মনোজগতে সামরিকতন্ত্র


প্রকাশিত: ০৫:৪৭ এএম, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

দু’টি স্থানীয় সরকার নির্বাচন সামনে। জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা আগ্রহ নেই। কারণ এখানে খেলোয়াড় বলতে গেলে একা শাসক দলই। নিজেদের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের হিংসা আর বিদ্বেষের খবরই বেশি।

মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে আছে নারায়নগঞ্জ সিটি নির্বাচন। ভোট গ্রহণ হবে আগামী ২২ ডিসেম্বর। প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ আর বিএনপি, ছাড়াও আরও দলের বা নির্দলীয় প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিএনপি শুরু থেকেই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করে আসছে।

আমরা যখন এই আলোচনা করছি, তখন পাশের দেশ ভারতেও সেনাবাহিনী নিয়ে কিছু আলোচনা চলেছে রাজনৈতিক মহলে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মহাসড়কে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। এর জবাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিক্কর মমতাকে লেখা এক চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছেন কেন তিনি সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে টানছেন?

এ প্রশ্ন এখানেও যে, কেন কথায় কথায় কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীকে ব্যারাক থেকে বাইরে আনতে চায়? সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন একটি স্থানীয় নির্বাচন। এর আগে ২০১১ সালে নির্বাচন হয়েছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী সে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। পুলিশ ও র‌্যাবের শক্ত অবস্থানের কারণে সেই নির্বাচনে বড় কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠেনি। এবারের নির্বাচনে বিএনপি শুরু থেকেই এমন দবি করার কারণ বোধগম্য নয়। কারণ যাকে নিয়ে ভয় সেই শামীম ওসমানও এবার প্রার্থী নন। তবুও এমন দাবি উঠায় একটু বিস্মিত হতে হয় বৈ কি।

যেকোনো নির্বাচনের সময় সেনা নিয়োগের বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। আর এ নিয়োগের দাবি জানায় সাধারণত বিরোধী পক্ষ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি দলের লোকেরাও নির্বাচনে সেনা নিয়োগের দাবি জানায়, তেমন নজিরও আছে। এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বেসামরিকভাবে দেশ চালাতে চাইলেও বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের ওপর আসলে তাদের নিজেদেরই আস্থা নেই? কারণ কি এই যে বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে? নাকি যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তাদের প্রভাবের কারণেই সাধারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করতে পারেনা? সবাই এক বাক্যে বলবেন শেষের প্রশ্নটিই আসলে উত্তর।

বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পুলিশবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোতে যেভাবে রাজনীতিকরণ হয়েছে তাতে তাদের ওপর দেশের মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে নির্বাচনে পুলিশবাহিনী দায়িত্বে থাকলে নানা ধরনের অনিয়ম ও কারচুপির শতভাগ সম্ভাবনা থেকে যায়। বিএনপি এমন অভিযোগ করলে তার দোষ নিজের ওপরও বর্তায়। এই দলটি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও এই দলীয়করণ ও রাজনীতিকীকরণের অভিযোগ ছিল। প্রায় প্রতিটি পেশাজীবী সংগঠনকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেই দলীয় ভিত্তিতে সংগঠিত হতে উৎসাহিত করা হয়েছে কোনো কোনো ভবন আর ক্ষমতার শীর্ষ মহল থেকে।

তাই আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তার দায় বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে নিতে হবে। আমরা মুখে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিৎকার করবো, কিন্তু বেসামরিক প্রশাসনকে দলবাজ ও অদক্ষ করে তুলবো। আর প্রয়োজন হলেই সেনাবাহিনীকে দিয়ে সেই কাজ করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো, এই যদি মানসিকতা, তাহলে গণতন্ত্র কখনোই এখানে শক্তভিত্তির উপর দাঁড়াবেনা।

শুধু তা-ই নয়, যে কারণে নির্বাচন এলে সেনা মোতায়েনের দাবি উঠে তার কারণও রাজনৈতিক দলগুলোই। সন্ত্রাস আর পেশিশক্তির জোরে ভোটকেন্দ্র আর ভোটের বাক্স দখলের সংস্কৃতি এদের প্রত্যেকের ভেতরে। নির্বাচন বর্জনের নামে সহিংস প্রতিরোধ ও শত শত স্কুল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়। ক্ষমতার লোভে, বাচ্চাদের স্কুল পুড়িয়ে দিতে পারে যারা তারা কতটা মানুষের ক্ষমতায়নে, কতটা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।
 
২০১১ সালের নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী চেয়েছিল তখনকার নির্বাচন কমিশন। সরকার দেয়নি। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছিল মানুষের চেয়ে বড় শক্তি আর কিছু নেই। ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে এসে  সব রক্ষচক্ষু ও হুমকি ধামকিকে পরাভূত করে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করেছিল।

জনগণ চাইলে সঠিক ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের আস্থা নেই সেই জনগণের ওপর। সরকার কিংবা শাসক দল যতই চেষ্টা করুক, যদি জনগণ চায় তাহলে কোনো যোগ্য প্রার্থীর বিজয়ই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু শুধু মসনদের জন্য জ্বালাও পোড়াও করে, জনগণের ওপর আগুন ছুঁড়ে দিয়ে, তাদের সম্পদ ধ্বংস করে তাদের হওয়া যায় না।

সব আশঙ্কাকে পিছে ফেলে ভোটাররাই প্রমাণ করতে পারে যে, জনগণ চাইলে সঠিকভাবে নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য যে গণমুখি রাজনীতি দরকার, তার অভাব স্পষ্ট। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের দেশের ক্ষমতাকাঠামোয় সরকারের ভূমিকা প্রবল পরাক্রমশালী। কিন্তু সবকিছুতে সেনাবাহিনী ডাকার মানসিকতা প্রমাণ করে রাজনীতির মনোজগতে সামরিকতন্ত্রের ভূত এখনও খুব শক্তিশালী।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।