থেমে গেল মন খারাপের গাড়ি


প্রকাশিত: ০৫:০৩ এএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬

সম্ভবত বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। ভোর ৬টায় শাকিল ভাইয়ের ফোন। চমকে গেলাম। এত সকালে তো তার ঘুম ভাঙার কথা নয়। ফোন ধরতেই বললেন, এইমাত্র একটা কবিতা লিখেছি। শোন। তারপর আবৃত্তি করে গেলেন। ঘুম ভেঙে হতচকিত আমি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে শুনলাম। কবিতাটি মনে নেই। এটুকু মনে আছে, বেগম মুজিবকে নিয়ে লেখা। কবিতা শোনার পর বললাম, এত ভোরে আপনার ঘুম ভাঙলো কেন? বললেন, আমি তো ঘুমাইনি রে। রাত জেগে কবিতা লিখেছি। এখন ঘুমাবো। এই হলো মাহবুবুল হক শাকিল। এলোমেলো, বাউণ্ডুলে, চূড়ান্ত বোহেমিয়ান, উড়নচণ্ডি, আউলা বাউল, ঘোর লাগা, আবেগে ভেসে যাওয়া, তুমুল প্রেমিক, আপোসহীন বিপ্লবী, কবিতায় পাওয়া, প্রচণ্ড মন খারাপ করা, উন্মাতাল মন ভালো করা, জীবনকে কানায় কানায় যাপন করা একজন মানুষ।

২২/২৩ বছরের সম্পর্ক। কত স্মৃতি, কত গান, কত কবিতা, ঝগড়া, মান-অভিমান- কোনটা ফেলে কোনটা বলবো। গভীর রাতে ফোন করে হু হু কান্না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তাকে কাঁদার সুযোগ দেই। তারপর জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে? তরল গলায় জবাব আসে, ব্রাদার আই লাভ ইউ। বললাম, জানি তো। জবাব আসে, কতটা ভালোবাসি জানিস না। আড়ষ্টতায় কখনো বলা হয়নি, তাকে কতটা ভালোবাসি। আমার হৃদয় জানে, তাকে কতটা ভালোবাসি। এতটা যে ভালোবাসি, আগে বুঝি টেরই পাইনি। কখনো তুই করে, রেগে গেলে তুমি করে বলতেন। একবার কোনো একটা নিউজ দিলেন। আমি তখন গাড়ি চালাচ্ছিলাম। দিতে দেরি হলো। ক্ষেপে গেলেন। আবার ফোন করে গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি কাল থেকে আর ফোন পাবে না। শুনে আমি হাসি। আমি জানি, তার ভালোবাসা যত তীব্র, অভিমান ততই ক্ষণস্থায়ী। শিউলির মত রাতের অভিমান সকালেই ঝরে যাবে। হয়তো পরদিন দুপুরেই ফোন করলেন, তুই কই? অফিসে। এক্ষুণি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলে আয়। জরুরি কিছু ভেবে কাজটাজ ফেলে ছুটে যাই। হায়, কেরানীগঞ্জ থেকে একজন অনেক খাবার এনেছে। একা খাবেন না। তাই জরুরি তলব। একা কখনোই খেতেন না। কিছুই না। সবসময় হইচই, তুমুল আড্ডা, দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়া। অথচ এই তুমুল জীবনের পাশে খুব নিরবে শুয়ে থাকতো প্রবল বিষাদ। মৃত্যু নিয়ে মজা করার বিরল সাহস ছিল তার। তার মৃত্যুর পর কী হবে, দিয়ে গেছেন তার কাব্যিক বিবরণ ‘আমি চলে যাবার পর পৃথিবীর আর কোনো ভাবান্তর দেখি না।’ কিন্তু এটা ঠিক নয়। তার মৃত্যু বদলে দিয়েছে অনেককিছু। তিনি দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই, তার শোকে কত হাজার মানুষ কাঁদছে।’ জীবন নিয়ে মজা করতেন, মজা করতেন মৃত্যু নিয়েও। মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে সামদাদোতে নিজের চেহলাম পালন করেছিলেন রীতিমত আয়োজন করে।

আমি জানি, এই লেখাটা অন্য কাউকে নিয়ে লিখলে শাকিল ভাই ফোন করে বলতেন, ভালো লিখেছিস। এই যেমন, কদিন আগে সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে আমার লেখায় শাকিল ভাই মন্তব্য করেছিলেন, গুড ওয়ান। এই লেখালেখি নিয়ে তার সাথে আমার মজার সব অম্লমধুর স্মৃতি আছে। প্রথমে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব। পরে হলেন বিশেষ সহকারী। কিন্তু সাংবাদিকদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল পেশাদারিত্বের বাইরে, তুমুল সে সম্পর্ক। তার কাছ থেকেই আমি শিখেছি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ধারণা। ফেসবুকে তার স্ট্যাটাসেও অনেকে কঠোর সমালোচনা করতো। কেউ কিছু বললে উনি বরং থামাতেন, থাক না, তার কথা সে বলেছে। একবার আমার এক লেখায় সরকারের তীব্র সমালোচনা ছিল। তিনি ফেসবুকে মন্তব্য করলেন, আমি কিন্তু দেখেছি। আমি রাগানোর জন্য বললাম, হুমকি দিচ্ছেন নাকি? হাসতেন, বাইচ্যা গেছস, তুই আমার বইন বিয়া করছস। ছাত্র রাজনীতি করার সময় অনেকবার কুমিল্লায় আমার স্ত্রী মুক্তির বাসায় গেছেন। সেই সুবাদে মুক্তিকে বোনের মতই ¯স্নেহ করতেন। আর আমার ছেলে প্রসূনকে দিতেন প্রশ্রয়। ফারজানা রূপা আর শাকিল আহমেদের মেয়ে মনফুলের জন্মদিনে প্রসূনকে দেখে পাশে দাঁড় করিয়ে মাপলেন, লম্বায় তাকে কতটা ছাড়িয়েছে। তারপর বললেন, বুক ফুলাইয়া চলবি। কেউ কিছু বললে বলবি, আমার মামা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী। তারপর খাবার টেবিলে নিজের খাওয়া শেষ হওয়ার পরও ১৫ মিনিট ধরে প্রসূনকে তুলে তুলে খাওয়ালেন। মানুষকে ¯স্নেহে, ভালোবাসায়, প্রেমে ভাসিয়ে দেয়ার মত এমন ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই আছে। শুধু লেখায় নয়, সামনাসামনিও তার সাথে সরকারের বিরোধিতা করা যেতো, তর্ক করা যেতো। শুধু বঙ্গবন্ধু আর বড় আপা, ছোট আপা ছাড়া। বড় আপা মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি পীর মানতেন। তিনি দলীয় পদ চাইতেন না, ক্ষমতা চাইতেন না; চাইতেন শুধু পীরের পায়ের কাছে বসে থাকার সুযোগ। শেখ হাসিনার সাথে, আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্কটা সাংগঠনিক নয়, ছিল আবেগের। আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতাকে দেখেছি, প্রত্যাশিত পদ না পেলে বা কোনো কারণে নিজেকে বঞ্চিত মনে করলে দল এমনকি দলীয় সভানেত্রীর বিরুদ্ধেও অনেক কটু কথা বলতেন বা বলেন। কিন্তু শাকিল ভাইয়ের মুখে কখনো তেমন কিছু শুনিনি। সৈয়দ আশরাফ স্থানীয় সরকার মন্ত্রী থেকে বাদ পড়ার পর শাকিল ভাইয়ের শিশুর মত কান্না দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। হাইব্রিড আর ধান্দাবাজদের এই সময়ে দলের প্রতি, নেতার প্রতি এমন ভালোবাসা অবিশ্বাস্যই মনে হয়।

mahamulআটবছর ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রে। অনেক হম্বিতম্বি করতেন। সাধারণের উপকারে ক্ষমতার ব্যবহার করতেন। কিন্তু অপব্যবহার করতে দেখিনি কখনো। সবসময় জোর গলায় বলতেন, আমার বিরুদ্ধে অনেক বদনাম করা যাবে। কিন্তু অসততা বা দুর্নীতির কোনো অভিযোগ কেউ আনতে পারবে না। আমি জানি এটা সত্যি। সংসার খরচ নিয়ে ভাবির সাথে ঝগড়া করে ফেসবুকে মজার স্ট্যাটাস দিয়েছেন। পরে ভাবিও বলেছেন, ‘বলেন তো সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ঠিকমত সংসার খরচ দেয় না। কাহাতক সহ্য করা যায়।’ অর্থকষ্ট নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শুধু প্রেম বিরহের কষ্ট নয়, অনেক সময় অর্থকষ্টও কবিতা লিখিয়ে নিতে পারে।’ অর্থকষ্ট ছিল। কিন্তু তার সাথে আড্ডায় বসে কেউ কখনো বিল দিতে পারেনি। আড্ডা থেকে বেরুতেন পকেট খালি করে। একবার শেরাটন থেকে আড্ডা দিয়ে বেরুনোর সময় সেখানকার স্যুভেনির শপ থেকে একটা শিল্পকর্ম প্যাক করে বললেন, ‘আমার বইনরে দিস।’ বাধা দিতে গিয়ে ধমক খেয়েছি। তার উপহারটি এখনও আমার ড্রইং রুমে শোভা পাচ্ছে। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্থকষ্টে ঢাকার বাসা ছেড়ে বসিলায় বাসা নিয়েছেন। অথচ আমি জানি শাকিল ভাইয়ের একটু ইশারায় মিটে যেতে পারতো সেই বন্ধুর সমস্যা। কয়েকদিন আগে অসুস্থতার জন্য বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার প্রশ্ন আসলে জানা গেল, তার একাউন্টে ৩০ হাজার টাকা আছে। মানুষের জন্য করেছেন উদারভাবে। অথচ নিজের জন্য কিছুই করেননি, আসলে করার চেষ্টাও করেননি। এইসব জাগতিক, বৈষয়িক ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করতো না কখনোই। হেলাল হাফিজের চোখের চিকিৎসা করতে হবে। শাকিল আছে। কবি শহীদ কাদরীর মরদেহ দেশে আনতে হবে। শাকিল আছে। হযরত বিনয় ভদ্র নামে একজন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ‘আমাদের মত আম পাবলিকদের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছানোর উপায় চিরতরে হারিয়ে গেল।’ সত্যি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের সেতুবন্ধন ছিলেন মাহবুবুল হক শাকিল।

এই পর্যন্ত পড়ে আপনাদের মনে হতে পারে শাকিল ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক বুঝি খুব ভালো ছিল। আর আমি বুঝি সেটাই জাহির করার চেষ্টা করছি। আমিও এতদিন তাই ভাবতাম। কিন্তু সেদিন সামদাদো, রাতে তার বাসা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাযায় গিয়ে আর গত দুদিন ধরে ফেসবুকে হাহাকার দেখে আমার সে ধারণা প্রবল ধাক্কা খেয়েছে। শুধু আমি নয়, হাজার হাজার মানুষের সাথে তার এমন সম্পর্ক ছিল। সবাই ভাবছে, তার সাথেই বুঝি সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক। বিস্ময়কর! আমরা একটা দুটো সার্কেল মেইনটেইন করতেই হিমশিম খেয়ে যাই। কিন্তু শাকিল ভাইয়ের যে কত সার্কেল, তার ইয়ত্তা নেই। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, ডাক্তার, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, প্রকাশক, ফেসবুকার, গণজাগরণ মঞ্চ, বøগার, সিনিয়র, জুনিয়র সবার সাথে তার সমান সম্পর্ক। তাই তো তার মৃত্যুর খবর পেয়ে যেমন ছুটে আসেন ড. আনিসুজ্জামান, ড. শামসুজ্জামান খান, রামেন্দু মজুমদারের মত প্রবীণরা; তেমনি কান্নায় ভেঙে পড়েন কলেজপড়ুয়া কোনো তরুণ। আমরা অপ্রয়োজনে কাউকে ফোন করি না। এত ব্যস্ততা, এত উড়নচণ্ডি জীবনের পরও শাকিল ভাই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নিয়ম করে সবাইকে ফোন করতেন, হুটহাট ডেকে পাঠাতেন। মনে করে করে কার কবে জন্মদিন, কার কবে বিয়ে বার্ষিকী খোঁজ রাখতেন, উইশ করতেন; গভীর রাতে ফুল নিয়ে গিয়ে চমকে দিতেন। এ শুধু পেশার প্রয়োজনে নয়। এ হলো ভালোবাসা, আবেগ। প্রায় পঞ্চাশের একজন মানুষের হৃদয়ে আবেগের এমন থরো থরো ঢেউ চমকে দেয় আমাদের।

কদিন আগে তার এক কাছের মানুষ বলছিলেন, শাকিলকে আমি ইর্ষা করি। একটা মানুষ যা ইচ্ছা, তাই করে গেল জীবনভর। কোনো লুকোছাপা ছাড়া। এটা ইর্ষা করারই মত। পরে ভেবে দেখেছি, সত্যিই তো, ইর্ষা করার মতই জীবন। অনেক রাজনীতিবিদ আড়ালে আবডালে অনেক কিছু করেন। কিন্তু প্রকাশ্যে ধোয়া তুলসি পাতা। মুখে মধু, অন্তরে বিষ। কিন্তু শাকিল ভাই, একদম অকপট। যা করতেন, তা সবাই জানতো। কিছুই লুকানো নেই। ঝগড়া, তর্ক, যুদ্ধ সব সামনাসামনি। জানাজার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে বন্ধু জ ই মামুনও বলছিল ঠিক এই কথাটাই, আমরা সবাই শাকিলের মত হতে চাইবো। তাকে ইর্ষা করবো। কিন্তু কখনোই শাকিল হতে পারবো না। মোজাম্মেল বাবু ভাই বলছিলেন, আমরা সবাই কেরানি। আমাদের টেবিলে অনেক ফাইল, ছেলের ভবিষ্যৎ, মেয়ের বিয়ে, পদ-পদবী, ক্ষমতা, ব্যবসা। কিন্তু আমাদের মধ্যে শাকিলই একমাত্র অফিসার। সবসময় টেবিল পরিস্কার, কোনো জমানো ফাইল নেই, কোনো পিছুটান নেই।

ফেসবুকে কেউ কেউ লিখেছেন, মৃত্যুর পর শাকিলকে নায়ক বানানোর চেষ্টা চলছে, অতিমানব বানানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু তিনি নায়ক ছিলেন বটে, তবে অতিমানব নন। তিনি নিছকই একজন মানবিক কোমল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। পোস্টমর্টেমের পর ডাক্তার বলেছেন, তার হৃদপিন্ড স্বাভাবিকের চেয়ে বড় ছিল। এটা জানার জন্য ডাক্তার হতে হয় না। তার বন্ধুরা সবাই সেটা অনেক আগেই জানতো। তার অনেক অভ্যাস-বদভ্যাস নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, হবে। তার অভ্যাস বা বদভ্যাসগুলোও তার মতই। তার ভালো-মন্দত্ব নিয়ে আপনি তর্ক করতে পারেন। কিন্তু বদলাতে পারবেন না। তার বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ, এমন অভিযোগ আছে আরো অনেকের বিরুদ্ধে। কিন্তু কারো তা স্বীকার করার সাহস নেই। শাকিল ভাইয়ের সেই সাহস ছিল। আমাদের মানদণ্ডে হয়তো তার অনেককিছুই ভালো ছিল না। কিন্তু তার ভালোত্ব-মন্দত্বের মাপকাঠি তিনি নিজেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। আমাদের সাথে সেগুলো মেলে না। তার প্রধান বদনাম, তিনি প্রেম করতেন, মানুষকে ভালোবাসতেন। ঘৃণা তো করতেন না। শাকিল ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই আমার স্ত্রী মুক্তি কাঁদছে। মাঝে মধ্যে ক্ষেপে যাচ্ছে, শাকিল ভাই এটা কী করলেন। মউপির কথাও ভাবলেন না। আরেকটু নিয়ম মেনে চললে তো তার জীবনটা অনেক লম্বা হতে পারতো। কিন্তু শাকিলরা তো আমাদের মত ছাপোষা মানুষ নয়। জীবন লম্বা হওয়ার চেয়ে হয়তো বড় হওয়াটাই তার কাছে কাঙ্ক্ষিত। শাকিল ৪৮ বছরে যা করেছেন, অনেকে ৪৮০ বছরেও তা করতে পারবেন না; চাইলেও সম্ভব না। জীবন যেমন উপভোগ করেছেন, তেমনি উপভোগ করেছেন মৃত্যুটাও। কবি আবুল হাসান, কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী, সাংবাদিক মিনার মাহমুদদের মতই মাহবুবুল হক শাকিল।  এ ঘরানার মানুষদের দেখলে, তাদের মৃত্যু দেখলে আমি জীবনানন্দে আশ্রয় খুঁজি-
‘জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে...’
শাকিলদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করা বিপন্ন বিস্ময়টা আমরা সাধারণ মানুষরা ধরতে পারি না বলেই আমরা বিস্মিত হই, ক্ষুব্ধ হই।

অনেককিছু লিখলাম। কিন্তু মাহবুবুল হক শাকিল আসলে কী ছিলেন? তার স্ট্যাটাসই ধার নেই ‘মূলত আমি কেউ না; না রাজনীতিবিদ, না কবি, না গল্পকার, এমনকি নই তুমুল সংসারী। এক অভিশপ্ত চরিত্র যার কিছুই থাকতে নেই। সাধু কিংবা সন্ত নই, চোখ জ্বলজ্বল করে জীবনের লোভে। চন্দ্রাহত, বিষাদ এবং ভূতগ্রস্ত, বসে থাকি ব্রহ্মপুত্র ঘাটে, শেষ খেয়ার অপেক্ষায়...’। আমার বিবেচনায় তিনি মূলত কবি, আগাপাশতলা কবি; ভাবনা-চিন্তায়, মননে, আচরণে, আবেগে। তিনি নেতা হতে চাননি, এমপি হতে চাননি, মন্ত্রী হতে চাননি; তিনি কবিই হতে চেয়েছিলেন। সংসার খরচ নিয়ে ভাবির সাথে ঝগড়া প্রসঙ্গে দেয়া স্ট্যাটাসে শাকিল ভাই লিখেছিলেন, ভাবি নাকি তাকে বলেছে, ‘তুমি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বলেই মানুষ তোমার কবিতা পড়ে। নইলে ছাগলেও পড়তো না।’ পরে আমি ভাবিকে বলেছি, তুমি রেগে গেছো বলে উল্টাপাল্টা বলেছো, ভুল বলেছো।

শাকিল ভাই মূলত কবি। তার সব কবিতা হয়তো মানোত্তীর্ণ নয়। কিন্তু তার পুরো অস্তিত্বটাই ছিল কাব্যিক। তার অনেক ভালো কবিতাও আছে। একজন ভালো কবির মধ্যে যে নিখাদ বিশুদ্ধ আবেগ থাকা দরকার, তা তার মধ্যে ছিল উপচেপড়া। হয়তো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী না হলে বই বিক্রি কিছু কম হতো। কিন্তু তাতে তার কাব্য প্রতিভার কমতি হতো না। কয়েকদিন আগে টেলিফোনে বলছিলেন, আমি সবকিছু থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি। খালি লেখালেখি করবো। আসলেই লেখালেখির নেশাটা ভালোই পেয়েছিল তাকে। গত দুবছর দুটি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। সামনের মেলায় করার কথা ছিল ছোট গল্পের বই। গল্প লিখছিলেন। বইমেলায় তার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের তারিখ ঠিক করা হয়ে গেছে। তার কবিতা আবৃত্তি করেছেন আসাদুজ্জামান নূর, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় আর শিমুল মোস্তফা। ‘রাতের এপিটাফ’ শিরোনামের সে অ্যালবামের প্রকাশনা হওয়ার কথা ছিল ২০ ডিসেম্বর, তার জন্মদিনে। সব আয়োজন, সব ভালোবাসা পায়ে দলে চলে গেলেন অবলীলায়, অবেলায়।

এত এলোমেলো জীবনযাপনের পরও কখন লিখতেন, কখন পড়তেন; আমি অবাক হয়ে ভাবি। তার পড়ার জগতও বিস্তৃত। তার বেডরুম ঠাসা বইয়ে। কোনো আড্ডায় কবিতার নেশায় পেয়ে গেলে স্মৃতি থেকে একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। লেখালেখির নেশায় পাওয়া এমন একজন সৃষ্টিশীল মানুষের এমন অকাল মৃত্যু আসলেই বেদনার্ত করে সবাইকে।

শাকিলরা আসলে এমনই। উদ্দাম জীবনের পাশে শুয়ে থাকে গভীর বিষাদ। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা লেখা শেষ কবিতায়ও লিখেছেন মৃত্যুর কথা ‘মৃতদের কান্নার কোনো শব্দ থাকে না, থাকতে নেই/নেই কোনো ভাষা, কবরের কোনো ভাষা নেই/হতভাগ্য সে মরে যায় অকস্মাৎ বুকে নিয়ে স্মৃতি/তোমাদের উত্তপ্ত সৃষ্টিমুখর রাতে।’

এবারের মেলায় প্রকাশিত তার দ্বিতীয় কবিতার বইয়ের নাম ‘মন খারাপের গাড়ি’। জানাজা শেষে যখন তাকে (শাকিল ভাই লিখেছিলেন মরার পর তাকে যেন লাশ বলা না হয়) নিয়ে গাড়ি তার প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে যাচ্ছিল তার প্রিয় ময়মসসিংহের দিকে, ব্রহ্মপুত্রের শেষ খেয়ার দিকে, হাজারো মানুষ তখন বিষাদে আচ্ছন্ন। কে জানতো মাত্র ৪৮এ সবাইকে বিষণ্ণ করে মন খারাপের গাড়ি থেমে যাবে শেষ গন্তব্যে।

কাজী নজরুল লিখেছিলেন ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে..’। কবি মাহবুবুল হক শাকিল লিখেছেন, ‘আমার না থাকা জুড়ে থাকবো আরো বেশি আমি...।’ নিশ্চয়ই কবিরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। নইলে তিনি কিভাবে জানলেন, তিনি তার না থাকা জুড়ে থাকবেন আরো বেশি করে, আমাদের সবার হৃদয়জুড়ে।

[email protected]

Provash

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।