মা তুলে গালাগাল : পুরুষের মানসিক বিকার


প্রকাশিত: ০৩:৪৯ এএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬

পুরুষাধিপত্য ও নারীর ওপর পীড়নের আর এক নাম গালাগাল। বিষয়টি অনেকটা মৌখিক ধর্ষণের মত, যা উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল শ্রেণির পুরুষের মধ্যেই কম বেশি লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এ ক্ষমতাটুকু নারীকে হেয় করার জন্য পুরুষ আজীবন উপভোগ করে আসছে।

পুরুষরা যখন নারীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয় তখন নারীর ওপর অশ্লীল বাক্য ছুঁড়ে দিয়ে নিজেকে নিরাপদ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায়ই থাকে না। কিন্তু নারীরা এই অবস্থার জন্য কোনোভাবে দায়ী না হয়েও যুগ যুগ ধরে এই করুণ বিপর্যয়ের শিকার হয়ে আসছে। নিজের ব্যর্থতার ভার নারীর ওপর চাপিয়ে, তাদের ব্যর্থতার গ্লানি, দুর্বলতা ঢাকার সুযোগ সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগায় পুরুষ। একটি কাল্পনিক অপরাধ নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে পুরুষ নিজেকে নিষ্কলুষ প্রমাণের ব্যর্থ হিংসাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। নিক্ষেপিত গালাগাল ছাড়া পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের আর কোনো পথ থাকে না।

গালাগাল রেগে যাওয়া পুরুষের মানসিক বিকার। পুরুষতন্ত্রের অনৈতিক সুবিধায় লালিত পালিত হওয়ার একটি জটিল মনস্তাত্বিক অবস্থা। যে অবস্থায় মনের সাথে সাথে তাদের দৈহিক অবস্থারও ব্যাপক পরিবর্তন হতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে গালাগালের সময়ে পুরুষরা নারীর ওপর ব্যভিচারের অভিযোগ চাপিয়ে দেয়। সমাজে ব্যভিচার নিষিদ্ধ, অশ্লীল এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে এ জাতীয় গালাগাল দিয়ে নারীদের ঘায়েল করা খুব সহজ হয় তাদের জন্য। ক্ষমতাশীল এবং সুবিধাপ্রাপ্ত পুরুষদের দ্বারা ক্ষমতাহীন নারীদের গালাগাল ও চরিত্র হরণের এই সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের পুরুষতন্ত্রেরই একটি হীনম্মন্য সংস্কৃতি। নারীকে অপমান, নীচ এবং লজ্জাজনক পণ্য হিসেবে ভাবিয়ে তুলতে তাই নির্মমভাবে তুচ্ছজ্ঞান করার সকল ধরনের চেষ্টাই তারা করে। তবে গালাগাল অনেকটাই একটি কাল্পনিক হুমকি যার উদ্দেশ্যটিই হচ্ছে নারীকে হীনজ্ঞান করে নিজে বড় হতে চাওয়া। বিশেষ করে এই অশ্লীল আনন্দের মূলে রয়েছে নারীর চরিত্র হনন।

ঘায়েল করার জন্য গর্ভধারিণী মাকে উদ্দেশ্য করে গালি দেয়া পুরুষতন্ত্রের এক চিরায়ত রূপ। গালাগালের সময়ে পুরুষের হিতাহিত জ্ঞান এতোটাই লোপ পায় যে তারা বুঝতেও পারেনা প্রতিপক্ষের মাকে গালি দেয়া মানে প্রকারান্তরে নিজের মাকেই গালি দেয়া। গালাগাল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পেশিশক্তি ও সন্ত্রাসবাদের এক ধরনের নেতিবাচক অভিব্যক্তি। এই পেশি শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েই একটি শিশু সমাজে বড় হতে থাকে। সেই সুবিধা ও শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় যখন আঘাত লাগে তখন তারা সেটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। আর ঠিক এ অবস্থায় পুরুষরা অন্য কাউকে নয়, অপর পক্ষের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা মায়ের চরিত্রকে হনন করে গালাগাল দিতে থাকে। তারা মনে করে এই দুর্বল জায়গায় আঘাত করলেই পুরুষের পৌরুষত্ব বেঁচে যায়।

এ অবস্থায় অন্যের মাকে হেয় করার মাধ্যমে নিজেকে নগ্ন করা ছাড়া জিতে যাওয়ার আর কোনো কৌশলই তাদের জন্য থাকে না। যেন বিষয়টি এমন যে, প্রতিপক্ষ নারী হোক আর পুরুষই হোক গালিটি দিতে হবে কিন্তু ঠিক কারো মাকেই। কারণ মা ব্যতীত অন্য কাউকে গালি দিয়ে যেন মনের সন্তুষ্টি অর্জন হয় না পুরুষের। তাই মাকে বিভিন্ন বিশেষণ যুক্ত করে ম, খ, চ, বর্গের বর্ণ দিয়ে ধরনের জঘন্য গালি দিতে হয় ।

গর্ভধারিণী মাকে অপদস্ত করতে পারলেই যেন ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করা তাদের সহজ হয়। হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা ক্ষোভের আগুন আর উত্তেজনা তখন যেন খুব সহজেই নেভানো সম্ভব হয়ে যায়। এ সমস্ত গালির পুংলিঙ্গের সংস্করণ অভিধানে কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু মাকেই নয়, সাথে সাথে আশেপাশের আরও নারী চরিত্রকে কলুষিত করা চরম উপশমের জন্য ব্যবহার করা হয়। হিন্দিতে ‘বেহেন’ শব্দটি যোগ করলে পুরুষের যেন চরম পুলক জাগে। কখনো কখনো আরবি ভাষা যোগ দিতে পারলে যেন ভিন্নরকম এক শিহরণ জাগে।

মৌখিক অপভাষার সাথে কখন কখনো শারীরিক অঙ্গভঙ্গিও অনেকের যুক্ত হয়ে যায়। আর ইংরেজিতে ‘মাদার …’ না বললে কোনোভাবেই বোঝা যাবে না যে তাদের ইউরোপ আমেরিকা ভ্রমণের যোগ্যতা আছে! এখানে নারী, নারীর দ্বারা এসব গালাগালের প্রতিক্রিয়া হয় খুব কম, কারণ এই ক্রোধের অধিকারী একান্তভাবেই পুরুষের। কারণ স্রষ্টার কাছ থেকে তাঁরা আদায় করে নিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি। যে দাম্ভিকতার বড়াই করে পুরুষেরা একে অপরের নিরপরাধ মাকে আক্রমণ করে অত্যন্ত নোংরা জঘন্য এবং নির্মম ভাষায়, যাকে হয় তো কোনোদিন দেখেওনি সে পুরুষ।

লেখক : কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।