রোহিঙ্গাদের দায় মিয়ানমারকেই নিতে হবে
বাঙালি জাতি হিসেবে আবেগপ্রবণ আবার একইসঙ্গে আছে তীব্র আবেগ শূন্যতা। মাছি মরতে দেখলে আবেগে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা আবার চোখের সামনে মানুষ মরতে দেখলেও সাহায্য না করে উল্টা পথে হাঁটা ধরে। ভারসাম্যহীন আবেগ। কোনো এক মহাজাগতিক কারণে আমাদের সেই ভারসাম্যহীন আবেগ জাগাতে এবং আবেগের তীব্রতা বাড়াতে এখন অনুঘটক লাগে। সেই অনুঘটকের নাম- ভিডিও। কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা শুনলে আমরা অপেক্ষা করি বিষয়টার ভিডিও দেখার জন্য। যতক্ষণ না পর্যন্ত ভিডিও দেখবো ততক্ষণ আমাদের ভোঁতা অনুভূতি সক্রিয় হবেনা। আর অনুভূতি সক্রিয় হলে প্রতিবাদের ঝড় উঠাবো ফেসবুকে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যাবে।
আমরা একেবারেই ভাবিনা এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া কতখানি বৈধ কিংবা একজন মানুষ হিসেবে কতখানি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিচ্ছি! সত্যটা যাচাইয়ে ভিডিওর চর্চা বেশিদিনের না হলেও আমরা এটিকে জীবনাচারণের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছি। সংবাদ মানেই এখন ‘ভিডিওসহ’। পারিবারিক ও বন্ধুমহলের কূটনীতি চর্চাকারীদের আলোচ্যবিষয় গহনা-প্রেম-পরকিয়া থেকে টার্ন নিয়ে এখন রমরমা ‘অন্যের ব্যক্তিজীবনের ভিডিও’।
ভারসাম্যহীন অনুভূতি চর্চায় অন্যের সহানুভূতি আদায়ের অন্যতম মাধ্যম হলো নারী ও শিশু। পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে কোন জাতির প্রতি সহিংসতা, অন্যায় কিংবা অবিচারের ঘটনা ঘটলে প্রথমেই মিডিয়ায় উঠে আসে অত্যাচারিত নারী ও শিশুর ছবি। খুব সচেতনভাবে মানুষের সহানুভূতি আদায়ের পন্থা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নারী ও শিশু চরিত্রকে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজটি করে চলেছে আর আমরা ফেসবুকে পোস্টের পর পোস্ট দিয়ে সেসব ভাইরাল করে চলেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব ছবি ও ভিডিও আসছে আদৌ সেসব বস্তুনির্ভর কিনা কিংবা ঘটমান বর্তমান সময়ের কিনা তা যাচাইও করিনা! ফেসবুক তালিকায় থাকা বন্ধুদের পোস্ট থেকে কয়েকদিন যাবত অসংখ্য ছবি ও ভিডিও দেখলাম এরমধ্যে আছে নাটক ও সিনেমার নায়ক নায়িকাদের অভিনয়কালীন নির্যাতন দৃশ্য, রাজনৈতিক নেতাদের মিছিলের ওপর হামলা ও তাদের হেনস্থার দৃশ্য, বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ চলাকালীন নির্যাতন দৃশ্য যাদের ভৌগোলিক অবস্থান ভিন্ন কিন্তু চেহারা এক। বাজারের হটকেক এসব ভিডিও।
ভারসাম্যহীন অনুভূতি চর্চায় অন্যের সহানুভূতি আদায়ের আরেকটি মাধ্যম ধর্মীয় উসকানি। রোহিঙ্গা শব্দের সঙ্গে খুব বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হচ্ছে আরো একটি শব্দ ‘মুসলিম’। নির্যাতিতদের পরিচয় তারা মুসলিম রোহিঙ্গা। একে পার্শ্ববর্তী দেশ তারওপরে ধর্মীয় অনুশাসন এক হওয়ার কারণে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুর আছর এসে পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। বিশ্বনীতি নির্ধারকদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে চলমান রোহিঙ্গা মুসলিম প্রশ্নে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করতে শুধু যেন বাংলাদেশেরই বিরাট দায় পড়ে গেছে! তারা মিয়ানমারের শান্তির দেবীকে পূজা দিয়ে প্রতিনিয়ত তুষ্ট করে চলেছেন। বিশ্ব হর্তাকর্তাদের বলি, আপনি যেমন মানবিক- মানবিক বাংলাদেশও, অসহায় মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টে আপনার যেমন বুক ভেঙে যাচ্ছে আমাদেরও তাই, নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত সেটা আপনি যেমন বোঝেন আমরাও বুঝি। কেবল পুনর্বাসনের দায় বাংলাদেশের! দরদ খুব বেশি থাকলে নিজেরা আশ্রয় দিন।
আবার বাংলাদেশেরও কিন্তু অসংখ্য মানুষ চায় রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় দিতে। এর বড় কারণ সমধর্মীয় মহব্বত। মানবাধিকারের প্রশ্নে নির্যাতিতের কোনো আলাদা জাতিসত্ত্বা থাকতে নেই কিন্তু রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে মানবিক আবেদনের চেয়ে মুসলিম শব্দটি হাজারগুণ বেশি প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে এবং আমাদের দেশের কিছু মানুষকে ভীষণভাবে কাতর করে তুলছে, তবে নির্যাতিত অন্য ধর্মীয় মতাবলম্বীদের নিয়ে তাদের কিন্তু মোটেও মাথাব্যথা নেই। ধরা যাক, রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়ে তাদের ওপর চলমান দমন নিপীড়ন থেকে বাঁচানো গেল কিন্তু এর পরের সমাধানটা কি! সমাধান কি মিয়ানমার কখনো আদৌ করতে চাইবে! আর না চাইলে বাংলাদেশই বা কোন যুক্তিতে রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেবে! শুধু মানবিকতার খাতিরে! আগেও বহু রোহিঙ্গা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাঙালি পরিচয়ে তারা এদেশে খুঁটি গেড়ে বসেছে, তাদের কীর্তিকলাপ মোটেও সন্তোষজনক নয়।
আমরা চাই, বাংলাদেশ তার নিজের হাজার হাজার সমস্যার সমাধান আগে করুক। নিজের ভালো পাগলেও নাকি বোঝে! বাংলাদেশকে তার নিজের ভালোটা আগে বুঝতে হবে। আর্তের পাশে দাঁড়ানো মানবধর্ম। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে খুব ভালোভাবেই আমরা সেটা জেনেছি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আমাদের পাশে না দাঁড়ালে, লাখ লাখ মানুষের খাওয়া পড়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে আশ্রয় না দিলে, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রচালনা থেকে শুরু করে নানাভাবে প্রশিক্ষিত না করলে আমাদের মহান স্বাধীনতা লাভ হয়তো অধরা থেকে যেত। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে স্বগর্বে জানান দিতে ভারতের অসামান্য অবদানের কথা আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্বীকার করি। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোটাও কি সেই একইরকম বিষয়! মোটেও তা মনে করি না। পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারটিকে অন্য পক্ষ নেতিবাচক অর্থে সদ্ব্যবহার করতে চাইলে সেটা তাকে কখনোই করতে দেয়া উচিত নয়। এই মুহূর্তে বিশ্বনীতিনির্ধারকদের উচিত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের জন্য চাপ না দিয়ে মিয়ানমারকে পলিসি মেকিংয়ে সাহায্য করা। শান্তির দেবীকে আর কত পূজা!
ভারসাম্যহীন আবেগ চর্চায় পুলিশ শিক্ষক পিটিয়ে হত্যা করলে আমরা প্রতিবাদ করি না। দুই-একদিন আহা উহু করে ফেসবুকে পোস্ট দেই। বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জবাই করলে আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি, হাজার হাজার ভূমিপুত্রদের এই শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকতে দেখেও কারো একটা চুলও ছিঁড়তে পারি না, চাপাতি দিয়ে কাউকে আঘাতে আঘাতে হত্যা করা হলেও এবং দৃশ্যের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরেও যার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় না এবং আমরা মাথা চুলকাতে চুলকাতে সেটা মেনেও নেই অথচ সেই আমরাই আরেক দেশের মুসলিম ট্যাগধারী রোহিঙ্গাদের নিয়ে মানবাধিকার কপচাই! কি মজার না আমরা!
বাঙালির মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রতি মায়া জাগিয়ে তুলছেন কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাদের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ইতিহাস। গ্রহণযোগ্যতা আছে আবার নেইও। একসময় মিয়ানমারের আশেপাশে কারেন, শান, কাশিনসহ আরো অনেকগুলো প্রদেশ ছিল। ব্রিটেন দখল করে নিয়ে সবগুলো প্রদেশকে এক করে ফেলে। ১৮২৮ সালে একত্রিত হওয়া প্রত্যেকটা প্রদেশ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। কেবল রোশান/রোহিঙ্গা প্রদেশটি থেকে যায় মিয়ানমারের সঙ্গে। ১৮২৮ সালের শেষের দিকে পরপর বাংলাদেশের নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চল থেকে বেশ কিছু বাঙালি পরিবারকে রোশান/রোহাঙ্গ প্রদেশের বিরান ভূমিতে বসবাসের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্যাতিত এই রোহিঙ্গাদের আদি পুরুষ আসলে বাঙালি। আবার কেউ কেউ বলছেন রোহিঙ্গা ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারেরই অধিবাসী। প্রায় দুশ বছর আগের কেচ্ছা-কাহিনী শুনিয়ে এদেশে নিজের অধিকার পেতে চাওয়া একেবারেই অযৌক্তিক।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস