হয়েছে।

জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনা বাহিনীকে অত্যন্ত নোংরা ভাবে ব্যবহার করে প্রথমে ক্ষমতা দখল করেছে তারপর তাদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, সেনা বাহিনীর ভেতরকার মুক্তিযোদ্ধা অংশকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যা করেছে এবং তারপর এদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের ফিরিয়ে এনে বহুদলীয় রাজনীতির নামে রাজনীতিকেই কলুষিত করেছে। তার পরবর্তী জেনারেল এরশাদ জেনারেল জিয়ার কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে মাত্র, কিন্তু আজকে আমাদের অতি সুশীল ব্যক্তিটিও জেনারেল জিয়াকে স্বৈরাচার না বলে কেবল এরশাদকে স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন আমাদেরকে, যা সত্যকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা তথা মিথ্যাচারই, অন্য কিছু নয়। শুধু তাই নয়, এদেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথে এই সেনা শাসকদের হাতে তৈরি রাজনৈতিক দলগুলি কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা যে কতো বড় বাধা তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ গঠনের প্রাক্কালে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতাই কেবল করেনি তা বন্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। প্রকারান্তরে তারা কিন্তু এখনও বুদ্ধিজীবী হত্যাকে জায়েজ মনে করে এবং তাদের হত্যাকারীদের এখনও দেশে ও বিদেশে সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রেখেছে।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে শাহবাগে জমায়েত হওয়া তরুণদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে দেশের ধর্মবাদী অপশক্তিকে তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়াকে কেউ রাজনৈতিক কৌশল বললে বলতে পারেন কিন্তু মুক্তবুদ্ধির চর্চার বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় আঘাত আমাদের জীবতকালের ইতিহাসে আর দু’টি পাওয়া যাবে না। এদেশে ব্লগারদের ওপর চাপাতি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস পেয়েছে এই অপশক্তির বলেই, যারা এদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে হত্যা করেছে এবং পরবর্তীতে এদেশের তরুণ সমাজের দাবিকে ধর্মের তলোয়ারে কতল করতে চেয়েছে। তার মানে হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পক্ষে এখনও তারা সক্রিয় ও এদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে তারা বাধাগ্রস্ত করতে এখনও বদ্ধ পরিকর। তারা যে সফল হয়েছে তাদের এই অপকর্মে সেটাও আমরা দেখতে পাচ্ছি, কারণ, বাংলা ব্লগগুলো এখন আর কোনো গবেষণালব্ধ রচনায় সমৃদ্ধ নয়, ফুল-পাখি-লতা-পাতা বিষয়ক কবিতা দিয়েই সেগুলো ঠাসা থাকে। কে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদি নিয়ে বিনা পারিশ্রমিকের লেখা লিখবে বলুন? মুক্তবুদ্ধির চর্চাই যেখানে উন্মুক্ত নয় সেখানে মানুষ কথা বলতেও যে ভয় পাবে, সেটাই স্বাভাবিক।

এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকার তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিটিরও ক্রমাগত পশ্চাৎপসরণ উল্লেখের দাবি রাখে। দেশের ভেতরে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এই পক্ষটিও মনে করেছে যে, তারা যদি সংখ্যাগুরুর ধর্মকে উচ্চে তুলে ধরতে সক্ষম না হয় তাহলে হয়তো তারা ভোট হারাবে এবং ক্ষমতায় আসতে পারবে না। হয়তো তাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সত্য এবং এদেশের সংখ্যাগুরুর ভোট আসলে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে। কিন্তু তাদের ওপর যে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সেটা কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, বরং চিন্তা ও চেতনায় যারা সংখ্যালঘু, যারা একটু বৃত্তের বাইরে গিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক সংখ্যালঘু, তারাও যে এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিটির ওপর নির্ভরশীল সেটা যেন এই পক্ষটি বেমালুম ভুলে যায় মাঝে মাঝে। তারা আচানক এই সংখ্যালঘুদের ওপর থেকে তাদের ছায়া সরিয়ে নেন এবং দেশের ধর্মভিত্তিক সংখ্যাগুরুর প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন। অথচ, তারা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, এবং কখনও কখনও আমাদের সামনে তার প্রমাণও দেন যে, তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ ও লালন করেন। কিন্তু এই মাঝে মাঝে তাদের স্খলন তা আসলে আমাদের মতো চিন্তার সংখ্যালঘুদের বিপদে ফেলে দেয়।

আমরা জানি যে, এদেশে আক্রান্ত ব্লগারদের সরকার সরাসরি কোনো সমর্থন ও সহযোগিতা না দিলেও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ তাদেরকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ায় সরকারের ভেতরকার অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। সেটি সম্ভব হয়েছে কেবল সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের কারণেই। কিন্তু এটাই সব নয়, নাগরকিকে নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের প্রধান দায় ও দায়িত্ব, তাতে কোনো রকম বিভেদ টানা যাবে না, এটাই যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে বাঙালি মুক্তবুদ্ধির চর্চা অব্যাহত রাখবে কোন ভরসায়?

১৪ ডিসেম্বর এলেই যে কথাটি আমার বার বার মনে হয় তাহলো, পাকিস্তানি সেনা শাসকরা এই দিনটিতে যে ভয়াবহ আতঙ্ক বাঙালির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল তা এখনও বাঙালির মন থেকে দূর হয়নি। দূর না হওয়ার কারণ এখনও এদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীরা আক্রান্ত এবং তাদরেকে সমর্থন, সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী কোনো অবস্থান আমরা দেখি না। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীদের পাশে আছেন, কিন্তু সেটাই সব নয়, তার কাছে দাবি থাকবে তিনি তার ব্যক্তিগত এই মনোভাবকে রাষ্ট্রের আইনে পরিণত করবেন এবং এদেশকে সকল চিন্তাধারার মানুষের জন্য নিরাপদ করে তুলবেন। পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার প্রতিশোধ আসলে এদেশ থেকে পাকিস্তান-মনাদের নির্বংশ করার মধ্য দিয়েই শেষ করতে হবে।
শেখ হাসিনা এতে অত্যন্ত সফল হয়েছেন সেটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু অসমাপ্ত কাজ যেটুকু আছে তাহলো, এদেশকে তিনি মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীদের জন্য নিরাপদ করে দেবেন, একাত্তরের শহীদরা নিজেদের জীবন দিয়ে এই কাজটিই আসলে করতে চেয়েছিলেন এবং শেখ হাসিনা ও তার সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তাদের অসমাপ্ত কাজটি শেষ করবেন বলে আজকে আমরা জোর দাবি তুলছি।

জয় বাংলা। জয় স্বাধীনতা।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।