প্রসঙ্গ : পুনঃ ময়নাতদন্ত
ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী পুনঃ ময়নাতদন্তের সর্বশেষ বলি হল। খবরে প্রকাশ কোর্টের নির্দেশে তার মরদেহ কবর থেকে তোলা হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পুনঃ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০ নভেম্বর রাতে নিজ বাসায় ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ পাওয়া যায়। তারপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তাকে যথারীতি দাফন করা হয়েছিল। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে দিয়াজের মৃত্যু আত্মহত্যাজনিত কারণে হয়েছে প্রকাশিত হলে তার পরিবার সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তাকে হত্যা করে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল দাবি করে আদালতে মামলা করেন। যার ফলশ্রুতিতে আদালত পুনঃ ময়নাতদন্তের আদেশ দেন। এখন দিয়াজের পরিবার একবুক আশা নিয়ে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় থাকবে।
আজ দিয়াজের পুনঃ ময়নাতদন্ত নিয়ে কলম ধরছি। এখানে উল্লেখিত সকল মন্তব্যের দায়ভার আমার নিজের। কাউকে হেয় অথবা শৃঙ্গে উঠানোর লক্ষ্যে নয়। অতীতের অভিজ্ঞতায় ময়নাতদন্তের ব্যাপারে কিছু লেখা হলে তার প্রতিক্রিয়ায় দেশীয় সহকর্মীদের বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনায় মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই কলম ধরা। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের কোনো তদন্তের মানই সন্তোষজনক নয়। তা সে ময়নাতদন্তই হোক বা বিভাগীয় অথবা পুলিশি তদন্তই হোক। অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের ফলাফল নির্ভর করে প্রাথমিক তদন্ত বা সুরতহাল প্রতিবেদনের ওপর।
আলোচ্য দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মরদেহ যদি নিজ বাসার ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাহলে প্রাথমিকভাবেই ধারণা করে নেয়া যায় যে সে আত্মহত্যা করেছে। সেই অর্থে ময়নাতদন্তে বৈসাদৃশ্য কিছু পাওয়া না গেলে আত্মহত্যার প্রতিবেদনে আপত্তির কারণ মোটেও বোধগম্য নয়। দিয়াজের মত সুস্থ সবল একজন যুবককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া কি চাট্টিখানি কথা! বাসার লোকজন অথবা আশপাশের মানুষ এমন ঘটনা টের পাবে না তা কি হতে পারে ! যদি নিজেরা সম্পৃক্ত থাকেন সেটা হবে ভিন্ন কথা। তারা কি সেই স্বীকারোক্তিই দিতে যাচ্ছেন!
একথা সত্যি যে আমাদের দেশের ময়নাতদন্তের মান ভাল নয়। কেন ভাল নয় তা আমার অতীতের বহু লেখায় উল্লেখ করেছি। এ ব্যাপারে কোনো প্রসঙ্গ আসতেই ফরেনসিক বিভাগে নিয়োজিতরা নিজেদের গা বাঁচাতে অভাব অনুযোগের লম্বা তালিকা ধরিয়ে দেন। আমি নিজেও যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলাম তখন একই পন্থায় পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি তবে সেসময় প্রচলিত সুযোগ সুবিধার ব্যবহারে এর মানোন্নয়নে সচেষ্ট থেকেছি। এখন সরকারি সুযোগ সুবিধা বাড়লেও প্রচলিত সুযোগ সুবিধার ব্যবহারে ময়নাতদন্তের কি মানোন্নয়ন হয়েছে সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
আলোচ্য মৃত্যুর ময়নাতদন্তের পূর্বে ময়নাতদন্তকারীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন ময়নাতদন্তের অংশ হিসেবেই বিবেচিত হবে। কেননা এই পরিদর্শনে অনেক না জানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে, যা সাধারণ চোখে দৃশ্যমান নয় অথচ বিজ্ঞ ফরেনসিক প্যাথলজিস্টগণ ঠিকই দেখতে পারেন। যদি তারা তা না করে থাকেন তবে তার দায়ভার তাদের উপরেই বর্তাবে। কোন ধারণার বশবর্তী হয়ে মৃত্যুর কারণ বা ধরন নিয়ে মামলার বাদী আদালতে এসেছেন তা আমার জানা নেই তবে পুনঃ ময়নাতদন্তের ফলাফল প্রায় ক্ষেত্রেই অন্তঃসারশূন্য। প্রথম ময়নাতদন্ত থেকে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের সময়ের ব্যবধান যত বাড়ে, কাঙ্খিত ফলাফল ততই অদৃশ্য হতে থাকে।
২১ নভেন্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর এর ব্যবধান ২০দিন হওয়ায় পচনশীল টিস্যুর কিছু অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। তার ওপর প্রথম ময়নাতদন্তের সময় দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের কথা মাথায় রেখে ভিসেরা সমূহের কিছু অংশ অথবা যে কোন একপাশের ভিসেরার অর্ধাংশ যদি অক্ষত রাখা না হয় তবে ভিসেরাসমূহ সনাক্তই অসম্ভব হয়ে যাবে। সুতরাং সহজেই অনুমেয়, পুনঃময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে আমরা হয়ত পেতে যাচ্ছি “পচন হেতু কোন মতামত দেয়া গেল না”। তবে শক্ত টিস্যু যেমন হাড়ের কোন জখম যদি থাকে তবে তা এখনও পাওয়া যাবে। আর যদি পাওয়া যায়ই তবে প্রথম ময়নাতদন্তে তা কেন পাওয়া গেল না সে প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে। পাশাপাশি শক্ত টিস্যুর মৃত্যুপূর্ব জখমের ক্ষেত্রে পরিবার বা আশেপাশের মানুষদের সম্পৃক্ততা এড়ানোর কোন উপায় থাকবে না। পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের হালিশহরে নিজ বাসায় মারা যান নওগাঁর বিচারক কাজী আব্দুল হাসিব। প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা উল্লেখ করা হলে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে সেটিকে হত্যা স্বীকার করে নেয়া হয়।
২০১৬ এর ২৬ আগস্ট চট্টগ্রামের বায়েজিদে জনৈকা খোদিজা আখতারের ময়নাতদন্তে আত্মহত্যা উল্লেখ করা হলেও তার হত্যাকারী আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করে। ২০১৪ সালে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল রাউজানের গৃহবধূ রীমা হত্যায়। ভুল হতেই পারে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভুল বিদেশেও পাওয়া যায়। তবে তা খুবই সীমিত। তবে সেখানে আমাদের দেশের মত মৃত্যুর কারণ বা ধরন পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। একবার জাপানে বিশ্বের খুব নামী এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে শল্য চিকিৎসায় প্লীহা অপসারণের তিন মাস পর “প্লীহা স্বাস্থ্যবান” লিখা থাকায় এক হুলস্থূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। পরে খবরের কাগজে ক্ষমা চেয়ে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিব্রতকর ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। বাংলাদেশে ভুল প্রতিবেদনের পর কেউ কোনদিন ক্ষমা চেয়েছেন তা কি ভাবা যায়?
দেশের প্রচলিত আইনে ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে শাস্তির বিধান থাকলেও অদ্যাবধি কোন ডাক্তার বিভাগীয় তিরস্কার আর বেতনক্রম অবনমন ছাড়া অন্য কোন শাস্তি পেয়েছেন বলে শোনা যায় নি। বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের শাস্তি পেতে একজন ডাক্তার অবসরে যাওয়ার সময় পেয়ে যান। প্রথম ময়নাতদন্ত দলের দলনেতা ছিলেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের একজন অধ্যাপক। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত দলের দলনেতাও যে ন্যূনতম একজন অধ্যাপক হবেন তা বলাই বাহুল্য। জানা যায়, যেখানে পুনঃ ময়নাতদন্তের হতে যাচ্ছে সেখানে অধ্যাপকের পদ থাকলেও তা অদ্যাবধি খালি। এমতাবস্থায়, এখানে কৃত পুনঃ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন কি গ্রহণযোগ্য হবে? হাসিব, খোদিজা, রীমা, সুতপা, তনু, মিতু, দিয়াজ যুগে যুগে আসছে আর বাংলাদেশের মেডিকোলিগাল অব্যবস্থাপনার দৈন্যতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিচ্ছে। ২/৪ দিন হৈচৈ তারপর যা ছিল তাই। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বিচার প্রার্থীরা অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিচারের আশায় থাকছেন।
আসলে কলমের ধার বা শক্তি ধীরে ধীরে কমে গেছে। বহুবার কলম ধরেছি দেশের মেডিকোলিগাল ব্যবস্থার উন্নতির দাবিতে। বলেছি এর উন্নতি মানে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা। উন্নত বিশ্বে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকছে তা কোন জাদু বলে নয়, তা স্রেফ মেডিকোলিগাল ব্যবস্থার উন্নতি আর যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে। আজ অস্বস্তিকর যেসব পরিস্থিতি আমাদের সামনে আসছে তা অভিজ্ঞতা নির্ভর ময়নাতদন্তের কুফল। যতদিন না বিজ্ঞান নির্ভর ময়নাতদন্ত চালু হবে ততদিন ফরেনসিক প্রতিবেদনে গড়মিল থাকবেই। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞগণ। আর তাই বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরেনসিক বিভাগ খুলে সেখানে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা যত তাড়াতাড়ি করা যাবে সেটাই মঙ্গলকর।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ ও সিনিয়র ফরেনসিক কন্সাল্ট্যান্ট, ইউনিভারসিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া। [email protected]
এইচআর/পিআর